বাংলা ‘ধর্ম’ শব্দটির উৎপত্তি ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ শব্দটি থেকে। যদিও ‘ধর্ম’ ‘রিলিজিয়ন’ এর প্রকৃত বঙ্গানুবাদ বা সঠিক অর্থ প্রকাশ করে না। ‘রিলিজিয়ন’ শব্দটির সঠিক অর্থ প্রকাশ পায় ‘ধর্মতন্ত্র’ শব্দটির মাধ্যমে অর্থ্যাৎ ধর্মতন্ত্র একটি সিস্টেম বা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই মানুষের যা ধর্ম (মনুষত্ব) তা যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ‘ধর্ম’ বলতে - বস্তুজগতের প্রায় প্রতিটি জিনিসেরই কোন না কোন ‘ধর্ম’ বিদ্যমান যেমন- আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব বা পোড়ানো, জলের ধর্ম জলত্ব বা ভিজানো,পশুর ধর্ম পশুত্ব ইত্যাদি সে মতে মানুষেরও ধর্ম হচ্ছে- মনুষত্ব। আর এই মনুষত্ব বলতে বোঝায়- ন্যায়,পরোপকার,সহযোগীতা, সহমর্মীতা ইত্যাদি জাতীয় বিষয়। সে হিসাবে প্রত্যেক মানুষের ধর্ম হচ্ছে মনুষত্ব। আর এই ধর্ম (মনুষত্ব) প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রত্যেকটি ‘ধর্মতন্ত্র’ (হিন্দু,মুসলমান,বৌদ্ধ,ক্ষ্রীস্টান সহ আরো অনেক) তথা ‘রিলিজিয়ন’ এর উদ্ভব। আর এই ‘ধর্মতন্ত্র’গুলোকেই পরবর্তীতে শাসকরা কেবলমাত্র তাদের সুবিধার্থে ইচ্ছেমাফিক ব্যাবহার করে যা মানুষের প্রকৃত ধর্ম (মনুষত্ব) প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর এই শাসক শক্তিই মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
এ বিষয়ে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস্ বলেন - “ যে সব বহিঃশক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রন করে ‘রিলিজিয়ন’ হলো মানুষের মনে সেগুলোর উদ্ভট প্রতিচ্ছায়া”।
ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করাটা নৈরাজ্যবাদী,অতিবিপ্লবী ও শখের বিপ্লবীদের একান্ত শখের বিষয়।
কমিউনিস্টদের সংগ্রামটা তাই কখনই এই ‘প্রতিচ্ছবি’র বিরুদ্ধে নয় যে সব কারণে মানব মনে এই ‘প্রতিচ্ছবি’ গুলো জন্ম নেয় তার বিরুদ্ধে তথা নিয়ন্ত্রনকারী বহিঃশক্তি অর্থ্যাৎ শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। সমাজের শ্রেণী বৈষম্যের সুযোগ নিয়েই শাসক শ্রেণী বিভিন্নভাবে এই ধর্মতন্ত্রগুলোকে (হিন্দু,মুসলমান, বৌদ্ধ,ক্ষ্রীস্টান সহ আরো অনেক) তাদের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করে। কিন্তু সাধারণ মানুষতো ধর্মতন্ত্র গুলো বিশ্বাস করে প্রকৃত ধর্ম (মনুষত্ব) প্রতিষ্ঠার সিস্টেম হিসাবে।
সেই কারণ এ্যাঙ্গেলস মনে করতেন -“ শোষিত নিপিড়িত মানুষরা যখন শ্রেণী সংগ্রামের বিষয়টি বুঝতে শিখবে তখনি আর কোন ধরণের ‘উদ্ভট প্রতিচ্ছায়া’ তাদের প্রতাড়িত করতে পারবেনা। রিলিজিয়নের প্রকৃত মর্মার্থ ও তখন তারা উপলব্দি করতে পারবে।”
একদিকে যেমন কমিউনিস্টদের ধর্মবিরোধী বলা হয় আবার অন্যদিকে নিজেদের যার মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা বলে জোর গলায় প্রকাশ করেন তাদের অনেকেই কমিউনিস্টদের রিলিজিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করার জন্য দোষারুপ করেন। ড্যুরিং বলেছিলেন - ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজে রিলিজিয়ন নিষিদ্ধ হবে’। এ্যাঙ্গেলস এর কঠোর সমালোচনা করতে যেমন ছাড়েননি,তেমনি ভাববাদের কড়া সমালোচনা করতে ও ছাড়েন নি।
মহামতি লেনিনি বাস্তবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দিয়েছেন রিলিজিয়নের প্রতি সমাজতন্ত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে। রিলিজিয়নের অনুসারি হওয়াটাকে লেনিন কোন অপরাধ হিসাবে তো দেখন ই নি উপরন্তু অনুসারি শ্রমিকদের তিনি বিপুল সংখ্যায় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছেন এবং যারা শ্রমিকদের মধ্যে রিলিজিয়ন বিরোধী বাণী ছড়াতে চেয়েছেন এঙ্গেলস এর মতো লেনিন ও তাদের নিন্দিত ও ধিকৃত করেছেন। রিলিজিয়ন এর ধারকদের হাতে ‘মানুষের ধর্ম’ যাতে কোন অবস্থাতেই নির্জীত হতে না পারে সে ব্যাপারে লেনিন প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানীক সমাজতন্ত্র সদা সতর্ক থেকেছে ও ভবিষ্যত ও থাকবে।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে রিলিজিয়ন বিরোধীতার যে সব খবর ছড়ানো হয়েছে প্রকৃত পক্ষে তা প্রতিবিপ্লবের আবহ তৈরি করার জন্যই ছড়ানো এবং এই প্রতিবিপ্লবের আবহ ছড়ানোর কূটকৌশলকে দমন করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোকেই সাম্রজ্যবাদী তথ্য মাধ্যমগুলো রিলিজিয়ন বিরোধীতা বলে প্রচার করেছে বা করে থাকে। সমাজতন্ত্রীদের এই তথাকথিত ‘রিলিজিয়ন’ বিরোধীতা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে প্রতিবিপ্লবেরই বিরোধীতা।
রিলিজিয়ন এর বিরোধীতা করার বাস্তবীকতা প্রকৃতপক্ষেই সমাজতন্ত্রীদের নেই,কারণ ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার মতন এহেন কান্ডজ্ঞানহীন প্রবণতা কখনই বৈজ্ঞানীক সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করেন না করার কোন যৌক্তিকতাও দেখতে পান না।