আজ ১৫ মে নাকবা দিবস পালন করছেন ফিলিস্তিনিরা। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়িঘর ও জমি থেকে উচ্ছেদ করেছিল। সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের স্মরণে প্রতি বছর এই দিনটি পালন করেন ফিলিস্তিনিরা।
ফিলিস্তিনে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় জাতিসঙ্ঘ। কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থানান্তরিত হওয়ার লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয় এই ঘোষণার মাধ্যমে। তবুও ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের একচ্ছত্র দখল নিশ্চিত করার জন্য তখনো বসবাসরত আরবদের জোর করে উচ্ছেদ করা হয় আন্তর্জাতিক সব আইন ও জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব লঙ্ঘন করে। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর এই নৃশংসতাকে নাকবা বা মহাবিপর্যয় হিসেবে স্মরণ করেন ফিলিস্তিনিরা। ১২৬ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি নাগরিক রজব আল-তউম ১৯৪৮ সালের নাকবার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, ইতিহাসের বইগুলো ফিলিস্তিনি নাকবার (মহাবিপর্যয়) দিনকে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৪৮ সালের মে মাসের ১৫ তারিখের এই দিনটি একই সাথে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার দিনও। স্থানীয় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদি সন্ত্রাসী দলগুলোর নৃশংসতার কথাসহ সব ঘটনা আল-তউম এখনো পরিষ্কারভাবে স্মরণ করতে পারেন। এসব স্মৃতি এখনো তার চোখে পানি আনে। আল-তউম আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ‘ওই সময়ের গণহত্যা এখনো আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে আছে’।
নাকবা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে ৫৯ বছর পার হয়ে গেছে। যখন হিংসাত্মক ইহুদিবাদী দলগুলো লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি ও গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল তখন আল-তউম বিরশেবায় (বর্তমানে ইসরাইলের দণিাঞ্চলে) একটি খামারে কাজ করতেন।
একজন অল্পবয়সী ফিলিস্তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীকে হত্যার আগে স্বামী ও সন্তানের সামনে দিয়ে ইহুদি সৈন্যদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখার কথা তিনি স্মরণ করেন। আল-তউম বলেন,‘আমি তা দেখে ভয়ে কাঁপছিলাম। আমি ভীত ছিলাম যে, তারা আমাকেও হত্যা করবে।’
অন্তঃসত্ত্বা নারীকে হত্যা করার পর আল-তউমসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি যারা ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন, তাদের কিছুটা বিরাম দিয়ে সৈন্যরা চলে যায়। অবশ্য পরে আল-তউম ভয়াবহভাবে আবিষ্কার করেন যে, এই অন্তঃসত্ত্বা নারীটি একমাত্র ফিলিস্তিনি নয়, যাকে ইহুদি আধাসামরিক দলগুলো হত্যা করেছে। তিনি পরে দেখতে পান যে, বহু নারী, পুরুষ ও শিশুকে তাদের পরিবারের সামনেই হাগানাহ ও কুখ্যাত স্টার্ন গ্যাংয়ের মতো সশস্ত্র ইহুদিবাদী দলগুলো হত্যা করেছে।
আল-তউম আরো বলেন, অনেককে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে এবং অন্যদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওই সময় বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি এই বিপর্যয়ের বিশালতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং ক্রমেই সেটা তাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল। তারা এই সঙ্কটের উদ্দেশ্য বুঝতে শুরু করল, যখন ভারী অস্ত্রসজ্জিত ইহুদি দলগুলো তাদের গ্রামে ট্যাংকের মাধ্যমে তীব্র আক্রমণ করা শুরু করল। আল-তউম বলেন, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের খবর ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ ও শিশুদের তাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচনা দিতে লাগল। তাদের অনেকেই সব সম্পত্তি রেখে স্থান ত্যাগ করে। বৃদ্ধ লোকটি বলেন, ‘বাসিন্দাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে পালাতে বাধ্য করার জন্য ইহুদি দলগুলো ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোয় নির্বিচারে বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে’। তিনি আরো বলেন, শত শত ফিলিস্তিনি তাদের বিধ্বস্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে সমাহিত হন। বর্তমানে গাজা উপত্যকার বেইত লাহিয়া শহরে বসবাসকারী আল-তউম বলেন, ‘ইতিহাসের বইগুলো এখানে হওয়া গণহত্যার ভয়াবহতার কথা যথাযথভাবে বর্ণনা করতে ব্যর্থ হয়েছে’। তিনি দাবি করেন ফিলিস্তিনি পরিবারের যারা তাদের বাড়ি হারিয়েছে তাদের পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতার প্রতি তারা ন্যায় বিচার করেনি। তিনি বলেন, আতঙ্কের কারণে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো তাদের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা তিনি কখনো ভুলবেন না। আল-তউম বলেন, ‘এটা ছিল আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য’। তিনি গ্রেট ব্রিটেনের ভূমিকার সমালোচনা করেন। গ্রেট ব্রিটেনের এই ভূমিকা ইহুদি দলগুলোকে ফিলিস্তিনি গ্রাম আক্রমণ ও ধ্বংস করার অনুমোদন দিয়েছিল।
আল-তউম ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের কুখ্যাত ‘বেলফোর ডিকারেশন’-এরও সমালোচনা করেন। এই ঘোষণায় ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় ফিলিস্তিনে ইহুদি স্থানান্তর প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এই স্থানান্তকরণ প্রক্রিয়া ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। চূড়ান্তভাবে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় বা আক্রমণকারী ইহুদি বাহিনী তাদের স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করে। একই সময়ে দখলকারীরা শত শত ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর পুরোপুরি ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এর পর থেকে ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু। আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একই সাথে ফিলিস্তিনিদের অনেকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার উদ্বাস্তু শিবিরে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। আল-তউম দাবি করেন, ‘ব্রিটেন ইহুদি দলগুলোকে অস্ত্র দিয়েছে ও রক্ষা করেছে’। তিনি আরো বলেন, অনেক ফিলিস্তিনি যারা তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে তারা বিশ্বাস করত যে, তারা শিগগিরই তাদের জায়গায় ফিরে আসবেন; কিন্তু তাদের এই ধারণা ছিল ভুল। এই ফিলিস্তিনিদের অনেকে তাদের বাড়ির চাবি রেখে দিয়েছিল। অনেকে রাতের আঁধারে মাঠে গিয়ে ফসলের যত্ন নিত। শতবর্ষী এই ব্যক্তি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আস্তে আস্তে তারা উপলব্ধি করতে পারেন যে, তারা তাদের পৈতৃক বাড়ি ও জমিতে কখনো ফিরতে পারবে না।’
আনাদোলু নিউজ এজেন্সি অবলম্বনে।