একসময় সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করার সুবাদে এক বড় ভাই হঠাৎ করে একদিন ফোন দিলেন। যিনি সমাজে খুব ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত। গাড়ি বাড়ি আছে। উনি একান্তভাবে দেখা করতে চাইলেন, ফোনে কিছু বললেন না। সন্ধায় এক রেস্টুরেন্টে বসলাম। উনি কিছু ঘটনা বললেন, সাথে একটা ফেইসবুক আইডি দিলেন, যে আইডির কিছু তথ্য লাগবে। বললাম, আমি তো এসব ছেড়ে দিয়েছি তবুও আমি চেষ্টা করবো। তবে উনি যথেষ্ঠ রকমের অনুনয় করে বললেন, ‘কাউকে বলতে পারছি না তাই তোমাকে বললাম। যে আইডি দিয়েছি এটা আমার স্ত্রীর নাম্বার’। উনার একটা নয় বছরের বাচচা আছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তাদের যুগল ছবি দেখতাম, দেখে মনে হতো খুবই হ্যাপি কাপল। দুই একদিনের চেষ্টায় সেই আইডির কিছু ডেটা যোগাড় করা হলো। এবং ঐ ভাই যে ধারণা করেছিলেন, সেটাই সত্য হলো। যাই হোক, সেটা পরে মনে হয় পারিবারিকভাবে সেটেল ডাউন করা হয়েছিলো, তবে তারা একে অপরেই ভার্চুয়াল জগত থেকে সরে গিয়েছিলেন। পরে ওই বড় ভাই আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি, হয়তো লজ্জায়। আমিও আর কখনো যোগাযোগ করিনি।
এমন ঘটনা অবশ্য পুরুষদের ক্ষেত্রে এভেইলএবল। তাই আর উল্লেখ করলাম না। তবে ভার্চুয়াল জগতের সহজলভ্যতার কারনে প্রায় সবধরণের সম্পর্কই বেইজলেইস হয়ে গেছে। একটু ঝড় আসলেই সম্পর্কগুলো উড়ে গিয়ে পড়ে সমুদ্রের এপার ওপার। একটা মানুষের জীবনে একাধিক প্রেম থেকে শুরু করে একাধিক বিয়েও অহরহ হয়ে গেছে। আমরাও মেনে নিচ্ছি অবলীলায়। কারন এসব ঘটনা দেখতে দেখতে আমরা চরমভাবে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। তাই খারাপ কিছুকেও আর খারাপ লাগে না, মনে হয় এ আর নতুন কী! আসলেই নতুন কিছু নয়।
আগে একটা মেয়ের বিয়ে হওয়া মানে ছেলেরা সাধারণত সেদিকে আর তাকাতো না। কিন্তু এখন হয়ে গেছে ঠিক বিপরীত। কোনো একটা বিয়ে কোনো রিলেশনে যুক্ত তবুও যোগাযোগের সহজলভ্যতার কারণে কেউ না কেউ তার দড়জার ঠক ঠক করে। যেহেতু সময়টা সম্পর্কহীনতার, সেহেতু প্রতিটি সম্পর্কই এখন দৃশ্যত আইসিইউতে থাকে। তাই কিছু একটা হলেও আমরা নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য অন্যভাবে ব্যস্ত থাকতে চাই। এই চাওয়া আর দুঃখ বলে বেড়ানোর মধ্যে দারুণ একটা যোগসূত্রে অন্য কারো খুব সহজভাবেই এন্ট্রি দিয়ে দেয়। আপাত মোহ থেকে সৃষ্টি করে আরেকটি সম্পর্কহীন ‘সম্পর্ক’। যেটিও মূলত খুব বেশি দিন ঠিকে না।
এখনকার বেশিরভাগ ফ্রেন্ড সার্কেল ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট’ এ বিশ্বাসি। যদিও শতভাগই বোঝানোর চেষ্টা করে, আমি জাস্ট ফ্রেন্ড বা আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড, বন্ধু। তবে আমরা যেভাবে ছেলেবন্ধু মেয়েবন্ধু পালি, সেরকম যদি আমাদের পিতা-মাতারা পালতেন তবে আমরা কিন্তু মেনে নিতাম না। তবে এই খানে আমরা আরেককাঠি সরস, আমার মেয়েবন্ধু থাকলেও খেয়াল রাখি প্রেমিকার যেনো ছেলেবন্ধু না থাকে! ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর কী! অবশ্য দুনিয়ার সবাই-ই খুব বেশি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মেইন টেইন করে। সবাই অবশ নিজেকে মুখোশহীন ভাবে। আর এই ভাবনাটা না ভাবলে কেউ আসলে হাসতে পারতো না। একজন খুনিও নিজেকে কোনো একটা বলে সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়। নইলে সে ঘুমাতে পারতো না।
সেই ছোটবেলা থেকেই পূর্বার প্রেম। তাও আট আটটি বছর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেই সে প্রেম ভেঙ্গে পড়ে। এর পরে সেই প্রেমিকের সাথে পূর্বার বেস্ট ফ্রেন্ড সম্পর্ক হয়। এরই মধ্যে সেই প্রেমিক একজন ডিভোর্সি মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করে, পূর্বাও এর মধ্যে আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। এখানেও টানা চার বছর উথাল পাথাল প্রেম চলে। একে অন্যকে পাগলের মতো ভালবাসে। তবে এর সাথে যখন ঝগড়া চলে তখন পূর্বা সান্তনা খুঁজতো ওই বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে। যতক্ষণ পূর্বার সাথে ঐ ছেলে থাকে ততক্ষণ আবার পূর্বা তার কাছ থেকে মাইনাস হয়ে যায়। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পূর্বার আরও কিছু বন্ধুবান্ধব জোটে। প্রেমিকের সাথে ঝগড়া ঝাটি চললেই সে ব্যস্ত থাকার ছলে সেই সব ভার্চুয়াল বন্ধুদের বাস্তবে যোগাযোগ করে, ঘুরতে যায় ফিরতে যায়। ভালো থাকতে হবে বলে কথা। একসময় পূর্বার সে সম্পর্কটাও ভেঙ্গে পড়ে। তার চারপাশে যেসব বন্ধু বান্ধব ছিলো, সবার একটাই মটো- সমস্যা হলে ছেড়ে দে, নতুন আরেকটা জুটিয়ে নে। এরই মধ্যে সে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, এক বান্ধবীর বাসায় ঠাই নেয়। যে বান্ধবী শুধু টাকার মোহে একজনকে বিয়ে করেছে, কিন্তু সে মনে প্রাণে তার সাবেক প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করে। একদিন সে প্রেমিকের কাছে ফিরে যাবে বলে, জামাইকে স্পর্শও করতে দেয় না। ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কটা জোড়া লাগার কিছুটা সম্ভাবনা থাকলেও সেই বান্ধবীর ইনসেস্টে তা আর হয়ে উঠে না। সে নতুন করে এখন সেই আগের বাঁচার মতো করে বাঁচতে চাইছে। প্রেমিক নয় শুধু বন্ধু বা ফ্রেন্ড।
এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। কোনো সম্পর্কে একটু ঝামেলা হলেই সাথে থাকা বন্ধু বান্ধব কথিত সুহৃদরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ভেঙ্গে পরামর্শ দেয়। ‘জাস্টিস ফর উইমেন’ নামের পেইজটাও একই কাজ করে। কোনো মেয়ে এসে যদি বলে, স্বামীর সাথে সমস্যা হচ্ছে, দুই বেলা প্যারাসিটামল টাইপের ওষুধ, ডিভোর্স দাও, দিয়ে মামলা করো। কিন্তু কখনো দেখিনি সমস্যা সল্ভ করতে। এই পেইজটার মতোই অনেকেই এমন কাজই করেন। সমস্যা হচ্ছে? বদলাও। যা সম্পর্কগুলো দিনকে দিন ঠুনকো করে ফেলছে। সম্পর্ক শুরু করার আগেই সবাই ভেবে বসেই থাকে- এটা তো চিরস্থায়ি নয়। যে কারনে সম্পর্কগুলো আর একই মূল থেকে ডালপালা মেলতে পারে না।
কারো মন খারাপের সময় আপনি যদি তাকে একটু হলেও সাপোর্ট দেন ( যা এখন সবাই করে) সে আপনার উপর দুর্বল হবেই। এমনকি তাকে মোবালাইজ করা খুবই সহজ হয়ে যায়। এবং এখনকার বেশিরভাগ মানুষই এই ভুলের শিকার হচ্ছে। কিন্তু যারা সাপোর্ট দিচ্ছে তারা শুরুতে ফেরেশতা রুপ দেখালেও, সময়ের সাথে সাথে তাদের স্বার্থবাদী চেহারা বের হয়ে আসে।
ব্যক্তি আমি প্রেমিকার জগতে ভয়ংকরতম স্বৈরাচার হওয়া সত্ত্বেও তার আঙ্গিনায় বহিরাগতদের আনাগোনা রুখতে পারিনি। মাঝেমধ্যেই সেইসব বহিরাগতদের জন্য আমিই সিংহাসন চ্যুত হতাম। এবং শেষপর্যন্ত আমি সিরাজদৌলা হয়ে গেলাম। এখন কেউ এখন মরতে চায় না, মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকতে চায় না, সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। এই হাজারো না চাওয়ার কারনে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে কলম্বাসের মতো ভুল ম্যাপে পা বাড়ায়। কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন একুল ওকুল কোনোকুলই আর ধরা দেয় না। মাঝখানে অংশিদারিত্বের জটিলে হিসেবে ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট’রাই একমাত্র লাভবান হয়।
ভার্চুয়াল জগতের অবাধ মেলামেশার কারনে আমাদের সবকিছুই শিশির কণার হয়ে গিয়েছে। রোদ উঠলেই হাওয়াই মিঠাই। কেউ সমস্যা আর সলভ করতে চায় না। সমস্যা হলেই সবাই ‘মুভ অন’ নামক বোরাকে চেঁপে বসে। ভেঙ্গে পড়ছে আবেগের সম্পর্ক, ভেঙ্গে পড়ছে মানবিক সম্পর্ক, ভেঙ্গে যাচ্ছে পরিবার, ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক বাস্তুসংস্থান। ফেইসবুক প্রোফাইলের মতো সামনে সবাই সুখী, কিন্তু ভেতরে কোনো সুখই নেই। আগে পেছনে সামনে ডানে বামে দুঃখ, না পাওয়া শত বছরের বেদন, আশাভঙ্গের হতাশার অজগর ফণা তুলে থেকে ফোঁসফোঁস করে। অথচ ভালো থাকার জন্য আধুনিকতার বুনো উল্লাসে না মেতে যদি ফিরে যেতো ব্যাকডেটেড টাইমে তবে বেঁচে যেতো লাখো লাখো মানব প্রাণ। অভাবের সমুদ্রে অন্তত একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো, অবশ্যই পারতো।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:৫৫