খুব ভোরে টের পেলাম। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে রেডি হয়ে বাইরে বের হলাম। পাশে এক হোটেলে সকালের নাস্তা খেলাম। পরাটা আর ডালভাজি দিয়ে। নাস্তা সেরে ম্যাপ দেখে হাটা শুরু করলাম। টার্গেট ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যাওয়া। একটু দুরই ছিল। কিন্তু সকাল বেলা হওয়ায় আর আকাশ মেঘলা হওয়া হাটা শুরু করলাম।
সক্কাল সক্কাল হাটতে বেরিয়ে ছোট রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠতেই একটা ট্রাফিক সিগনাল লক্ষ করলাম। সেখানে দেখি একটা গাড়ি লাল সিগন্যালে দাড়িয়ে আছে। দেখে বেশ ভাল লাগল। পুরো ফাকা রাস্তায় কোন ট্রাফিক নেই, অন্য কোন গাড়িও নেই তারপরও গাড়িটা লাল বাতি দেখে দাড়িয়ে আছে।
সেদিন সকালটা বেশিই ফাকা ছিল মনে হল। তার কারণ সেদিন ছিল রবিবার। ওদের সাম্পাহিক ছুটির দিন। পাশে ময়দান কে রেখে হাটছিলাম। হাটতে হাটতে সম্ভবত ইলিয়ড পার্ক পড়ল। ভিতরে লোকজন সকালে জগিং করতে এসেছে। রাস্তা দিয়েও লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছিল।
কিছুদুর যেতেই বৃষ্টি শুরু হল। হালকা হালকা বৃষ্টি তাই কোথাও দাড়াচ্ছিলাম না। আর কিছুদুর যাওয়ার পর বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেল। ভাবলাম বেড়াতে এসে এভাবে জামাকাপড় ভিজিয়ে শুধু শুধু ব্যাগের আকার বড় করে লাভ নেই। তাই একটা যাত্রী ছাউনি দেখে দৌড় লাগালাম। নিরিবিলি যাত্রী ছাউনিতে বসে বসে কোলকাতার বৃষ্টি দেখতে লাগলাম।
আমি যেখানেই যাই সেখানকার সাথে আমার দেশের বা এলাকার পার্থক্য খোজার চেষ্টা করি। কোলকাতা গিয়ে খুব বেশি পার্থক্য লক্ষণীয় হল না। তবে, কোলকাতায় সবুজের পরিমান অনেক বেশী মনে হয়েছে আমাদের ঢাকা শহরের থেকে। আর একটা জিনিষ সেটা হল পুরান বাড়িঘরের সংখ্যাও বেশি। ভবনগুলো পুরান হলেও সেগুলোর সৌন্দর্য এখনও দৃশ্যমান। বৃটিশ ধাচের ভবনগুলো দেখতে বেশ সুন্দরই লাগে।
বৃষ্টি একটু থামতেই আবার হন্ঠন শুরু করে দিলাম। সকাল বেলা মেঘলা আকাশে কম আলোয় হাটতে বেশ লাগছিল। মোবাইলে জিপিএস দেখে দেখে হাটছিলাম অবশ্য। ম্যাপে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল লক্ষ্য করে হাটছিলাম। একবার ভুল রোডে চলে গেলাম, পরে আবার ফিরে এসে সঠিক রাস্তা ধরলাম।
হাটতে হাটতে এমন জায়গায় আসলাম যার একপাশে বিশাল মাঠ অপরদিকে পার্ক। ফলে বৃষ্টি থেকে বাঁচার কোন ছাউনি চোখে পড়ল না। বৃষ্টি আবার শুরু হতেই জোরে হাটতে লাগলাম ছাউনির খোজে। দেখলাম যেই পাশটাই মাঠ (ওরা যেটাকে ময়দান বলে সম্ভবত) সেই পাশে বড় পলিথিনের ছাউনি বানিয়ে টম দোকান বসেছে।
এরাকমই একটা টম দোকানে আশ্রয় নিলাম। আরও অনেকে ছিল সেখানে। দুজন বয়স্ক লোক ছিল যারা সকালে হাটতে বেরিয়েছিল এবং বৃষ্টির জন্য টম দোকানে বসে বসে চা খাচ্ছিল আর পুরান দিনের জম্পেশ গল্প করছিল। আরও ছিল মাঠে খেলতে আসা তরুন সম্প্রদায়।
বৃষ্টিতে বসে মাটির ভাড়ের চা খেতে লাগলাম আর বৃষ্টির মধ্যে ছেলেরা ফুটবল খেলছিল তাই দেখছিলাম। বৃষ্টির পরিমান বাড়তেই থাকল। থামার কোন লক্ষণ দেখলাম না। একটু দুরেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখা যাচ্ছিল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চেয়ে এই বৃষ্টি ভেজা সকাল দেখতেই বেশি ভাল লাগছিল।
বেশ অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। গত সন্ধায় ছাতা না কিনে কি যে ভুল করেছিলাম তা হাড়ে হাড়ে না মজ্জায় মজ্জায় টের পেলাম। ভাবলাম আগে এখন ছাতা কিনতে হবে। ছাতা ছাড়া কোন গতি নেই এই বৃষ্টিতে।
একটা বাস আসতে দেখে উঠে পড়লাম। বাসে করে আবার নিউ মার্কেট ফেরত গেলাম। বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হতেই বেশ খানিকটা ভিজে গেলাম। ছাতার দোকান খুজতে শুরু করলাম। ঘুরে ঘুরে একটা দোকান পেলাম কিন্তু দাম বেশি চাইল। অন্য দোকান খুজতে লাগলাম কিন্তু আর কোন দোকান পাচ্ছিলাম না। কারণ রবিবার হওয়ায় অনেক দোকান সকালে বন্ধ ছিল।
প্রথমে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্কিপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির অবস্থা দেখে পুরো কোলকাতা স্কিপ করার সিদ্ধান্ত নিই। ছাতা কিনতে বেশ ঘোরাঘুরি করে না পেয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম কারণ ১২ টা বাজতে চলেছে। ১২টার সময় হোটেল ছাড়তে হয়। দেরি হলে আবার পরের দিনের জন্য ভাড়া গুনতে হবে। আমার ট্রেন ছিল ৪:৫৫ টা সময়। ১২টার সময় হোটেল ছেড়ে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
পথে একটা ছাতার দোকান পেয়ে দেড়শ টাকায় থ্রি ফোল্ডের একটা ছাতা কিনে নিলাম। সাথে একটা প্লাষ্টিকের স্যান্ডেল ও নিলাম কারণ বৃষ্টিতে জুতার অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। প্লাষ্টিকের স্যান্ডেল পরে জুতা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেখি ব্যাগের ওজন পাঁচ কেজি বেড়ে গেছে। আশে পাশের খাবার হোটেলে আর খেলাম না। শুনেছি স্টেশনে জনআহার কেন্দ্রে ভাল খাবার পাওয়া যায়। ভাবলাম ওটায় একটু টেষ্ট করা যাক। তাই ছাতা মাথায় দিয়ে ভারী ব্যাগ নিয়ে হাটতে হাটতে বাসস্টপে গেলাম শিয়ালদা যাওয়ার বাস ধরতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলে আসলে উঠে পড়লাম। রবিবার ফাকা রাস্তায় বাস তাড়াতাড়ি চলে আসল শিয়ালদাহ। নেমে দেখি বিশাল রেল স্টেশন। স্টেশনে ঢুকে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। একজন গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম রাজধানী এক্সপ্রেস কোথা থেকে ছাড়ে। তিনি বলে দিলেন সম্ভবত ৯ নম্বর প্লাটফরম থেকে ছাড়ে। তারপর ঘুরে ঘুরে জনআহার কেন্দ্র চোখে পড়ল। ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম কি কি খাবার আছে। দুটো ডিম আর সবজি দিয়ে একটা থালির অর্ডার দিলাম। খাবার ভালই ছিল।
খাবার দাবার শেষে দেখলাম তখনও দু আড়াই ঘন্টা সময় রয়েছে। থ্রি টায়ার এসির ওয়েটিং রুম খুজে সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। আগে আগে আসায় ছিট পেলাম। অন্যরা বলছিল এখানে নাকি সিটই পাওয়া যায় না। বাথরুমে ঢুকে লোকজন দেখি কেউ কেউ গোসলও সেরে নিচ্ছে। পাশে কোথাও একটা পোষ্টারে ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ওয়াইফাই লেখা দেখলাম। সে মোতাবেক কানেক্ট করলাম। কানেক্ট করে ফেসবুক ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। আশে পাশে বাঙালীর চেয়ে হিন্দিভাষী লোকজন বেশি মনে হচ্ছিল। কারণ বেশির ভাগই হিন্দিতে কথা বলছিল।
ইন্ডিয়াতে Whatsapp এর খুব চলন। প্রায় সবাই যারা মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের সবারই Whatsapp আছে। পাশে বসেছিল একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। তারা হিন্দিতে কথা বলছিল। তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, অবশ্য দেখেও তাই মনে হচ্ছিল।
একবার কি ভেবে হয়ত ওয়াশরুমে যাব বলেই মনে হয় ওয়াইফাই বন্ধ করে পরে আবার চালু করতে গিয়ে দেখি আর কিছু ওপেন হচ্ছে না। কিছু ওপেন করতে গেলেই বলে ওমুক জায়গায় গিয়ে এত টাকা রিচার্জ করুন আর উপভোগ করুন ইন্ডিয়ান রেলওয়্যার ফাস্ট ইন্টারনেট।
কি আর করা তখন আবার একটু বাইরের দিকে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম জানি যে আর ফিসে এসে সিট পাওয়া যাবে না। তাও বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। বাইরে গিয়ে দেখি যথারীতি বৃষ্টি। বৃষ্টির আর থামার নাম নেই। ৪:১০ নাগাদ একবার প্লাটফরমে গিয়ে খোজ নিলাম ট্রেনের। গিয়ে দেখি ট্রেন প্লাটফরমে এসে গেছে। পরে খেয়াল করলাম মাইকেও ঘোষণা হচ্ছে যে রাজধানী একপ্রেস ট্রেনটি নির্দিষ্ট প্লাটফরমে অবস্থান করছে। দেরী না করে টিকিট দেখে প্রথমে বগি খোজা শুরু করলাম।
বিশাল লম্বা একটা ট্রেন। আমার বগি ছিল প্রায় শেষের দিকে অনেকক্ষণ হাঁটার পর নির্দিষ্ট বগি খুজে পেলাম। বগিতে উঠার দরজায় দেখি যাত্রীদের নাম লেখা রয়েছে। খুজে খুজে আমার নাম লেখা বের করলাম। নাম ছাড়াও পাশে আর টিকিট নং, তারিখ আরও কি কি নম্বর লেখা ছিল।
নামের পাশে একটা লেখা নজরে পড়ল সেটা হল FT। যা অন্যান্যদের নেই। আমার এবং কিছু পরিমান নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রীর নামের পাশে লেখা ছিল। পাশে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম এর মানে কি? সে বলতে পারল না। পরে অবশ্য আমিই বুঝেছিলাম যে FT মানে ফরেন টুরিষ্ট। কারণ আমি ফরেন টুরিষ্ট কোটায় টিকিট কেটেছিলাম।
ট্রেনে উঠে সিট খুজতে শুরু করলাম। দেখি একদম উপরতলার সিটটা আমার ভাগে পড়েছে। আশে পাশে কোন বাঙালি চোখে পড়ল না। সবাই হিন্দিতে কথা বলছিল, তাই আমাকে ও এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে হিন্দিতে বলতে হচ্ছিল।
আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না যে কোথায় বসব। আমার যেহেতু একদম উপরের সিট টা তাই ভাবলাম উপরে প্রথম থেকেই বসতে হবে কিন। তারপরও নিচের সিটের একপাশে বসে পড়লাম। আমার পাশে বসল দুই মহিলা আর সামনে অন্য এক মহিলা ও তার হাসবেন্ড। কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম এরা কেউ যাবে ধনবাদ আর কেউ যাবে গয়া।
আমি অবশ্য কিছুই চিনি না। একসময় লোকটা জিজ্ঞেস করল- গয়া কিতনে বাজে আয়েঙ্গে? আমি বললাম নেহি পাতা। আমার বাম দিকের দুই সিটে একটা ছেলে আরএকটা মেয়ে বসেছিল। তারা যাবে দিল্লি। ওরা দিল্লি থেকে কোলকাতা মামার বাসায় বেড়াতে এসেছিল। মেয়েটা এত বক বক করছিল যে একসময় মাথা ধরে গেল।
ঠিক ৪:৫৫টায় ট্রেন ছাড়ল। ও এর মাঝে একবার পুলিশ কুকুর নিয়ে পুরো ট্রেন চেকিং করল। ট্রেন চলা শুরু করতেই সবাই যার যার জায়গায় বসে পড়ল। জানালার পাশে সিট না পাওয়ায় একটু আফসোস হতে লাগল। বাইরে বৃষ্টি হলেও প্রকৃতি দেখা তো যাবে যতক্ষণ না সন্ধা হয়।
উঠে গিয়ে বগির দরজায় গিয়ে দাড়ালাম। এসি বগি হওয়ায় এর দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। দরজায় কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম বিখ্যাত হাউড়া ব্রিজ আর নতুন ব্রিজ। ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে ট্রেন ফাকা মাঠের ভিতর দিয়ে চলতে শুরু করল।
দাড়িয়ে থেকে পা লেগে যাচ্ছিল তাই আবার সিটে গিয়ে বসলাম। দেখি সবাই গল্পে মগ্ন। আর পাশের ছেলেটা বিশেষ করে মেয়েটা তো অনবরত কথা বলেই যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরেই নাস্তা নিয়ে আসল ট্রেনের লোকরা। নাস্তা শেষে আবার সবার গল্পে মনোযোগ দিলাম। আসলে শুনছিলাম কে কি বলে তাই। কিছুক্ষণ পরে দেখি আবার নাস্তা নিয়ে আসল। ভাবলাম বাহ এরা তো দেখি জামাই আদর শুরু করেছে। এভাবে তিনবার নাস্তা দেয়ার পর রাত নয়টার পরে দিল রাতের খাবার। রাতের খাবার শেষে উপরতলায় উঠে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ট্রেনে মোবাইল চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। তাই মোবাইলে চার্জ দিয়ে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে ঘুমিয়ে পড়লাম। উপরে এসির কাছাকাছি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা লাগছিল। তাই কোম্বল ছাড়া কোন গতি ছিল না। তবে বেশ আরামের ঘুম হয়েছিল। ট্রেন যে এত জোরে চলছিল তাও ভিতর থেকে তেমন একটা বোঝা যাচ্ছিল না।
ট্রেনে চলা শুরু হওয়ার সময় ট্রেনের ভিতরে মাইকে ট্রেন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য শোনাচ্ছিল। তখন বলছির এই ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ১৩৫ কি: মি: প্রতি ঘন্টা। অবশ্য ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ওয়েবসাইটেও একই তথ্য ছিল। তাই আমার মোবাইলে থাকা জিপিএস স্পিডমিটার অন করে ট্রেনের গতি মাপছিলাম। দেখলাম ট্রেন ১১০ থেকে ১১৫ এর ভিতর চলছে। এটাও কিন্তু খুব ভাল স্পিড। এ জন্যই কোলকাতা থেকে দিল্লী প্রায় ১৫০০ কি: মি: রাজধানী এক্সপ্রেস এর সময় লাগে ১৭ ঘন্টার কিছু কম বেশি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:৫১