somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখে এলাম তিনাপ সাইতার

১০ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সায়দাবাদ থেকে রাত ১০টায় গাড়ি ছাড়বে। রাতের খাওয়া শেষ করে সাড়ে আটটায় রওনা হলাম সায়দাবাদের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় নেমে দেখি মহা জ্যাম। কিছুদুর বাসে করে যাওয়ার পর বাধ্য হয়ে রিকসা নিলাম। বলা হয়েছিল সবাই যদি সাড়ে নয়টা নাগাদ চলে আসে তাহলে আমাদের বাস সাড়ে নয়টায় ছেড়ে দেয়া হবে। যখন আমি কমলাপুর ক্রস করছি তখনই বাজে সাড়ে নয়টা। আমি তো ভাবলাম আমি নির্ঘাত লেট। তাই বারবার রিকসাওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছিলাম জলদি যাওয়ার জন্য।

সায়দাবাদ যখন নামলাম তখন ঘড়ি বলছে নয়টা পয়তাল্লিশ। নেমে আবার পড়ে গেলাম বিরাট ধাধায়। হানিফ পরিবহনের কাউন্টার এর অভাব নেই। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে যেটায় যায় সে বলে না এটা ৫ নং কাউন্টার না, সামনে। সামনে সামনে করতে করতে কিছুসময় পর পেলাম ৫ নং কাউন্টার। সামনে তিনজন ব্যাকপ্যাকার দেখে বুঝলাম এরা আমাদের লোক। পরিচয় দিয়ে বুঝলাম ঠিক জায়গায় এসেছি। কিন্তু এ কি? আমাদের গ্রুপের এ্যাডমিনদের এখনও খোজ নেই। রাত বাজে ১০ টা।

প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় সবার লেটে পৌছলাম। গিয়ে দেখি না, অনেকেই আসেনি। কি আর করা যারা আছে তাদের সাথে পরিচয় হয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। আমি আসলে কোনকালেই গল্পবাজ না। আমি শোনার দলে। তারপরও যাচ্ছি তিনাপ সাইতার যা যা অন্যান্যদের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তাই নিয়ে অভিজ্ঞ ট্রাভেলারের ভান ধরে গল্প শুরু করলাম।

একজনকে বললাম এই পথে আছে সেই আকারের জোক। হাঠতে গেলেই গায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরবে। জোকের কথা শুনে তো অনেকে মনে মনে ভয় পেয়ে গেল। ভয় কাটানোর জন্য বললাম লবন যতক্ষণ আছে কোন সমস্যা নেই। অগত্যা আগাম সতর্কতা হিসেবে একজন তো ১কেজি লবনই কিনে ফেলল।



আসলে সেদিন বুধবার আর পরের তিন দিন ছুটি হওয়ায় সবারই বেড়াতে যাওয়া বা বাড়ি যাওয়ার ব্যস্ততা ছিল। তাই সেদিন বিকাল থেকে ঢাকা শহর একেবারে জ্যামে ব্লক। তাই সবার যেমন আসতে দেরি হয়েছিল তেমনি বাসেরও কোন খোজ পাচ্ছিলাম না। যেহেতু বাস আসেনি তাই সবাই যার যার মত ছোট ছোট গ্রুপে আড্ডা চলছিল।

আমাদের গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বাড়তে বাড়তে চব্বিশএ ঠেকেছিল। একজন বলেই ফেলল- পুরো পিকনিক পার্টি হয়ে গেছে। আসলে আমরা যাচ্ছিলাম বেশ কঠিন একটা রুটে ট্রেকিং করতে। আমার মনে হয় না তিনাপ সাইতার যাওয়া কোনমতেই বিগিইনার পর্যায়ে পড়ে না। কারণ ধারণার চেয়ে অনেক অনেক বেশী কঠিন ছিল রাস্তা। যদিও সহজ একটা দুই ঘন্টার ট্রেকিং এর নতুন পথ আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্ল্যান ছিল কঠিন রুটটা দিয়ে ঢুকে সহজটা দিয়ে ফিরে আসা। কারণ প্রথমে সবার স্ট্যামিনা ও মনের জোর ভাল থাকলেও শেষের দিকে তা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।

বাস ছাড়তে ছাড়তে রাত ১২টা বাজল। বাস ছাড়ার পর বুঝলাম ড্রাইভার কি জিনিস। সে একদম উল্কার গতিতে চলা শুরু করল। আর নতুন ফোর লেন ডিভাইডার দেয়া ঢাকা চিটাগাং রোড পেয়ে তাকে আর দেখে কে? কয়েকজন তো মাঝে মাঝেই ওয়ার্নিং দিচ্ছিল ড্রাইভার সাহেব আস্তে চালান। কে শুনে কার কথা? মনে হচ্ছিল অগনিত ডাইমেনশনে ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস সিনেমা দেখছি।

যাই হোক উল্কার গতিতে মাত্র সাত ঘন্টায় অর্থাৎ সকাল সাতটায় বান্দরবান শহরে পৌছলাম। সকালে সবাই প্রাকৃতিক কাজ কারবার শেষে নাস্তা করলাম। নাস্তার পর আবার তিন দিনের বাজার সদাই করা হলো। এসব সেরে যখন চান্দের গাড়িতে বসলাম তখন সকাল দশটা বেজে গেছে। রওনা হলাম রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে।



রোয়াংছড়ি বাজার ছাড়িয়ে আরও কিছুদুর পর্যন্ত চলল আমাদের গাড়ি। রোয়াংছড়ি পর্যন্ত পাকা রাস্তা ছিল। তারপর শুরু হল ইট বিছানো রাস্তা। মাঝে মাঝেই ভাঙ্গা রাস্তা পার হচ্ছিলাম, তখন গাড়ি এমন কাত হচ্ছিল যে মনে হল এই বুঝি গড়িয়ে শত শত ফিট নীচে পড়ে গেলাম।

কিছুক্ষণ উচু নিচু ভাঙ্গা রাস্তা পার করে থামলাম একটা পাহাড়ের গোড়ায়। গাইড দের জিজ্ঞেস করতেই বলল এটা হল বালুর পাহাড় (সম্ভবত)। এখান থেকেই মুলত আমাদের হন্ঠন শুরু। হন্ঠন যখন শুরু করলাম সূর্যি মামা তখন মাথার উপর। সেদিন রোদও উঠেছিল সেইরাম। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পিঠে ব্যাগ বোচকা ঝুলিয়ে চললাম রনিন পাড়ার উদ্দেশ্যে।



প্রথমেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠা শুরু করলাম। উঠছি তো উঠছিই। রোদে একেবারে চোখ ধাদিয়ে যাচ্ছিল। আর গা বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছিল। সবাই গামছা বের করে মাথাই দিয়ে গ্রামের বৌদের মত ঘুমটা দিয়ে হাটছিলাম।



কিছুদুর চলার পর একটা ছোট ঘর চোখে পড়ল। প্রায় আধা ঘন্টা চলার পর সেই ঘরের পাশে রাস্তার উপরই সবাই বসে পড়ল। ঘেমে নেয়ে অস্থির অবস্থা সবার। বসে কিছুক্ষণ জিড়িয়ে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলাম।

২৪ জনের সবাই কিন্তু একসাথে চলছিল না। সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে চলছিল। সবার পেছনে ছিল গাইড যারা দুইজন সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছিল। কারণ তারা আমাদের তিন দিনের খাবার জন্য এক খাচা মুরগী বহন করছিল। আমরা নিজেদের কাধে ঝোলান ব্যাগ নিয়ে যে অবস্থা হচ্ছিল সেখানে তারা বড় বড় দুটো খাচা নিয়ে কিভাবে চলছিল ভেবে মাথা নষ্ট হওয়ার যোগাড়।

এভাবে প্রতি আধঘন্টা বা তারও অনেক কম সময় পরপর থামছিলাম জিড়িয়ে নেয়ার জন্য। আর সেই সাথে অপরূপ প্রকৃতি দর্শন তো চলছিলই। মাঝে মধ্যেই এমন ল্যান্ডস্পেক চলে আসছিল যে থ হয়ে শুধু তাই দেখছিলাম।

চলতে চলতে দুপুর তিনটার দিকে আমরা কিয়াফলাং নামক পাড়া এসে পৌছাই। পাড়া বলতে চলার পথে কিছু বাড়ি আর একটা দোকান পেয়েছিলাম। দোকান পেয়ে তো সবার হাতে চাঁদ পাওয়ার মতই অবস্থা। কারণ দুপুর প্রায় শেষের দিকে। সবার পেটের ভিতর ছুচো দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছিল।



সবার কাছে অবশ্য টুকটাক হালকা খাবার ছিল। প্রত্যেক বিশ্রামের সময় সবাই তা দিয়ে শক্তির সঞ্চার করছিলেন। যা হোক দোকান পেয়ে আর সবার মতই আমরাও হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। দোকানে সেদ্ধ ডিম, পাউরুটি আর কলা দিয়ে লাঞ্চ শেষ করলাম। দোকান ছোট আর জনশূন্য এলাকায় হওয়ায় যোগান খুব বেশি ছিল না। তাই আমাদের টিমের যারা পরে এসে দোকানে পৌছেছিল তারা অনেকেই ডিমের খোসা চোখে দেখে আফসোস করেছে। কারণ ডিমের মজুদ আমরা অলরেডি শেষ করে দিয়েছিলাম।



খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার আমাদের হন্ঠন শুরু করলাম। যত দিন গড়াচ্ছিল ততই গরমের মাত্রা কমছিল। বিকেলের দিকে আমরা আরও একটি পাড়ায় এসে পৌছেলিলাম। পাড়ায় ঢোকার আগে ছোট একটা ঝিরি পেয়ে সবাই ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। পানি খুবই অল্প ছিল। কিন্তু ঝিরি বলে কথা, পানি ছিল সেই ঠান্ডা। নিমেষেই সবার ক্লান্তি দুর হয়ে গিয়েছিল।

ঝিরির পানিতে গড়াগড়ি খাওয়ার সময় স্থানীয় এক লোক আমাদের জিজ্ঞেস করল আমরা কোথায় যাব। আমরা বললাম রনিন পাড়া। তখন তিনি আমাদের জানালেন রনিন পাড়া এখনও অনেক দুর। তোমরা তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যাও কারণ দিনের আলো শেষ হয়ে আসছিল।



আমরা তার কথা শুনে আবার পথের পানে পা বাড়ালাম। শেষ বিকেলের দিকে আরও এক পাড়া পড়ল পথে। সেখানে একটা দোকান পেলাম। দোকান পেয়ে সবাই আবার যথারীতি চা চক্র শুরু করে দিল। চা বিস্কিট আর সাথে আড্ডা। তখন আবার বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু করেছিল। হাতে যেহেতু সময় ছিল না তাই সবাই সেই ফোটা ফোটা বৃষ্টির মধ্যেই রওনা দিলাম।



আমার ব্যাগে একটা ছোট ছাতা নিয়ে গিয়েছিলাম। জানি বর্ষার মওসুম বৃষ্টি তো হবেই। ছাতা মাথায় দিয়ে হাটা শুরু করলাম। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উপরে উঠছিলাম, তখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। ছোট ছাতাতে তাই বৃষ্টি মানছিল না। সন্ধা হওয়ার আগ মুহূর্ত ছিল তাই পথে জুম থেকে ফিরে আসা পাহাড়ি নারী পুরুষ চোখে পড়ল। তারা সবাই কাক ভেজা হয়ে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল।



কিছুদুর যাওয়ার পর বৃষ্টি থেমে গেল। বৃষ্টি শেষে সূর্য পশ্চিম আকাশে শেষ ঝিলিক দিয়ে দেখা দিল। পথে আমরা একটা জুম ঘর পেয়ে যায়। অনেকে পিছনে ছিল তাই আমরা ভাবলাম কিছুক্ষণ জুম ঘরে বসে প্রকৃতি উপভোগ করা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। সবাই জুম ঘরে গিয়ে বসলাম। ঘরের পাশে ছিল মাচাং এর মত খোল জায়গা। সেখানে বসে বসে আমরা অপরূপ প্রকৃতি দেখা শুরু করলাম। কি যে অপার্থিব লাগছিল সবকিছু তা লিখে বা বলে বুঝান সম্ভব নয়। অন্তত আমার পক্ষে।



আমাদের দলের মানুষদের দেখা পেয়ে আমরা জুম ঘর থেকে বের হলাম। বেরিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটছি তো হাঁটছি। পথ যেন শেষ হবার নাম নেই। এই পথ শেষ হবার দরকার কি? এ তো সেই পথ, যে পথে অনন্তকাল ধরে হাঁটা যায়।

একসময় প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল। আমরা সবাই এক জায়গায় পিছনের যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করলাম। ঠিক হল গাইডদের একজন টিমের সবার সামনে একজন থাকবে, অন্যজন একদম পিছনে থাকবে। আর যেহেতু সবার কাছে টর্চ নেই তাই একজন টর্চধারি বা টর্চধারিনীকে নেতা/নেত্রী বানিয়ে সামনে হাটতে বলা হল।



অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় একটু চিন্তা হতে লাগল আসলে আমরা কখন পৌছাব। গাইডদের জিজ্ঞেস করতেই তারা বলে আর ঘন্টা খানিক লাগবে। তাদের এই ঘন্টা যে কত লম্বা তা পরে বুঝেছিলাম।

রাস্তা একসময় সরু হয়ে আসল। সরু পথে আমরা হাঁটছিলাম। দুই পাশে জঙ্গল। সরু রাস্তা এক জায়গায় এসে দুদিকে চলে গেল। আমরা যেহেতু পথ চিনি না। আর গাইড আরও সামনে ছিল তাই আমরা দুই রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে পিছনের দলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্ধকার হওয়ার পর পর বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছিল। দুই রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে একটু আড্ডা চলছিল আর কতক্ষণে আমরা পৌছাবো সেই গবেষণা চলছিল। বৃষ্টি যেহেতু শুরু হয়েছিল এবং আমরা মোটামুটি জঙ্গল টাইপের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তাই সবাই একটু চেক করে নিলাম জোক ধরেছে কিনা।



কারও জোক লাগেনি। অবশ্য লাগলেও তা পাওয়া যায়নি। যাহোক পিছনের টিম আসার পর আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। বৃষ্টির বেগ ততক্ষণে বহুগুনে বেড়ে গিয়েছিল। কিছুদুর যাওয়ার পর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আমরা একটা চিলেকোঠা মত পেয়ে সেখানে সবাই দাড়ালাম। বৃষ্টি এত জোরে হচ্ছিল যে চিলেকোঠার চাল বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পারছিল না।



সবার একটু শীত শীত অনুভূত হতে লাগল। গাইডরা পাশের শুকনো কাঠ পেয়ে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। সেই আগুনকে মধ্যখানে রেখে সবাই গোল হয়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম বৃষ্টি কমার।



সন্ধা তখন সাড়ে সাতটার মত বেজে গিয়েছিল। গন্তব্য তখনও আসলে অনেক দুর ছিল। কিন্তু গাইডদের জিজ্ঞেস করতেই তারা বলছিল এই ঘন্টা খানিক লাগবে। বৃষ্টির থামার বা কমার লক্ষণ না দেখে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম রওনা হবার।

বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হলাম সেই চিলেকোঠা ছেড়ে। চিলেকোঠা পার হওয়ার পর নিচে নামা শুরু হল। সেটা আসলে আর রাস্তা ছিল না। খাড়াভাবে নিচে নামছিলাম বৃষ্টি কাদার মধ্যে। অন্ধকারে কোথায় পা দিচ্ছি তাও বোঝা যাচ্ছিল না। তাই কিছুক্ষণ পর পর কারো না কারো পা পিছলাচ্ছিল।



কারো পা পিচ্ছালে সাথে সাথে তার পিছনের বা সামনের জন্য তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করছিল। কারণ পায়ে চলা পাহাড়ী পথটা ভীষন খাড়া ছিল। একবার পড়লেই প্রথমে একেবারে নিচে তারপর সোজা উপরে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না যে পথ কতটা খাড়া ছিল। কিন্তু নামতে গিয়ে বুঝেছিলাম কি খাড়া আর ভয়ঙ্কর ছিল সেই পথটা।

শুকনো থাকতেই সেই পথ কঠিনতম পথের একটা। আর এই ঝুম বৃষ্টিতে যে কতটা কঠিন ছিল তা শুধু সে পথে যাদের পা পড়েছে তারাই জানে।



খুবই সাবধানে এবং ধীরে ধীরে নামতে হচ্ছিল। কেননা আছাড় খেলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিল বলে পাশের খাদ যে কত গভীর ছিল সেটা দেখা যাচ্ছিল না। অনেকেই অবশ্য আছাড় খাচ্ছিল, কিন্তু তার পিছনে বা সামনের জন্য তাকে ধরে ফেলছিল।



এভাবে খাড়া পথটা পার হতে প্রায় ঘন্টা খানেক লাগল। তারপর কিছুটা ভাল রাস্তা পাওয়া গেল। রাস্তা আসলে অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সন্ধার পর থেকে আমরা যে পথে ছিলাম সেটা ছিল আসলে শুধুমাত্র পায়ে হাঁটা পথ।

আবারও হাঁটছি তো হাঁটিছিই। বৃষ্টিতে ভিজে সবাই কাক ভেজা হয়ে গিয়েছিল। সবারই আছাড় খাওয়ার ধুম বয়ে যাচ্ছিল। তবে হাসাহাসি করার পাত্র বা পাত্রির বড় অভাব ছিল। আসলে সবাই গন্তব্যে পৌছানো নিয়ে সঙ্কায় ছিল বলে আমার ধারণা।

রাত তখন নয়টা বেজে গেছে। গাইডরা তখন সময়টা একটু কম করে বলা শুরু করল। তারা বলল আর মাত্র আধা ঘন্টা সময় লাগবে। শেষে এমন বিরক্ত হলাম যে কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করাই ছেড়ে দিলাম।



রাত দশটার সময় আমরা রনিন পাড়া আর্মি ক্যাম্পে পৌছলাম। আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে সবার এন্ট্রি করতে হবে। তাই আর্মিদের ছোট একটা ছাউনিতে গিয়ে সবাই আশ্রয় নিল। ক্যাম্পে গিয়ে ছোট ছোট আরও দুটো গ্রুপের সাথে দেখা হল।

আর্মিরা সবার নাম এবং ঠিকানা লিখতে বলল। এবং তারা বারবার বলছিল আমরা এত ভিতরে কেন এসেছি। তারপর আবার এত রাতে কেন এসে পৌছলাম? যদি কিছু হয়ে যেত? আর্মির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আসলেন সবার শেষে যখন সাবার নাম ধাম এন্ট্রি করা শেষ হয়েছে।

তিনি বেশ ঠান্ডা মেজাজের ভাল মানুষ মনে হল। মিলিটারি মেজাজ বলে যেটা থাকে সেটা তার ছিল না বলে মনে হল। অথবা সেটা থাকলেও আমাদের দেখাননি। তিনি অবশ্য বলছিলেন এখানে আসা আমাদের মোটেই উচিত হয়নি। তারপর আবার সাথে রয়েছে মেয়েরা।

তিনি অবশ্য খুব সুন্দর শান্তভাবে বুঝাচ্ছিলেন কেন আমাদের আসা উচিত হয়নি। তিনি বললেন এদিকে কোন রিসোর্ট বা থাকার কোন ভাল ব্যবস্থা নেই। তাই এদিকে এসে থাকাটা খুবই জটিল একটা সমস্যা। আমরা অবশ্য প্ল্যান করেই এসেছিলাম যে আমরা আদিবাসীদের বাড়িতেই থাকব এবং তাদের সাথে সেভাবেই কথা হয়েছিল। তিনি আমাদেরকে পাড়াতে থাকতে হবে এবং কোনরকম রিপোর্ট না করে কোথাও যাওয়া যাবে না এরকম আরও অনেক ওয়ানিং শুনিয়ে বিদেয় হলেন।



আমরা তো ভাবছিলাম আর্মি ক্যাম্প তো এসেই পড়েছি পাড়া নিশ্চয় পাঁচ মিনিটের পথ হবে। গাইডরা বললও তাই। কিন্তু পাক্কা আধা ঘন্টা লাগল আর্মি ক্যাম্প থেকে রনিন পাড়া পৌছাতে। পাড়াটা একেবারে শুনশান ছিল। কারণ তাদের কাছে তখন গভীর রাত। রাত এগারটা আসলেই পাহাড়ে গভীর রাত। পাড়াটা বেশ বড় পাড়া ছিল।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য এত ক্লান্ত ছিলাম যে, বলার মত না। তাই পাড়াতে এসেও হন্ঠন শেষ হচ্ছিল না। পাড়ার একেবারে শেষ বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। পাড়াতে পৌছে সবাই ফ্রেশ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল খাবারের। খাবার হতে আরও সময় লাগল। ক্লান্ত থাকায় খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চলে গেল। আমরা ৬জন এক বাড়িতে ছিলাম। নিচে কাঠের মেঝেতে সরাসরি শুয়ে পড়া। কথায় বলে ক্ষুধা চেনেনা পান্তা ভাত আর ঘুমে চেনেনা ভাঙ্গা খাট। সবাই শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম।



সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে বের হতেই এক অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ল। কিছু দুরের টেবিল পাহাড়কে চারপাশ থেকে মেঘ ঘিরে ধরেছে। সত্যিই অপরূপ লাগছিল। সবাই ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবার খেয়ে নিলাম। প্ল্যান ছিল আজকে রনিন পাড়ার কাছাকাছি অন্য দুটো ঝর্না দেখা।

সকালে খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা রওনা হলাম মং সং সাইতার দেখতে। প্রায় ১ ঘন্টার পাহাড়ি চড়াই উতরাই পার হয়ে গেলাম মং সং সাইতার ঝর্না দেখতে। মং সং সাইতার পৌছানোর শেষ পথটুকু ছিল পুরা নব্বই ডিগ্রি খাড়া। নিচে যখন নামছিলাম তখন পা ফেলার সুবিধাজনক কোন জায়গা ছিল না। গাইড তখন তার সাথের দা দিয়ে ছোট ছোট ধাপ কেটে দিচ্ছিল। আমরা সেখানে পা দিয়ে নামছিলাম।
অনেকে পথের এই খাড়াই দেখে আর শেষ পর্যন্ত নীচে নামেনি। উপরে দাড়িয়ে থেকেছিল। নীচে নামার পর রূপসী ঝর্না তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানাল। আমরাও তার সৌন্দর্যে গা ভাসিয়ে দিলাম। ঝর্নার পানি বেশ উচু থেকেই পড়ছিল তাই কাছে যেতেই পানি পড়ার শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম হল।



পানির সাথে বিভিন্ন পোজে অনেকক্ষণ সবাই ফটোশুট করল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছিল তাই আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। এবার সেই খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে হবে। পেছন থেকে এক বড়ভাই বললেন উপরে উঠার সময় নিচে না তাকাতে। আমার আবার উচু থেকে নিচে তাকালে মাথা ঘোরার মত হয়।

এ পাহাড় সে পাহাড় পার হয়ে আমরা পাড়ার দিকে চলতে লাগলাম। আমরা তিনজন একসাথে হাটছিলাম। আমাদের সাথে গাইড ছিল। সে পথের পাশের জুম থেকে সুস্বাদু শসা এনে দিল খাওয়ার জন্য। আমরা শসা চিবুতে চিবুতে সামনে আগাতে লাগলাম। পাড়ায় এসে একটা ছাউনি মত জায়গা পেয়ে বসে পড়ালাম, অনেকক্ষণ হাঁটার ক্লান্তি দুর করতে।



ছাউনিতে বসে পায়ের দিকে খেয়াল হতেই দেখলাম রক্তে ভেসে গেছে। বেশ খানিক রক্ত পায়ে লেগে আছে। এর মানে হচ্ছে জোক লেগে রক্ত খেয়ে আবার কখন পড়ে গেছে খেয়াল করিনি।

পাড়ার এক জায়গায় একটা পানির চৌবাচ্চা ছিল। সেখানে গিয়ে দেখি পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা গোসল করছে। যেহেতু মহিলারাও ছিল তাই আমরা একটু দুরে অপেক্ষা করতে লাগলাম তাদের গোসল শেষ হওয়ার জন্য। মহিলারা চলে গেলে আমরা গেলাম গোসল করতে।
আমরা বাঙ্গালিরা আসলে একটু বেশি সংকোচ মনের। কারণ আমরা গোসল করার সময়ও দেখলাম অন্য মহিলারা এসে যার যার মত আমাদের পাশে দাড়িয়ে গোসল করছে।



যাহোক গোসল সেরে খাওয়া দাওয়া করতে গেলাম। সকালে এক জায়গায় আছাড় খেয়ে পায়ে হালকা ব্যাথা পেয়েছিলাম। তাই বিকেল বেলায় দ্বিতীয় ঝর্না আর দেখতে গেলাম না। অন্যান্য অনেকে গেল আবার অনেকে থেকে গেল আগামীকালকের চ্যালেঞ্জের জন্য শক্তি ধরে রাখতে।

বিকেলে একটা ভাত ঘুম মত দিলাম। ঘুম দিয়ে বের হলাম পাড়া বেড়াতে। পকেটে করে নিলাম চকলেট। পাড়ায় যত বাচ্চাকাচ্চা সামনে পেলাম সবাইকে চকলেট দিলাম। চকলেট পেয়ে সবাই তো মহা খুশি। সামান্য চকলেটে তাদের সেই আনন্দ আসলে দেখার মত।

আমি আর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলে দুজন মিলে পাড়া বেড়াতে বের হয়েছিলাম। পাড়া বেড়াতে বেড়াতে আমরা পাড়ার শেষ মাথায় চলে আসলাম। পরে ভাবলাম আর্মি ক্যাম্পের দিকে যাই না কেন? আর্মি ক্যাম্পের রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলাম। পাড়া শেষে জঙ্গলের মত রাস্তা ধরে হাঠছিলাম। ততক্ষনে সন্ধা হয়ে গেছে। সেই সময় আমরা পার হচ্ছিলাম রনিন পাড়ার কবরস্থান। কবরস্থান পার হয়ে আরও কিছুদুর গেলাম। জায়গাটা এত নির্জন আর নিরিবিলি ছিল যে কি বলব। নিজেদের স্বাভাবিক কথা বার্তা অনেক জোরে শোনা যাচ্ছিল।

অন্ধকার প্রায় হয়ে আসছিল। আমাদের কারও কাছে টর্চ লাইট ছিল না। আর্মি ক্যাম্প আর কত দুরে আমরা ঠিকমত জানিওনা। কারণ গতরাতে আমরা অন্ধকারে গাইডদের পিছু পিছু এসেছিলাম। অন্ধকারে রাস্তা চিনে নেয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে যাওয়ার। অন্ধকার হয়ে গেলে আর পাড়ায় পৌছতে পারব না। মোবাইলে আবার নেটওয়ার্কও নেই।



ফিরতে ফিরতে অন্ধকারই হয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যেই পার হচ্ছিলাম কবরস্থান। ভার্সিটি পড়ুয়া ছোট ভাইকে বললাম ভয় পাচ্ছে কি না? সে বলল না। খুবই গা ছমছমে পরিবেশ ছিল। তারপরও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে সামনে আগাচ্ছিলাম। শেষটায় তো মোবাইলের টর্চ দিয়ে আলো জ্বেলে আসতে হয়েছিল।

যাহোক সন্ধার কিছূ পর পাড়াতে এসে পৌছলাম। দেখলাম ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। বাচ্চারা পড়াশুনা করছে সোলার পাওয়ারের বাতির আলোয়। পাড়ার মধ্যে কিছু দোকান ছিল। একটা চা’র দোকান পেয়ে ঢুকে পড়লাম। সন্ধার সময় গরম গরম চা খেতে।

চা এর দোকানে গিয়ে আমাদের দলের আরও কিছু সদস্যকে চোখে পড়ল। সবাই একসাথে চা খেতে লাগলাম আর গল্প শুরু করে দিলাম। চা’র দোকানে গিয়ে বুঝলাম আমরা ছাড়াও আরও কিছু দল এসেছে এ পাড়ায়। কোন গ্রুপ তিনাপ যাবে আবার কোন গ্রুপ সিপ্পি আরসুয়াং সামিট করতে যাবে।

দোকানে আমাদের সাথে সাথে পাহাড়িরাও ছিল। আমাদের গাইডকেও দেখলাম একসময়। সে আমাদের তার ক্যামেরায় থাকা বিভিন্ন ঝর্নার ছবি আর ভিডিও দেখাচ্ছিল। আর সেসবের গল্প করছিল।



সবাই চা’র দোকানে গিয়ে দুধ চা খেয়েছিলাম। দুধ চা খাওয়ার পরে হঠাৎ মাথায় প্রশ্ন আসল এই দুধ কিসের দুধ। পাড়ায় কোন ছাগল বা গরু চোখে পড়েনি। চোখে যা পড়েছিল তা হল শুকর। দোকানী বা গাইড কাউকেই প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না কিসের দুধ। পাছে আবার তারা মাইন্ড করে অথবা যদি শুকরের দুধও হয় তবে তা তো খাওয়া হয়েই গেছে। জিজ্ঞেস করে আর কি লাভ। তাই মনে মনে সান্তনা দিলাম না জানাই ভাল কিসের দুধ।

চা খাওয়া শেষে যে বাড়িতে আমাদের ঠাই হয়েছিল সেদিকে রওনা দিলাম। পথে একটা গির্জা পড়েছিল। তখন সেখানে দেখলাম কি যেন অনুষ্ঠান চলছে। ভিতর থেকে ঢোল আর গানের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ভিতরে আর গেলাম না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বলে কথা এখানে মাইন্ড করার সুযোগ কম। তাই তা এড়িয়ে বাড়ির পানে হাটা দিলাম।



বাড়িতে এসে অন্য সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিলাম। সারাদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিল সবাই। কোথায় কি দেখেছে? কোনটা কেমন ছিল? কার কটা জোক লেগেছিল? এইসব। হাসি আর আড্ডা শেষে খাবার সময় হল। সবাই খেতে গেলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বলল। কেননা আগামী কাল আমাদের অনেক হাটতে হবে এবং তা খুব সকালে উঠেই শুরু করতে হবে। গ্রুপ লিডার আমাদের বলল আমরা অন্ধকার থাকতে থাকতেই রওনা হব।

পরদিন ভোর পাঁচটায় এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। এলার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে আমরা গোছানো শুরু করে দিলাম। গোছগাছের এক পর্যায় আমাদের একজন অন্য যে বাড়িতে আমাদের গ্রুপ লিডার রা ছিল তাদের কি অবস্থা অর্থাৎ গোছানোর কত দুর তা দেখতে পাঠালাম। ফিরে এসে জানাল সবাই তখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। অনেক ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

আমরা তাই গোছানো শেষ করে সকালের আলো ফোটার অপেক্ষা করতে লাগলাম আর সেই সাথে তাদের জন্যও যারা ও পাশে নাক ডাকছিলেন।

সকালের আলো ফোটার কিছু পরে আবার গেলাম তাদের কি অবস্থা দেখতে। গিয়ে দেখি সবাই তুমুল ব্যস্ত গোছানো নিয়ে। আকাশের অবস্থা ভাল না। সকাল থেকেই মুখ গোমড়া করে আছে। না জানি কখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি চলে আসে। আশঙ্কা সত্যি হল কিছুক্ষণ পরেই। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল।



সবাই এমনিতেই দেরী করে উঠেছে। তাই বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের রওনা হতে হল। পাড়া ছেড়ে বের হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অবশ্য বৃষ্টি চলে গেল।

বৃষ্টিতে মাটির পথ খুবই পিচ্ছিল ছিল। পাড়া পার হতেই আমরা ওপরের দিকে উঠছিলাম। এভাবে কিছুদুর ওঠার পর দেখলাম কুয়াশার মত অবস্থা। দশ হাত দুরের সামনের মানুষকে আর দেখা যাচ্ছে না। পরে বুঝলাম আসলে ওটা কুয়াশা ছিল না। ওটা ছিল মেঘ।

বেশ চড়াই উৎরাই পার হয়ে এক সময় একটা পাড়া চোখে পড়ল। খুবই ছোট পাড়া। গোটা পাচেক বাড়ি হবে। ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যায় এই দুর্গম এলাকায় এরা কিভাবে থাকে।

পিছনে অন্য সবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম পাড়াতে বসে বসে। আসলে শুধু অপেক্ষা না সেই সাথে বিশ্রাম নেয়া হচ্ছিল। আবার শুধু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম না। সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল সিপ্পি আরসুয়াং। তারই সৌন্দর্য উপভোগ করা হচ্ছিল আর সেই সাথে ফটো খিচাখিচি। ও হ্যাঁ পাড়ার নাম দেবছড়া।



ফটোসেশন আর বিশ্রাম শেষে আমরা আবার রওনা হলাম। পাড়ার পর শুরু হল ছড়া। এবার আমাদের ছড়ার রাস্তা ধরে সামনে যেতে হবে। আসলে রাস্তা বা পথ যাই বলুন না কেন সেটা হল পাহাড়ি ছড়ার ভিতর দিয়ে। কোথাও হাটু সমান পানি আবার কোথাও পায়ের পাতা সমান। আর কি খরস্রোতা সেই পিচকি ছড়া।

এদিক ওদিক বেকে চলেছে পাহাড়ি ছড়া। আমরাও তার সাথে সাথে এঁকে বেকে চলছি। নুড়ি পাথর ভেঙ্গে চলছিল আমাদের চলা। কোথাও কোথাও পাথর খু্বই পিচ্ছিল ছিল। এক জায়গার রাস্তা খুবই সরু হয়ে গিয়েছিল। দুই পাশে পাথরের দেয়াল। খুবই আফসোস হচ্ছিল কেন আমার একটা এ্যাকশান ক্যামেরা নেই। তাহলে পুরো পথটা আমি ভিডিও করে নিয়ে আসতাম।

পথটা কিরকম ছিল তা আসলে ভিডিও দেখে কিছুটা আচ করা সম্ভব। চলতে চলতে এমন জায়গায় এসে পৌছলাম যেখানে পানি বুক সমান। তারপরও যদি সেটা সমান বা এককথায় সহজ রাস্তা হত তাহলে এক ব্যাপার ছিল। পানির তোড়ে ভারসাম্য রাখাই দুরূহ হচ্ছিল।
সবার পিঠেই ছিল ব্যাগ। কিছুতেই ব্যাগ ভিজানো যাবে না। তাই সবাই গাইডদের কাছে ব্যাগ দিয়ে দিলাম। তারা কোনরকমে ব্যাগ নিয়ে পড়ি মরি করে পার হল। সেই সাথে আমরাও অনেক কষ্টে পাথরে আঘাত পাওয়া থেকে বেঁচে কোনরকমে পার হলাম। আমাদের সাথে যে সব মেয়েরা ছিল তারাও কেউ কেউ গাইডের কাধে ভর দিয়ে পার হল।



এইরকম হ্যাপার জায়গা পার হয়েই সামনে দেখি বিশাল সাইজের গয়াল পথরোধ করে আছে। আমাদের সাথে এক ভাই গয়াল দেখে গান শুরু করে দিল “গয়াল তোমারও লাগিয়া যোগিনী সাজিব”। আরও ছিল “গয়াল বাবা কলা খাবা” টাইপের গান।

যাইহোক গয়াল ময়াল সরিয়ে কত পথ মাড়িয়ে সামনে দিকে আগালাম। ছড়া শেষ হতেই আবার উপরে উঠা শুরু হল। উঠছি তো উঠছিই। উঠতে উঠতে আবার নিচে নামা শুরু হল। নিচে নামবি তো নাম একেবারে খাড়া। উঁচু থেকে নিচে পাইন্দু খাল দেখা যাচ্ছিল। সেটা অনেক নিচে। পথ এতটা খাড়া ছিল যে বাঁশের লাঠি দিয়ে ভর দিয়ে দিয়ে খুবই সাবধানে নামতে হচ্ছিল। সেই সাথে ধুম ধাম আছাড় খাওয়া চলছিল।

নিচের দিকে নামার সময় একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। সেটা হল কোন প্রকারেই গতি বাড়ানো যাবে না। গতি নিয়ন্ত্রণে রেখে সামনে আগাতে হবে।

নিচে নামতে প্রায় ঘন্টা পার হয়ে গেল। নিচে নামতেই সামনে বাধা হয়ে দাড়াল পাইন্দু খাল। চওড়া খুব বেশি না, কিন্তু পানিতে এত স্রোত ছিল যে কল্পনার বাইরে। এই স্রোতের ব্যাপারে অবশ্য পাড়াতে থাকতেই এক আদিবাসী আমাদের সতর্ক করেছিল। অনেকক্ষণ ধরে গবেষণা করা হলো কিভাবে পার হওয়া যাবে এই পাইন্দু। পানি ছিল কোমরের নিচে। গাইডরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল সেটা তারা একা একা পার হবার। কিন্তু ব্যর্থ হল।

এ পাশে একটা বাঁশ ছিল সেটা দিয়ে কোন রকম পড়ি মরি করে একজন গাইড পার হল। সে ওপারে গিয়ে বড় সাইজের একটা বাঁশ কেটে আনল। সেই বাঁশ ওপারে থেকে এপারে আড়াআড়ি রাখা হল। ওপারে ধরে থাকল একজন গাইড এপারে ধরে থাকল অন্য গাইড। এবার সেই বাঁশ ধরে ধরে একজন একজন করে পার হওয়ার সিন্ধান্ত নেয়া হল।

অতি আগ্রহী কিছু কিছু আগে আগে বেশ ভালভাবেই চলে গেল। একজনের তো পা থেকে স্রোতের তোড়ে জুতা মোজা সহ খুলে স্রোতে ভেসে গেল। ছেলেরা মোটামুটি পার হয়ে গেল এভাবেই সবাই। এবার পালা দলের মেয়েদের। তাদের কে এক গাইড কাধে করে ঝুলিয়ে নিয়ে পার করল।



এই খাল পার হওয়া বিষয়টা বেশ ভাল ছিল। আসলে সেখানে সবাই মিলেমিশে একজন অন্যজনকে উৎসাহ দিয়ে ভয় কাটানোর ব্যাপার টা খুবই ভাল ছিল। যাই হোক অনেক কষ্টে পাইন্দু খাল পার হলাম।

পাইন্দু খাল পার হবার কিছু পরে আবারও সামনে পাইন্দু খাল পড়ল। কিন্তু এদিকটায় ওরাকম স্রোত নেই। তাই অনায়াসে সেটা পার হওয় গেল। আসলে পার হয়ে আর অন্য দিকে গেলাম না। এবার আমরা পাইন্দু ধরে এগোতে লাগলাম। একবার এপারতো আরএকবার ওপার দিয়ে যাচ্ছি।

তিনাপ সাইতার বা তিনাপ ঝর্নাটা আসলেই হল পাইন্দু খাল। যে জায়গাটায় তিনাপ অবস্থিত সেখানে এই পাইন্দু খালেরই পানি অনেক উপর থেকে নিচে পড়ছে।

খাল ধরে হাটতে হাটতে দুপুর প্রায় ২টা নাগাত আমারা আমাদের কাঙ্খিত তিনাপের দেখা পেলাম। বিশাল বড় বড় পাথর পড়ে আছে তিনাপের পথে।

তিনাপের পানি যেখানে পড়ছে সেখানে কাছাকাছি যাওয়া খুবই ঝুঁকি পূর্ণ। এক হচ্ছে পানির পরিমান দুই হচ্ছে এর উচ্চতা। এত উপর থেকে পানি পড়ছে যে পানির পরিমান কম হলেও তা বিপদজনক। কারণ সেই পানির নিচে দাড়ালে উপর থেকে পানি পড়ছে না পাথর পড়ছে আলাদা করে বোঝা যাবে না, তার আগেই ওপার।

তবে তিনাপের নিচে একটু ভিতরের দিকে গুহার মত আছে সেখানে যাওয়া যায় এবং ঝর্নার পরস পাওয়া যায়। আমরা ইচ্ছামত জলকেলি আর ফটো তুলে নিলাম। অবশ্য যাদের ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা ছিল তাদেরই বেশী সুবিধা হয়েছে।



বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। প্রথমে আমি ভাবলাম যে আমরা যে পথে এসেছি অনেকটা সে পথে গিয়ে হয়ত অন্য কোথাও থেকে ফেরার রাস্তা হবে। কিন্তু দেখলাম আমার ধারণা ভুল। ঝর্নার পানি উপরে যেখান থেকে পড়ছে সেখানেই বেয়ে উঠতে হবে।

তিনাপের পাশ দিয়ে খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগলাম। কিছুক্ষণ উঠার পর দেখলাম সবাই লাইনে দাড়িয়ে পড়েছে। কেননা পুরো খাড়া পাথরের দেয়াল বেয়ে উঠতে হবে। সেখানে পাথরে খাজকাটা খাজকাটা রয়েছে। আর আছে গাছের লতা। সেই সাথে বাঁশ লম্বা লম্বি ভাবে রাখা হয়েছে যাতে করে বাঁশ ধরে ধরে উপরে উঠা যায়।

বেশ কসরত আর বুকের ভিতর ধুকধুকানি নিয়ে উঠা শুরু করলাম। প্রথমে ভেবেই পাচ্ছিলাম না আসলেই উঠতে পারব কি না। পরে অবশ্য উঠে পড়লাম। একবারও নিচে তাকায়নি। কারণ উচ্চতা ভীতি আছে কিছুটা। তাই সংকল্প করেছিলাম যে বাঁশ বেয়ে উঠার সময় নিচে তাকাব না।

উপরে উঠে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কি জায়গা পার হলাম তার কথা চিন্তা করতে লাগলাম। নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এটা আমি পার হতে পারব। পরে আবার এটাও চিন্তা করছিলাম এই জায়গায় আমাদের দলের মেয়েরা কিভাবে পার হবে।

সব আশঙ্কা দুর হল যখন দেখলাম একে একে সবাই উতরে গেল এই ভয়ানক জায়গা থেকে। আবার আমরা পাইন্দু খাল বেয়ে চলা শুরু করলাম। খাল বেয়ে চলতে চলতে একটা গ্রুপের সাথে দেখা হয়ে গেল। তারা তিনাপ যাচ্ছিল। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলাম আতাপাড়া আর কত দুর? তারাও আমাদের জিজ্ঞেস করল- তিনাপ কত দুর?



আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আতাপাড়া পৌছানো। আতাপাড়া পৌছালে সেখান থেকে জীপে প্রথমে রুমা তারপর রুমা থেকে বান্দরবান শহর।
আতাপাড়া যাওয়ার পথে আমরা শুধু উপরে উঠছিলাম তো উপরেই উঠছিলাম। উপরে উঠা আসলে খুবই কষ্টকর। মাঝে মাঝেই সহ্যরা সীমা অতিক্রম করতে চাইছিল। কিছু কিছু চলার পথ তো ছিল খুবই সরু আর একদম পাহাড়ের কিনার দিয়ে। কোনরকমে পা পিছলালেই প্রথমে একদম নীচে পরে সোজা উপরে।

পাহাড় বেয়ে উঠছিতো উঠছি। দর দর করে ঘাম হতে লাগল। ক্লান্তিরা শরীরকে শুইয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু থামছি না একদমই। কারণ আমাদের সাথে থাকা এক প্রকৃতি প্রেমী ডাক্তার আঙ্কল ছিলেন। তিনি বললেন, এই সমস্ত বুনো ঝোপের মধ্যে ম্যালেরিয়া বাহী মশারা থাকে।

শেষ বিকেলের দিকে আর্মি ক্যাম্প চোখে পড়ল। লেখা ছিল আতাপাড়া আর্মি ক্যাম্প। ক্যাম্পের অদুরেই আতাপাড়া। আতাপাড়া পৌছেই আমরা হাত পা ধুয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর সেখানে একটা দোকান ছিল। সেই দোকানে সবাই হামলে পড়লাম। যা ছিল গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। কারণ সারাদিন প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি।



সবার খাওয়া দাওয়া শেষে সন্ধার সময় আমাদের জীপ এসে হাজির হল। দুইটা জীপে করে আমরা রওনা হলাম বান্দরবান সদর পানে। রুমা পার হবার পর পিছনের গাড়ি টা আর চোখে পড়ছিল না। আমরা বেশ আগেই বান্দরবান শহরে পৌছলাম।

কিন্তু পেছনের গাড়ির কোন খোজ পেলাম না। বান্দরবান থেকে আমাদের গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল রাত ১০টায়। দশটা প্রায় বেজে যাচ্ছিল কিন্তু গাড়ির কোন খোজ পাচ্ছিলাম না। পরে একটা ফোন পেয়ে জানতে পারলাম পথে পেছনের জীপটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখন ঠিক করা হয়েছে কিন্ত তারা তখনও রুমাতে ছিল। তাই আমরা গাড়ির ড্রাইভার সুপারভাইজার আর গাড়িতে থাকা অন্যান্য যাত্রীদের অনুরোধ করলাম এক ঘন্টা দেরী করতে। তারা রাজি হল সহজেই। এর মধ্যে আমরা রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ফেললাম।

বান্দরবানে এই নিয়ে তিনবার আসা হল। যতবারই আসি এর রূপ দেখে মুগ্ধ হই। অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের ভ্রমণের কথা বেশী মনে থাকবে। এত এক্সট্রিম ট্রেকে আগে কখনও আসা হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×