পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্লেটের মাঝে দিন দিন প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এই শক্তির হঠাৎ অবমুক্তিতে পৃথিবীর ভূমিতে এক ধরনের কাঁপুনির সৃষ্টি হয় যা সিস্মিক তরঙ্গ নামে পরিচিত। এই কম্পনের নামই ভূমিকম্প।
ভূমিকম্প কেন হয়?
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ। সাধারণ ভৌগোলিক তলের বিচ্যুতি, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প হয়। এছাড়া ভূমিতে মাইন বিস্ফোরণ, গভীর নলকূপ হতে অত্যধিক পানি উত্তোলন, তেল ও কয়লা খনি এবং পরমাণু পরীক্ষার কারণেও ভূমিকম্প হয়। সাধারণত তিন ধরনের বিচ্যুতি কারণে ভূমিকম্প হয় নরমাল রিভার্স এবং স্টাইক ম্লিপ।
রিখটার স্কেল?
ভূমিকম্প ফলে যে শক্তির অবমুক্ত হয় তা পরিমাপের জন্য যে মানদন্ডের ব্যবহার করা হয় তা রিখটার স্কেল নামে পরিচিত। ১৯৩৫ সালে মার্কিন পর্দাথবিদ চালর্স ফ্রান্সিস রিখটার এবং জার্মান ভূতত্ত্ববিদ বেনো গুটেনবার্গ এই স্কেল উদ্ভাবন করেন। আর যে যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্প মাপা হয় তাকে সিস্মোমিটার বলে।
ভূমিকম্পের ফলে বিশেষ তরঙ্গ (সিস্মিক তরঙ্গ) তৈরি হয়। সিস্মোমিটারে সাহায্যে এই তরঙ্গের ধরনের পাঠ নেওয়া হয়। এই তরঙ্গের বিস্তারে ১০ ভিত্তিক লগারিদম নিয়ে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের আপেক্ষিক তীব্রতা গণনা করা হয়। যেহেতু স্কেলটি ১০ ভিত্তিক লগারিদম তাই এর প্রতি ২ এককের পার্থক্য দশমিক স্কেলের প্রতি ২ এককের পার্থক্যের ১০ গুণ। অর্থাৎ রিখটার স্কেল অনুযায়ী ৬.০ মাত্রাতে ভূমিকম্পের যতকুটু কম্পন অনুভূত হয় ৭.০ মাত্রার ভূমিকম্পে তার চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি কম্পন অনুভূত হবে।
এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের মাত্রা হল ৯.৫; যা ১৯৬০ সালের ২২ মে মাসে সংগঠিত হয়। এর উৎসস্থল ছিল চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে ক্যানিটি নামক স্থানে এটি গ্রেট চিলিয়ান আর্থকোয়াক নামে পরিচিতি এর প্রভাবে সৃষ্ট সুনামি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়িয়ে এশিয়া মহাদেশের জাপান ও ফিলিপাইন এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প:
রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ২১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টা ৫৩ মিনিট ও রাত ২টা ৪১ মিনিটে ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে। সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিটে নীলফামারীতে ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের সীমান্তের কাছে। ৬.১ মাত্রার এই ভূমিকম্পে উৎপত্তিস্থল থেকে ১৮০ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে ১১ জন প্রাণ হারায়।
তারপরও বাংলাদেশের মানুষ এর বিপদ সম্পর্কে সচেতন নয়। কারণ গত ৯০ বছরে কোন বড় ধরনের ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা নেই। সর্বশেষ ১৯১৮ সালে ১৮ জুলাই শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। কিন্তু ঢাকায় এর প্রভাব সামান্যই পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে গড়ে প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে। সেই হিসাবে ঢাকায় ১৩০ বছরে কোন বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি যা চট্টগ্রামে ২৫০ বছর এবং সিলেটে ১০০ বছর। এই সময় গ্যাপের কারণে খুব শীঘ্রই একটি ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।
ভূমিকম্প জোনে বাংলাদেশের অবস্থান:
বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্লেটেরই একটি অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর আগে বার্মিজ প্লেট এবং উত্তরে তিব্বতিয়ান প্লেট, যা ইউরেশিয়ান প্লেটের একটি অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ায় কৌনিকভাবে বার্মিজ এবং তিব্বতিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে পূর্বদিকে ইন্ডিয়ান প্লেট দেবে যাচ্ছে বার্মিজ প্লেটের নীচে এবং বার্মিজ প্লেট ওপরে ওঠায় আরকান-ইয়োমা পর্ব শ্রেণীর সৃষ্টি। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-সিলেট এলাকা পর্বতশ্রেণীর অংশ।
পৃথিবীর অধিকাংশ ভূমিকম্পের উৎপত্তি দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে এ ধরনের আরো দুটি ফল্ট রয়েছে (মধুপুর ও দুখাই) যা থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।
বাংলাদেশের পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। কমপ্রিহেনসিভ ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রধান তিনটি শহর ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৫ লাখ ৫৮ হাজার স্থাপনা ধ্বসে পড়বে। যাতে ঢাকায় প্রায় ৭৮ হাজার ঝুকিপূর্ণ ভবন রয়েছে যাতে সরকারি ভবন প্রায় ৫ হাজার। দিনে ভূমিকম্প হলে মারা যাবে প্রায় ১.৫ লাখ মানুষ এবং আহত হবে আরও ১ লাখ মানুষ। রাতে ভূমিকম্প হলে আরও প্রায় ২ লাখ মানুষ আহত বা মারা যেতে পারে। সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রায় ৯৫ ভাগ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:১৮