ভ্রমণ স্মৃতি :: মধু কবির সাগরদাঁড়ি ও কপোতাক্ষ
ফারুকুর রহমান চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য লেখক এবং আধুনিক বাংলা নাটক ও বাংলা সনেটের প্রথম রচয়িতা হচ্ছেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । তিনি বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছেন । বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃত ও বাংলা সনেটের নতুন ধারার প্রবর্তক এই কবি ১৮২৪ সালে ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন স্থানীয় জমিদার এবং মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন ¯েœহপরায়ণ ও পরদুঃখকাতর রমণী । মাতাপিতা দুজনই মুক্তহস্তে দান করতে ভালবাসতেন এবং আমোদ আহল্লাদে অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। বাবা মাকে লক্ষ্য করে মধু কবি হয়ে উঠেছিলেন স্বভাবসরল, উদার মন, প্রেম-প্রবণ ও কোমল হৃদয়ের মানুষ । কিন্তু ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মিশন রোডে ‘আর্চ ডি কস ডিয়াল্টির’ নিকট খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার অপরাধে পিতা রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর একমাত্র পুত্র মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ত্যাজ্যপুত্র করেন । এই অপরাধেই পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে আসার সুযোগ হয়নি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের । শৈশবের মাত্র নয় বছর ছিলেন পৈত্রিক বাড়িতে । পড়ালেখার জন্য নয় বছর বয়সেই পাড়ি দিতে হয়েছিল কলকাতায় । কবির সেই নয় বছরের স্মৃতি বিজড়িত সাগরদাঁড়ির জমিদার বাড়িটি বর্তমানে সরকারীভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে । ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এক সুযোগে দেখে এলাম মধু কবির সাগরদাঁড়ি গ্রাম এবং গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ । 1
সিলেট থেকে হানিফ পরিবহণের বাসে চড়ে যশোর গেলাম । সেখানে একদিন বিশ্রাম নিয়ে সাগরদাঁড়ি যাতায়াতের বিস্তারিত খোঁজ খবর নিলাম। পরের দিন সকালের নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে পরলাম সাগরদাঁড়ির উদ্দেশ্যে । যশোর থেকে সাধারণ বাসে চড়ে সাতক্ষীরা অভিমুখে ৩৬ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম কেশবপুর উপজেলা সদরে । বাস থেকে সাগরদাঁড়ি মোড়ে নামতেই চোখে পড়ল আকর্ষণীয় একটি তোরণ । সড়কের উভয় পার্শ্বে নির্মিত দুই স্তম্ভের তোরণের একটিতে কবির ছবি অপরটিতে লেখা-
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল । এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত্ত
দত্ত-কূলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন ।
যশোরে সাগরদাঁড়ী কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমী, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী ।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন রোজ রবিবার কলকাতাস্থ আলিপুর ইউরোপিও জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণের পূর্ব মুহূর্তে ১৪ অক্ষরে আট লাইনের এই কবিতা লিখে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন এই ‘সমাধি’ লিপি কবিতাটি তাঁর সমাধির উপরে লিখে রাখা হয় । কবির এই কবিতাটিই কেশবপুর উপজেলায় নির্মিত তোরণের গায়ে লিখে রাখা হয়েছে । সময় নিয়ে তোরণের চার পাশ ঘুরে দেখলাম । এবার সাগরদাঁড়ি যাবার পালা । বর্ণিত তোরণের সামনে থেকে ভেন গাড়ি কিংবা মোটর সাইকেলে যেতে হবে ১৩ কি.মি. পথ । অপরিচিত এলাকা তাই মোটর সাইকেলে না গিয়ে অন্যান্য সাধারণ যাত্রীর সঙ্গে গা ঘেষাঘেষি করে ভেন গাড়িতেই বসলাম । গ্রামীণ পরিবেশে আঁকাবাঁকা ১৩ কি.মি. পথ অতিক্রম করে পৌঁছলাম সাগরদাঁড়ি। এ গ্রামেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈত্রিক নিবাস; শৈশবের বেড়ে ওঠা ও বাল্যশিক্ষা অর্জন । সাগরদাঁড়ি গ্রামে থাকাকালে পার্শ্ববর্তী শেখপুরা গ্রামে মৌলবী লুৎফুল হক মাস্টারের নিকট বাংলা ও ফার্সি চর্চা করেছিলেন । একই সময় সাগরগাঁড়ি গ্রামে হরলাল রায়ের কাছে বাংলা ভাষা শিখেছিলেন । মাত্র তিন বৎসর শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বাংলা, ইংরেজি ও ফার্সি ভাষায় সুনাম অর্জন করেছিলেন মধুসূদন দত্ত । শৈশবে তাঁর মধ্যে অসাধারণ প্রতিভা ধরা পড়ে । তাই শিক্ষক হরলাল রায় কবিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন-
নামে মধু, হৃদে মধু বাক্যে মধু যার
এহেন মধুরে ভুলে সাধ্য আছে কার।
হরলাল রয়ের মধু’কে ভুলার সাধ্য কারও নেই । তাইতো কবির স্মৃতি বিজড়িত সাগরদাঁড়ি গ্রামটি এক পলক দেখার জন্য দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলে মধু ভক্তরা। সে যাই হোক, ভেন গাড়ি থেকে নেমে কবির বাড়িতে গেলাম । নির্ধারিত টিকেট সংগ্রহ করে প্রবেশ করলাম কবির পৈত্রিক বাড়িতে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম- প্রবেশ দ্বার, মূল ভবন, ভবনের পাশে কবির প্রতিকৃতি, মন্দির, কবি পরিবারের ব্যবহৃত আসবাপত্র, লোহার সিন্দুক, কাঠের সিন্দুক, কাঠের আলনা, কবির প্রসূতিস্থল, বাড়ির পাশে পুকুর, আম বাগান, পোস্ট অফিস, ডাকবাংলাসহ জমিদার বাড়ির চারপাশ । সবশেষে দেখতে গেলাম কবির শিশুকালের অনেক সুখ-স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ । যে নদের বুক চিরে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এপার ওপার যাওয়া আসা করতেন; নদীর পাড়ে বসে পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতেন । এই কপোতাক্ষ নদকে ভালবেসেই ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে রচনা করেছিলেন-
সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে,
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্র ধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে ।
বহুদেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ ¯েœহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ?
দুগ্ধ ¯্রতোরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে ।
আর কি হে হবে দেখা ? যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেতে দিতে
বারি রূপ কর তুমি; এ মিনতি গাবে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে ।2
কবির স্মৃতি বিজড়িত এই কপোতাক্ষ নদ ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর হয়ে যশোর জেলার চৌগাছা, ঝিকরগাছা, মনিরামপুর, কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি গ্রাম হয়ে সাতক্ষীরার সরুলিয়া, পাটকেলঘাটা, তালা হয়ে সুন্দরবনের খোলপেটুয়া নদী হয়ে সাগরে মিশেছে । তাই এই কপোতাক্ষ নদ বয়ে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করতো । এই কপোতাক্ষ হয়েই কবি নয় বছর বয়সে কলকাতা পাড়ি জমিয়েছিলেন । কিন্তু আজ আর বুঝার উপায় নেই কপোতাক্ষ নদ তখনকার সময় কেমন ছিল । কপোতাক্ষ নদ এখন ছোট্ট একটি খাল; তাও কচুরিপানায় বদ্ধ জলাশয় রূপ ধারন করেছে । নদীর ওপারে জেগে উঠা চরের দীর্ঘ এলাকায় করা হয়েছে চাষাবাদ । সম্ভবত ভূমিখেকোদের দখলে রয়েছে এই স¤্রাজ্য । যতদূর দেখা যায় পাথর চোখে তাকিয়ে দেখলাম কবি সেই স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ । পাশেই পুরনো একটি কাঠবাদাম গাছ । গাছটি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে । কারণ এই গাছের সাথেও রয়েছে কবির অনেক স্মৃতি; এই কাঠবাদাম গাছের নীচে বসে কপোতাক্ষের সাথে আনমনে কথা বলতেন মধুসূদন দত্ত ।
খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে নদী পথে সাগরদাঁড়ি গ্রামে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু ধর্ম ত্যাগের অপরাধে পিতা রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর একমাত্র পুত্র এবং পুত্রবধুকে পিতৃভিটায় প্রবেশ করতে দেননি । তাই কাঠবাদাম গাছে নীচ বসেই বাবার সম্মতি চাচ্ছিলেন । কিন্তু বাবার সম্মতি না পাওয়ার কারণে এই বাদামতলা থেকেই অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁকে । পিতার মৃত্যুর পর স্ত্রী হেনরিয়েটা, মেয়ে শর্মিষ্ঠা এবং পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে আবার এসেছিলেন সাগরদাঁড়ি গ্রামে। কিন্তু তখনও তাঁকে বাড়ির ত্রিসীমায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি । বাড়িতে উঠতে না পেরে কাঠবাদাম গাছের নীচে তাঁবু বানিয়ে ১৪ দিন অবস্থান করেছিলেন। মা জাহ্নবী দেবী তাঁর মৃত স্বামীর আদেশ পালন করতে গিয়ে একমাত্র ছেলেকে কাছে ভিড়তে দেননি কিন্তু মনকে সান্ত¡না দিতে বাড়ির ছাদে লুকিয়ে থেকে ছেলেকে দেখতেন আর কাঁদতেন। এহেন অবস্থায় দুঃখ ভরাক্রান্ত মনে কাঠবাদাম গাছের নীচ থেকেই কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । এরপর তিনি আর সাগরদাঁড়ি গ্রামে আসেননি । ১৮৭৩ সালের ৩০ জুন মৃত্যুবরণের পর তাঁকে কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাহিত করা হয় । মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন মায়ের একমাত্র সন্তান । মা তাঁকে প্রচ- ভালবাসতেন । খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় মা প্রচ- কষ্ট পেয়েছিলেন । মৃত্যুর আগে করুণ সুরে বারবার স্মরণ করতেন একমাত্র ছেলের কথা । দেখার জন্য প্রচ- ছটফট করেছিলেন । মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে আত্মীয়কে বলেছিলেন- আমি জীবনে মরে আছি, জলন্ত শোকের আগুন আমাকে কয়লা করে ফেলেছে, আমি মরিয়াই বাঁচি । কিন্তু আমার বাছা যে সাত সমুদ্রের ওপাড়ে রয়েছে, তাঁর মুখখানি না দেখে আমার যে মরতে ইচ্ছে করে না… । কবি নেই, তাঁর মা ও নেই, নেই পিতা কিংবা পাড়া-প্রতিবেশি, নেই জমিদারি প্রথা । কিন্তু রয়ে গেছে সাগরদাঁড়ি গ্রাম, মৃত প্রায় কপোতাক্ষ নদ, কাঠবাদাম গাছ আর কবির রেখে যাওয়া অমর সৃষ্টি । এখন প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে সাগরদাঁড়ির দত্ত বাড়িতে; হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান । কবির জন্ম দিন উপলক্ষ্যে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে সাগরদাঁড়ি গ্রামে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে । মেলাটি মধু মেলা নামে পরিচিত । ঐ মেলায় নানান ধর্মের, নানান বর্ণের মানুষ বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় । এ ঘুরে বেড়ানোতে কোনও বাঁধা-নিষেধ নেই । কিন্তু ধর্মের বাঁধা নিষেধের কারণে কবি-মাতা তাঁর একমাত্র পুত্রকে শেষ দেখা দেখতে পারলেন না । একটা তীব্র ব্যথা বুকে নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁকে ।
কবির স্মৃতি বিজড়িত সাগরদাঁড়ি গ্রাম, কপোতাক্ষ নদ এবং কাঠবাদাম গাছ দেখতে-দেখতে দিন ফুরিয়ে গেলো । এবার বাড়ি ফিরার পালা । তড়িঘড়ি করে স্থানীয় মিউজিয়াম থেকে কিছু বই সংগ্রহ করলাম । কিন্তু বিদায় বেলা বেশ বিপাকে পড়তে হলো ! লোকসমাগম কম থাকায় ভেন গাড়ি চালকরা বাড়ি চলে গেছে । অপরিচিত এলাকায় আটকে গেছি, কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অবশেষে মিউজিয়ামের এক ভদ্রলোকের সহযোগিতায় দুইশত টাকার বিনিময়ে একটা মোটর সাইকেল ভাড়া করলাম । সাগরদাঁড়ি থেকে কেশবপুর ফিরছি । কিন্তু মাঝ রাস্তায় এসে মোটর সাইকেলের চাকা ফেটে গেলো । আবারও বিপাকে পড়লাম। সাগরদাঁড়ি গ্রাম যেন আমাকে যেতে দিচ্ছে না ! তবুও যেতে হবে । নিরুপায় হয়ে মোটর সাইকেল চালককে সাথে নিয়ে মাইল খানেক পথ হাঁটতে হলো । এরপর আরেকটা মোটর সাইকেল ভাড়া করে ফিরে এলাম কেশবপুর। সেখান থেকে সাধারণ বাসে চড়ে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এলাম যশোর ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫১