somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তাল জল তরঙ্গের নাফাখুম

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কতদিন হয়ে গিয়েছে, কোথাও যাওয়া হয় না। কিভাবে যাব? একা একা যেতে ভাল লাগে না। তাই উপযু্ক্ত সঙ্গির অভাবে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। কতজনকে কতভাবেই সুধাই কিন্তু কেহই হয় না রাজি। অন্তর্জালে শুধু ভ্রমণ কাহিনী পড়ে পড়ে দিনাতিপাত হচ্ছিল। প্রতিটি কাহিনীর সাথে সাথে আমিও কল্পনায় তাদের সাথে ঘুরে আসি। কি নেপাল কি বান্দরবান, কি আল্পস কি নীলগিরী, কোথাই না যাচ্ছি। এই ভাবে কাল্পনিক ভ্রমণে যখন আর পোষাচ্ছিল না। অন্তর্জালের সুবাদে কিছু ভ্রমণ পিপাসু মানুষের গ্রুপের সাথে পরিচয় হয়। তো একদিন জানতে পারলাম তারা নাফাখুম দেখতে যাবে।

সময়টাও বর্ষার শেষে। চিন্তা করলাম বর্ষার শেষে যখন তখন যৌবনে টইটম্বুর নাফাখুমকে দেখতে পাওয়া যাবে। ভাবতে ভাবতে কয়েকদিন চলে গেল। ততদিনে যাবার লিস্টে ২০ জন হয়ে গিয়েছে। ৩৬ জনের বেশী সফরসঙ্গি নিবে না। ভাবলাম যেভাবে লিস্ট দ্রুত ভরে যাচ্ছে তাতে যদি আজকাল টাকা জমা না দিই তাহলে আমার আর যাওয়া হয়েছে। টাকা যে জমা দিব পকেট তো খালি। অগত্যা বন্ধুর কাছে হাত পেতে বসলাম। আশে পাশে দুয়েকটা বড়লোক বন্ধু থাকলে আরকি টাকা কোন ব্যাপার? সাথে সাথে অগ্রিমের টাকা দিয়ে বুক করে ফেললাম। নে বাবা এবার নাকে তেল দিয়ে ঘুমা যতদিন না যাওয়ার তারিখ আসে। টাকা জমা দেয়ার পর রাতে আর ঘুমই আসে না। কখন যাব? কখন যাব? এইভাবে ছটফটানির মধ্যে দিয়ে দিন রাত কাটতে লাগল।

অবশেষে নাভাখুম যাওয়ার দিন চলে আসল। রাত ১০ টায় গাড়ি ফকিরাপুল থেকে। সন্ধায় কামলা দেয়া শেষ করে মেসবাড়িতে ফিরলাম। ব্যাগ আগে থেকেই গোছানো ছিল তারপরও আবার একটু ঝালিয়ে নিলাম। সবকিছু দেখে নিয়ে রাত আটটায় রাতের খাওয়া শেষ করলাম। সিনিয়রদের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী একদিন আগে থেকেই ম্যালেরিয়ার প্রতিশোধক খাওয়া শুরু করেছিলাম। টি শার্ট, শর্টস আর বেল্টওয়ালা স্যান্ডেল পরে ফকিরাপুলের দিকে হন্ঠন করিতে শুরু করলাম। হাতে অনেক সময় থাকায় এবং ফকিরাপুল কাছে হওয়ায় হাটাকেই উত্তম মনে করলাম। হাটতে হাটতে ৯টার দিকে কাউন্টারে পৌছে গেলাম। ততক্ষণে এক এক করে ভ্রমণ পিপাসুরা আসতে শুরু করেছেন। সবার সাথে পরিচিতি পর্ব চলতে থাকল। এর মধ্যে এক চাচা টাইপ লোক যে কিনা অনেক আগে বান্দরবানের থানচির ঐদিকে ছিল, তিনি নানানরকমের জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসলেন। চাচার জ্ঞান দান শেষে ১০টার কিছু আগে বাসের সিটে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের জন আসলেন। পরিচয় পর্ব শেষে বিভিন্ন গল্প শুরু হয়ে গেল। সবাই চলে আসলে ঠিক ১০টায় বাসের চাকা ঘোরা শুরু হল। ১০টায় ফকিরাপুল ছাড়লেও কমলাপুরে এসে আধাঘন্টা দেরী করতে হল। কারণ এই বাসের আগের এক যাত্রীর ব্যাগ হারিয়ে গিয়েছে, তাই তিনি বাস থামিয়ে পুরো বাসে চিরুনী অভিযান শুরু করলেন। কিন্তু কোন লাভ হল না। কোথাও তার ব্যাগের ফিতা পর্যন্ত পাওয়া গেল না। এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছিল বিধায় বাসের ভ্রমণ সঙ্গিরা তাকে তাড়া দিতে লাগল। যাই হোক সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বাস পুরোপুরি চালু হয়ে গেল। কিছুক্ষন গল্পগুজবের পর চলে গেলাম ঘুমের দেশে। ঘুম ভাঙল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গিয়ে। সেখানে হোটেলে গিয়ে গরুর মাংস দিয়ে ভরপুর খাওয়া দাওয়া হল। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত হালকা নাস্তা টাইপ কিছু হবে। গিয়ে দেখি ভুড়িভোজ। গরুর মাংস দেখে আমার মত না খাওয়া পাবলিকও দুপ্লেট মেরে দিল। পাশে এক ভাই দেখি শুধু চা খাচ্ছিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললেন ভাই- এখন রোজার মাস না বিধায় আমার সেহরী খাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই ;)

খাওয়া দাওয়া শেষে আবার বাস গড়াতে শুরু করল। ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি তখনও পাহাড়ি পথ শুরু হয়নি। অনেক আগে একবার বান্দরবান আসায় পথের কথা হালকা হালকা মনে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পরই শুরু হল পাহাড়ী আকা বাকা পথ। পাহাড়ী রাস্তা যখন শুরু হয়েছে তখন কি আর আমার ঘুম আসে? আমি প্রাণ ভরে পাহাড় গিলতে শুরু করলাম। কত কত গাছপালা আর উচু নিচু পাহাড়। আহ কি শান্তি।

সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা বান্দরবান পৌছলাম। সেই পুরনো বাসস্টান্ড, দেখেই চিনতে পারলাম। সামনে বিশাল এক খাড়া পাহাড়। সবাই সেলফি তোলা শুরু করল। বাসস্টান্ডের কাছেই এক হোটেলে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তার জন্য বসে গেলাম। গরম গরম পরাটা আর ডালভাজি। পেটপুজো শেষে আগে থেকে ঠিক করে রাখা রিজার্ভ লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। আমার যেহেতু পুরো রাস্তাটা উপভোগ করতে হবে তাই আমি আগেভাগে উঠে একেবারে সামনের ছিট দখল করে বসলাম। আমরা বান্দরবান গিয়েছিলাম বর্যার শেষে আর শীতের কিছু আগে। তারিখটা যতদুর মনে পড়ে ২৯ অক্টোবর ২০১৫। অন্যান্য দিন বৃষ্টি না থাকলেও আমরা যেদিন বান্দরবান পৌছলাম সেদিন থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। পুরো দুই দিন আর তিন রাতের ট্রিপে টিপ টিপ বৃষ্টি আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গি ছিল। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের অন্য এক রুপ দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। অনেক শুনেছিলাম বষাকালে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ পাহাড়ের ভাজে ভাজে আটকে থাকে। সেই অপরূপ দৃশ্য আগে শুধুই কল্পনায় দেখেছিলাম। এবার সেই দৃশ্যের সামনা সামনি অবলোকন। বান্দরবান টু থানচি রাস্তাটা যে এত সুন্দর আর রোমাঞ্চকর তা বলে বোঝান কঠিন। পুরো তিন ঘন্টার রাস্তা আমি একটুও এদিক ওদিক করিনি। শুরু অপার হয়ে চারিপাশের সৌন্দর্য দেখেছি। পথিমধ্যে প্রথম থেমেছিলাম ওয়াই জংশনে। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর পারমিশন নিতে হয়। ওয়াই জংশনে দেখলাম একটা রাস্তা পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে রুমার দিকে চলে গেছে আর একটা রাস্তা উপরে ওঠে থানচি চলে গেছে। রাস্তার দুধারে কত শত পাড়া পার হচ্ছিলাম আর দেখছিলাম পাহাড়ী জীবনধারা।







দুপুর একটা কি দুটো নাগাদ আমারা থানচি বাজারে পৌছলাম। থানচি বাজারে যখন পৌছলাম তখন বৃষ্টির পরিমান কিছুটা বেড়েছিল। পুরো রাস্তার সবসময়ই যে বৃষ্টি ছিল এমন না। কিছুক্ষণ বৃষ্টি আবার কিছুক্ষন শুধুই মেঘ আর ঠান্ডা হাওয়া হচ্ছিল। তবে সুর্য্য মামার দেখা সেদিন আমরা তেমন একটা পাইনি। থানচি বাজার থেকে বিজিবি’র অনুমতি নিতে হয়। যারা ওদিকটায় গিয়েছেন তারা জানেন নাফাখুম যাওয়ার রুট সম্পর্কে। বান্দরবান থেকে তিন ঘন্টা বাসে করে থানচি, তারপর তিন ঘন্টা নৌকা করে রেমাক্রি, তারপর তিন ঘন্টা পায়ে হেটে (এক এক জনের এক এক রকম সময় লাগতে পারে। আমাদের টিম অনেক বড় ছিল বিধায় সময় বোধহয় বেশী লেগেছিল।) নাফাখুম। থানচি বাজারে আমরা সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করেও বিজিবির অনুমতি পেতে বেশ সময় লেগে গিয়েছিল। যতক্ষণে বিজিবির পারমিশন নিচ্ছিল সিনিয়রা ততক্ষণে আমরা থানচি বাজার ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। এ দোকান ও দোকান ঘুরে ঘুরে এটা ওটা খাচ্ছিলাম। সবাই বলে পাহাড়ী কমলা নাকি সেইই স্বাদ। কাঁচা ছিল কিনা জানিনা আমার কাছে খবই টক লেগেছিল। যেহেতু টিপ টিপ বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছিল তাই আমাদের গ্রুপের সদস্যরা কেউ কেউ ছাতা কিনল, কেউ কিনল কাউবয় হ্যাট আর আমার মত পাপিরা কেউ কেউ কিনল পলিথিন। সেই পলিথিন স্থানীয় দর্জির কাছ থেকে কেটে রেইনকোর্ট বানিয়ে নিয়েছিলাম।







আমাদের সবার কাছে লাইফ জ্যাকেট ছিল না বলে বিজিবি পারমিশন দিচ্ছিল না। কি আর করা ভাড়া করতে হল লাইফ জ্যাকেট। কিছু লাইফ জ্যাকেট অবশ্য আমাদের কাছেও ছিল। কিন্তু তা মোট সদস্যর সংখার তুলনায় কম। শেষে জনপ্রতি একটা করে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিতে হল। বিজিবির পারমিশন পেতে পেতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। তারপর আমরা সবাই নৌকায় ওঠে পড়লাম। এক এক নৌকায় ৫ থেকে ৬ জন করে বসলাম। শুরু হল আমাদের সাঙ্গু দর্শন। বর্ষায় প্রমত্তা সাঙ্গু তার যৌবনের হুংকার জানাচ্ছিল। সবসময় শুনেছি পাহাড়ী নদী খুব খরস্রোতা হয়, এবার দেখে নিলাম। কি ভয়ংকর স্রোত। আমাদের আবার যেতে হবে পুরো উজানে। নদী বেয়ে বেয়ে যাচ্ছি আর দুপাশের অপরুপ প্রকৃতি দেখছি। দেখছি পাহাড়ের ভাজে ভাজে আটকে থাকা মেঘ। মনে হচ্ছিল স্বর্গে চলে এসেছি। মাঝে মাঝেই ছোট ছোট ঘর দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। আসলে এই ঘরগুলো হচ্ছে জুম ঘর। এক জায়গায় নদীতে দেখলাম পাহাড়ী গিন্নিরা থালাবাসন ধুচ্ছেন, আবার কেউ কাপড় ধুচ্ছেন। সাথে সাথে শিশুরা নদীতে গোসল করছিল। আমরা তাদের দেখে হাত নাড়ছিলাম, আর ওরাও।







স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের ছোট নৌকা ছুটছিল সমান তালে। চলতে চলতে এক সময় তিন্দু এসে পৌছলাম। আমাদের পরিকল্পনায় তিন্দু নামার কথা ছিল। কিন্তু বিজিবির পারমিশন পেতে দেরী হয়ে যাওয়ায় যখন তিন্দু এসে পৌছলাম তখন প্রায় সন্ধা হব হব ভাব। তাই তিন্দু আর নামা হল না। তবে ঘাটে আমরা কিছুক্ষণ থেমেছিলাম নৌকার তেল নেয়ার জন্য। নদী থেকে যতটুকু পারা যায় ততটুকু দেখে নিলাম তিন্দুকে। তিন্দু না দেখার আফসোস নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর পৌছে গেলাম বড় পাথর, রাজা পাথরের কাছে। নদীর মাঝখানে কি বিশাল বিশাল পাথর পড়ে আছে। মনে হয় যেন পথ আটকে বসে আছে। পাশে অনেক উচু উচু পাহাড় ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল এই সব বিশাল বিশাল পাথর ঔসব পাহাড় থেকে গড়িয়ে এসে নদীতে পড়েছে। এই পাথুরে এলাকা দিয়ে নৌকা চালাতে মাঝির ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে স্রোতের পানি নৌকায় উঠে গা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। বিনে পয়সায় রাফটিং করা হচ্ছিল।









পাহাড়ে এমনিতেই তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। তাই আমরা যখন রেমাক্রি এসে পৌছলাম তখন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। নদীর পাড়ে দুটি সুন্দর কটেজ বানানো ছিল বিজিবি সহায়তায়। আমাদের অবশ্য আগে থেকেই দুটি কটেজের দুটি দুটি মোট চারটি বড় বড় কামরা বুকিং দেয়া ছিল। আমাদের ছত্রিশ জনের গোটা টিমকে দুই ভাগে ভাগ করে দুটো কটেজে রাত থাকার জন্য পাঠানো হল। আমরা হাত পা ধুয়ে কটেজে উঠে যার যার আসন ঠিক করে নিলাম। তারপর নদীতে গেলাম গোসল করতে। যদিও বেশ শীত শীত লাগছিল তারপরও নদীর পাড়ে এসে গোসল করবনা তা কি হয়? নদীর শীতল জলে অনেক ঝাপাঝাপি করে কটেজে ফিরে আসলাম।











কটেজে এসে রাতের খাওয়া দাওয়ার খবর নিলাম। বলল রাত সাড়ে নয়টা দশটা বাজবে। তো কি আর করা আমরা সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে রেমাক্রি বাজারে গেলাম চা খেতে। আমরা যখন কটেজে ছিলাম তখন মাইকে আযান দেয়ার মত শুনলাম। ভাবলাম এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনিতেই মানুষজন কম আবার এদিকে সবাই প্রায় বৌদ্ধ, এখানে আবার মসজিদ কোথা থেকে আসল? তারপর একটু খেয়াল করে শুনে বুঝলাম না ওটা আযান ছিল না। সম্ভবত তাদের মার্মাদের মাতৃভাষায় তাদের পুজো পাঠের কোন কিছু চলছিল। চা খেতে বাজারে যাওয়ার সময় দেখলাম পাশেই একটা মন্দিরের মত। তখন বুঝলাম আসলে এইখান থেকে আসছিল সেই শব্দ। বাজারটা চারকোনা টাইপের। চারকোনা পায়ে চলা রাস্তা আর তার চারপাশে দোকানপাট। দোকানগুলোতে সব ব্যাটারির লাইট জ্বলছিল। তখন মার্মাদের কি একটা ধর্মীয় উৎসব চলছিল, তাই ছোট ছেলেমেয়েরা দেখলাম ফানুস উড়াচ্ছিল। এখানে অনেক লোক ছিল বিশেষ করে মেয়েরা যারা আমাদের এক বর্ণ বাংলাও বুঝতে পারছিল না। আমরা যেয়ে বললাম চা পাওয়া যাবে? তখন দোকনী হা করে তাকিয়ে ছিল। পরে তার কর্ত মশাই আসলে তিনি বুঝিয়ে দিয়ে বললেন যে- চা খাবে। এই শূনে মহিলার কি হাসি, আমরা যেন অদ্ভুত কোন কিছু চেয়ে বসে আছি। এভাবে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে কটেজে ফিরে আসলাম। অনেকে সারাদিনের জার্নির পরিশ্রমে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমরা কয়েকজন মিলে নানা রকমের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসলাম। কেউ বা আবার বসে পড়লেন তাস খেলতে। প্রায় দশটার দিকে আমাদের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। মুরগীর মাংস আর ডাল দিয়ে পাহাড়ি স্বাদে রাতের ভরপুর খাবার খেলাম সবাই মিলে। খাওয়া দাওয়া শেষে সারাদিনের ক্লান্তিতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। আমাদের খুব সকালে উঠতে হবে বিধায় আড্ডা মারার আর সুযোগ থাকল না।


সকালে সবাই খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। সকালে উঠে বাজারে সবাই একসাথে হয়ে চা আর হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। ৭টা নাগাদ আমরা রওনা হলাম নাফাখুমের উদ্দেশ্যে। বর্ষায় যারা পাহাড়ে গিয়েছেন তারা জানেন যে, রাস্তার কি কঠিন হতে পারে। এমনিতেই উচু নিচু রাস্তা তার উপর আবার টিপ টিপ বৃষ্টি। আমরা আসলে যেই পথ দিয়ে হাটা শুরু করেছিলাম সেটা কোন রাস্তা ছিল না। রেমাক্রি খালের পাশ দিয়ে বিভিন্ন পাড়া মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল। বৃষ্টিতে সমস্ত পথ পিচ্ছিল ছিল। খুবই সাবধানে পা ফেলে চলতে হচ্ছিল। চলতে চলতে কিছুক্ষণ পর আমরা উপরের পাড়ার ভিতরকার পথ ছেড়ে খালের পাড়ে চলে আসলাম। এখানে প্রথম খাল পার হতে হল। পানি ছিল হাটু পর্যন্ত, কিন্তু পানির এত স্রোত ছিল যে ঔ হাটু সমান পানি পার হওয়া খুবই কঠিন হচ্ছিল। আমরা সবাই হাত ধরা ধরি করে হিউম্যান চেইন তৈরী করে পার হলাম। দারুন এ্যাডভেঞ্চারাস ছিল সেই পথ।

































এই পাহাড়ী পথ হাঁটার সময় প্রায় সবাই আছাড় খেয়েছিল। প্রথম প্রথম কেউ কেউ হাসছিল, পরে ব্যাপারটা এমন কমন হয়ে গেল যে আর কেউ হাসছিল না। এক জায়গায় গিয়ে বুক সমান পানি পার হতে হয়েছিল, তবে সেখানে স্রোতের পরিমান কম ছিল। কিছু কিছু জায়গা খুবই ভয়ংকর ছিল। একবার পা সরে গেলেই হয়েছে, সোজা এ পাথর ও পাথরে যেয়ে বাড়ি খেতে হবে। আর একটা জিনিসে খুব যন্ত্রনা দিয়েছে তা হল জোক। গ্রুপের প্রায় প্রত্যেকেরই আসা যাওয়ার পথে জোকে একবার হলেও ধরেছিল। অনেকে তো ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। তবে আমাদের সাথে এক আপু ছিল যার তিনবার জোকে ধরেছিল, কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বকার। যেন এটা কোন ব্যাপারই না। আসলেই তাঁর বেশ সাহস ছিল। কারণ এই চড়াই উৎরাই বেয়ে সে আমাদের সাথে সমান তালে চলছিল। আরও কয়েকজন মেয়ে আমাদের সাথে ছিল কিন্তু তাদের চেয়ে ইনি বেশ অগ্রগামি ছিলেন।

বহু চাড়াই উৎরাই পেরিয়ে বেলা দশটা নাগাদ আমরা আমাদের মুল আকর্ষন নাফাখুমে পৌছলাম। নাফাখুম দেখে সবাই তখন খুশিতে আত্বহারা। বৃষ্টির কারণে অনেকেই ক্যামেরা নিয়ে আসলেও বের করেনি। তারপরও মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে সবাই ফটাফট ছবি তুলতে লাগল। ঝর্ণার কাছে যেখান থেকে আমরা সবাই ছবি তুলছিলাম সেখানে পাথর ভয়াবহ আকারে পিচ্ছিল ছিল। আগে থেকেই কিছু টুরিষ্ট এসেছিল যাদের কয়েকজন কে দেখলাম নিচে একেবারে ঝর্ণার কাছে চলে গিয়েছে। এই দেখে আমাকে আর ঠেকাই কে, আমি ইয়া এক লম্ফ দিয়ে পড়লাম ঝর্ণার পানিতে। সাথে সাথে স্রোত আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। প্রাণপন সাতার দিয়ে অপর প্রান্তে উঠলাম। আরও দুয়েক জন এইভাবে আসল। সেখানে একটা বাশের ভেলা ছিল আমরা ভেলাতে উঠলাম। ভেলায় উঠে ঝর্ণার পানিতে ভিজতে লাগলাম। এই ভাবে অনেকক্ষণ জলকেলী করার পর হঠাৎ গ্রুপ লিডারের জরুরী তলব। বলল ভাই তাড়াতাড়ি উঠে আসেন। তো উঠে আসার জন্য সেই প্রবল বেগের পানিতে আবার লাফ দিলাম। কিন্তু হায় কিছুতেই পাড়ে উঠতে পারছিলাম না। পর পর তিন বারের চেষ্টায় প্রবল সাতার দিয়ে এপারে দাড়িয়ে থাকা মার্মা গাইডের হাত ধরতে পারলাম। পাড়ে উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।





পাড়ে উঠে শুনি আমাদের একজন কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি বিপদ! এই জলাজঙ্গলে হারিয়ে গেলে কিভাবে খুজব? সবার মাথা তিন তিন বার গুনা হল। কিন্তু সেই একজন মিসিং। সবার যখন চিন্তায় গালে হাত, ঠিক তখন দুরে একজনকে দেখা যাচ্ছিল। কাছে আসাতেই বুঝলাম এসে গিয়েছেন আমাদের মিসিং পারসন। সবাই জেরা করতে আরম্ভ করল। কি ব্যাপার? কোথায় ছিলেন? কেন ছিলেন? কখন ছিলেন? কবে ছিলেন? সে বলল আমি আসলে একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম, পরে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে ফিরতি অন্য টুরিষ্টদের কাছে শুনে তিনি এখানে এসে পৌছলেন।







উনাকে পেয়ে আমরা আবার লাফালাফি শুরু করলাম। কিছু শুকনা খাবার ছিল সেগুলো খাওয়া হল। যেহেতু আমাদের হাতে সময় কম তাই আবার ফিরতি পথ ধরা হলো। অনেক ঝাপাঝাপি করার ফলে আমার আপ পা চলছিল না। চলতে চলতে একসময় যেখানে রেমাক্রি খাল সাঙ্গু নদীর সাথে মিশেছে, সেখানে বেশ সুন্দর ছোট ছোট ঝরণা ছিল। এগুলোকে নাকি রেমাক্রি ফলস বলে। তো আমরা কয়েক জন বেশ আগেই পৌছে যাওয়ায় রেমাক্রি ফলসে ইচ্ছমত ভিজতে শুরু করলাম। শীতল পানি যখন গায়ে লাগছিল, কি যে সুখ অনুভব করছিলাম, বলে বোঝানে যাবে না। টিমের বাকী সবাই যখন পৌছল তখন আমরা কটেজে যাওয়ার জন্য সাঙ্গু নদী পার হলাম। পার হওয়ার সময় স্রোতে শুধু টেনে নিয়ে যেতে চাই। আবারও আমরা হিউম্যান চেইন তৈরী করে নদী পার হলাম।

নাফাখুম ভ্রমণ আমাদের খুব টাইচ শিডিউল ছিল তাই যতক্ষণে আমরা নাফাখুম দেখে রেমাক্রি পৌছলাম ততক্ষনে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছে। সবাই তাড়াহুড়া করে গোছগাছ করে রওনা হলাম থানচির উদ্দেশ্যে। রেমাক্রি আসার সময় স্রোতের বিপরীতে আসছিলাম বলে প্রায় তিন ঘন্টার কাছাকাছি লেগেছিল। থানচি যেতে স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছিলাম বিধায় একটু তাড়াতাড়ি পৌছেছিলাম। তারপরও প্রায় বিকাল সাড়ে পাঁচটায় তানচি পৌছলাম। থানচি পৌছান মাত্র দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠলাম। কেননা আমাদের বলিপাড়া আর্মি ক্যাম্পে সন্ধ্যের মধ্যে রিপোর্টিং করতে হবে। বাসের ড্রাইভারও ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস এর মত গাড়ি চালাচ্ছিল। আমাদের বাসের ড্রাইভার আসলে কতটা দক্ষ ছিল তা ঔদিন বুঝেছিলাম। সন্ধা ৬টার মধ্যে রিপোর্টিং করার কথা, কিন্তু আমরা মনে বলিপাড়া পৌছেছিলাম ৬:১৫ দিকে। তারপরও আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। যদি না ছাড়ত, যদি বলত আজ আর যাওয়া যাবে না, তাহলে শেষ, কেননা আমাদের রাতের বাসের টিকেট করা ছিল। তাছাড়াও আমারেদ বেশিরভাগেরই পরেরদিন অফিস ছিল।

যাইহোক রাতের অন্ধকারে পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে বাস চলতে লাগল। চলতে চলতে মাঝেই মাঝেই সাদা কুয়াশার মত রাস্তা আটকে ধরছিল। প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ড্রাইভার বলল গতকাল মেঘ দেখেছিলেন পাহাড়ের গায়ে আজ তারা রাস্তায় এসে দাড়িয়েছে। মেঘ গুলো যেন অবরোধ করছিল আর বলছিল না তোমাদের যাওয়া হবে না। আমরা মেঘকে অনুনয় বিনয় করে আবার আসার কথা দিয়ে তবেই আসলাম।

আমাদের গাড়ি যখন ওয়াই জংশনে তখন ঢাকাগামী বাসের বান্দরবান কাউন্টার থেকে ফোন- ভাই আপনারা কতদুর আমাদের বাস তো ঠিক সময়ে চলে এসেছে। আমরা আমাদের অবস্থান জানালাম আর একটু অপেক্ষা করতে বললাম। বান্দরবান পৌছাতেই দেখি বাস রেডি হয়ে দাড়িয়ে আছে। আমাদের সময় স্বল্পতার কারণে দুপুরে একবার খাওয়া হয়নি আবার রাতে এখানে এসে বাস ছাড়ার সময় হয়ে যাওয়ায় রাতের খাওয়া হল না সময়মত। সবাই টুকটাক শুকনা খাবার কিনে আপাতত পেট চালান মতো ব্যবস্থা করে নিল। রাতে চৌদ্দগ্রাম এসে আমরা সবাই খাবার দেখে ক্ষুধার্থ বাঘের মত হামলে পড়েছিলাম। নরমালি এক ঘন্টা বিরতি দিত কিন্তু সেদিন আমরা প্রায় দেড় ঘন্টা বিরতি নিয়েছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ দুপুর ১:০৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×