দুপুর থেকে মোবাইলের পাওয়ার অফ করে বালিশে মুখ গুজে পড়ে আছি। মনের সিদ্ধান্ত ছিল, সাতদিনের আগে আর এই মোবাইল চালু করা হবে না। নোটিশ টানাতেও ইচ্ছে হয়েছিলÑ‘কর্তৃপক্ষ ঘুমের ঘরে আছে। সাতদিনের আগে জাগানো যাবে না। মোবাইলটা রাগ করেই বন্ধ করেছি। রাগ না করে কি করব! সকালে ক্যাম্পাসে অন্য ডিপার্টমেন্টের মেয়ের সাথে বসে চা খাচ্ছিলাম। কোথায় থেকে পাখিটা ছুটে এলো। শার্ট ধরে টেনে তুলল বলল, ‘তুই কখনো আর আমার সামনে আসবি না।’ কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে হেঁটে চলে গেল।
হুট করে ঘুমটা কেটে গেল সন্ধ্যার দিকে। প্রায় মানুষই ঘুম থেকে জেগে প্রথমেই ঘড়ি দেখে। সময়টা জেনে নেয়। অভ্যাসটা আমারও আছে। মোবাইলটা অন করার সাথেই মেসেজের টোন বেজে উঠল। আমাকে একজন মেসেজ দেয়। নিশ্চয় এটা তারই দেয়া মেসেজ। এতোক্ষণে পাখির রাগ কমেছে।
ময়নাপাখিটার মেসেজ না পড়ে থাকি কি করে! মেসেজ পড়ার জন্য বাম হাতে ঘুমজড়ানো চোখ দুটো ঘষেমেজে নিলাম। আকুল হয়েই মেসেজ পড়ছি...‘এই কাইল্যা ভুত তোর মোবাইল অফ কেন? তুই এখন কার হাত ধরে হাঁটছিস বল? তোকে যদি...(শেষটুকু মনে মনে পড়ছি যাতে আর কেউ শুনতে না পারে, ছি ছি কিসব লিখেছে মেয়েটা!)।
পাখিটার মানভঞ্জন করার তরিকা এতোদিনে শিখে নিয়েছি। মান ভাঙাতে কল দিয়ে মনে মনে বলছি, ফোন ধরো সোনা পাখি। রিং হচ্ছে কিন্তু এতো দেরি রিসিভ করতে!
‘কীরে হারামি কী বলবি?’
এতোক্ষনে মহারানীর কন্ঠে হ্যালো শুনতে পেলাম, পাখিটা জানে না ওর মুখে হারামি ডাকটা শুনেও বুকের ভেতর দক্ষিনা বাতাস একশ মাইল বেগে ছোটে। ভালোলাগা চেপে গিয়ে বলি,
‘হ্যালো সোনা বউ থুক্কু পাখি, ফোন রেখে কই গেছিলা?’
‘তোর মায়ের কাছে গেছিলাম, বিচার দিতে।’
‘ভালো করেছো। আমারে খুঁজতেছিলা ক্যান?’
‘হুমায়ূন আহমেদের কোন বইটা নেই বলছিলি, বইমেলা থেকে কিনবো। তুই কী কাল যাবি আমার সাথে?’
ওর কথা শুনে মনে মনে বলি, বউয়ের সাথে বইমেলায় যেতে কার না মন চায়? কথাটা না বলে, বলি,
‘এই শোনো, আমার না কোন বই লাগবে না, একটা বউ লাগবে। তুমি কী আমারে একটা বউ এনে দিতে পারবা?’
আমার কথা শুনে মহারানী যা একটা বানী দিল, আমার বদ বন্ধু বদরুল শুনলে নির্ঘাত হাটফেল করতো। শেষে বলল,
‘তোর মত কাইল্যার বউ কে হবে রে?’
সাহসের বড়ি খেয়ে এবং কন্ঠে একরাশ মায়া যোগ করে সুমনাকে বললাম,
‘তুমি কী আমার লাল টুকটুকে...’
বাকিটুকু না বলে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছি কারণ অপরপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, শুধু শোঁ শোঁ শব্দ আসছে। নাকি নাগিনী ফোস ফোস করছে দংশন করার জন্য। আহ! এ যাত্রা বেঁচে গেলাম নাগিনীর হাতের কাছে নেই বলে। ফোনে আর হ্যালো হ্যালো করার সাহস হল না। যদি কানের কাছেই ছোবল মেরে বসে। তাই লাইন কেটে দিয়ে খুশি মনে হেঁটে হেঁটে বাসা ছেড়ে অনেকটা পথ চলে এলাম। যাক শেষ পর্যন্ত পাগলীটাকে বলতে পেরেছি। বই না, বউ চাই।
সন্ধ্যায় বাসার ফেরার পর আব্বাজান আমার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বাবু, কাল যদি বই মেলায় যাস তাহলে কয়েকটা বই কিনে আসিস।’ বাপজান লিষ্ট ধরিয়ে দিলেন, তাঁর প্রিয় কিছু বই বইমেলা থেকে কেনার জন্য। তখন আব্বাকে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, তারচেয়ে বউ কিনে আনা যায় না বাবা?
২।
আজ সুমনার (চেনেন তো সুমনাকে? আমার মহারানী। আমাকে যে কাইল্যা বলে ডাকে) সাথে দেখা হবে। দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেছে। দশ মিনিট এখনো পার হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তর সইছে আমার। জানি না আজ কী আছে বরাতে? ঠিক দশ মিনিট পরই মাথা নিচু করে সামনে এসে দাঁড়াল সুমনা। বুকে বই জড়িয়ে ধরে আছে। বইয়ের মতো জড় পদার্থের সৌভাগ্য দেখে হিংসে হলো। বইয়ের জায়গায় আমি থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো! হায় ঈশ্বর, আমাকে এই মুহুর্তে একটা বই বানিয়ে দাও না হয়। মুখ খুলল সুমনা,
‘বাবু, চল আমার সাথে বইমেলায় যাবি। স্যারের বইটা কিনব।’
‘চলেছি বউয়ের সাথে বইমেলায়।’ মিনমিন করে বললাম।
‘চুপ করে থাক কাইল্যা...।’
কথাটা সুমনা ছাড়া আমাকে আর কেউ বলে না। বাধ্য স্বামীর মতো বউয়ের পিছু পিছু চলছি এবারের ফাগুনের হাওয়ায় ভেসে প্রিয় বইমেলায়।
বইমেলা থেকে রিক্সায় ফিরছি আমি আর সুমনা। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি সুমনা কথাটা বলার জন্য। মুখ খুললাম আমি,
‘সুমনা, তুমি কী আমার লাল টুকটুকে বউ হবা?’
সুমনা দুই হাত দিয়ে ওর কান চেপে ধরে রেখে বলল,
‘তোর কথা আমি কিছু শুনি নি বাবু।’
সুমনার কথা মুনে মেজাজ খরাপ করে বসে রইলাম দেখে সুমনা বলল,
‘তুই এখন নেমে যা।’
‘কেন?’
‘তোর লাল টুকটুকে বউের হুকুম!’