দুদিন পর পর মন শুধু ছটফট করে। শুধু মনে হয় কোথায় যাই কোথায় যাই। কোথাও যে যাব তা আবার ভারী কঠিন ব্যাপার। একা একা যাওয়ার মধ্যে বেশ কিছু সমস্যা আছে। সর্বদা চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আমার মত অলসের কাছে এই কাজ খুব যন্ত্রণাদায়ক। বেড়াতে গেলে আমি ভাই দায়িত্বের যাবতীয় বোঝা অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা মানুষ। অচেনা কোন গ্রুপের সাথে গেলেও কাউকে না কাউকে পেয়েই যাই, যার কাধে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরাঘুরি করি।
দায়িত্বজ্ঞানের কথা যখন আসল তখন ছোট একটা গল্প বলা যাক। একবার হল কি, ছোট বোনকে নিয়ে দেশের বাড়িতে যাব। সকাল ৮টায় গাড়ি। বিশাল দায়িত্ব নিয়ে ৭:২০ এ ঘুম থেকে উঠলাম। গোসল, খাওয়া সারতে সারতে ৭:৪০। উত্তরা ৪ নং সেক্টর থেকে রওনা দিলাম আব্দুল্লাহপুর বাসষ্ট্যান্ড যাব বলে। হাউজবিল্ডিং এর কাছে যখন রিকশায় জ্যামে ঠেকলাম তখন ৮:০০ বাজে। ভাবলাম, বাস তো একটু দেরী করেই আসে। আর যে জ্যাম দেখছি তাতে তো অবশ্যই দেরী করা উচিৎ।
তো যাহোক মহাদায়িত্ব নিয়ে যখন কাউন্টারে পৌছলাম তখন ঘড়ির কাটা বলছে ৮:১৫। এ আর এমন কি দেরী। লোকে তো আরও কত দেরী করে। সর্বদা গোমড়া মুখে বসে থাকা কাউন্টারের লোকটাকে যখন সুধালাম ওমুক নম্বর গাড়ি কখন আসবে? আমার কথা শুনে লোকটা আকাশ থেকে না মনে হল অন্যা কোন গ্যালাক্সি থেকে পড়ল। কিছুক্ষণ পর বিরস কন্ঠে বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? মনে মনে বললাম কেন রিকশায় ছিলাম। আবার বলতে শুরু করল- বাস ঠিক আটটায় এসে আপনাদের জন্য ১০ মিনিট অপেক্ষা করে চলে গিয়েছে। তারা আর কোন ব্যবস্থা করতে পারবেনা। অগত্যা নতুন করে টিকিট কাটতে হল পরের বাসে। গুনে গুনে ৯৬০ টাকা পকেট থেকে বের হয়ে গেল। আগের দিন দুলাভাই টিকিট করে দিয়েছিল, এবার লেও ঠ্যালা। তো এই হচ্ছে আমার দায়িত্বজ্ঞান (নিজেকে কি একটু বেশী পঁচানি দিলাম? যাওজ্ঞা সামনের দিকে আউজ্ঞা, সবতো আমরা আমরাই)।
যাই হোক বেড়াতে গেলে বন্ধু বান্ধব, কলিগ, বড় ভাই কাউকেই পাওয়া যায় না (যারা অন্তত শেয়ারে কিছু কন্ট্রিবিউট করতে পারে)। কি জানি কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার আশে পাশের মানুষগুলো বড্ড ভ্রমণ বিমুখ। কাউকেই এ ব্যাপারে রাজি করানোর চেয়ে দুবার এভারেষ্টে চড়া সহজ। তো অনেক বলে কয়ে, ১ সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ব্লগের বিভিন্ন জনের লেখা পড়িয়ে আমার কলিগকে রাজি করালাম গারো পাহাড় দেখতে যাওয়ার জন্য। বাজেট তুলনামুলক কমে হওয়ায় এই প্যাকেজে তার রাজী হওয়ার অন্যতম কারণ।
আগেরদিন আলাপ আলোচনা সব শেষ করে যে যার মত বাড়ি চলে গেলাম। ওহ তার আগে আমরা অবশ্য মহাখালি বাসষ্টান্ডে গিয়ে গাড়ির খোজ খবর নিয়ে এসে ছিলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম সরাসরি নালিতাবাড়ি যায় এমন গাড়ির। নালিতাবাড়ি এক্সপ্রেস (শিউর না, ভুলে গেছি, আমার মেমরি খুব খারাপ) নামে গাড়িটি সবার আগে অর্থাৎ ৬ টায় ছাড়ে। আমার কলিগ মহাখালি বাসষ্টান্ড থেকেই উঠবে আর আমি উঠব উত্তরা থেকে। কথাবার্তা ঠিক করে সবাই বাড়ি চলে গেলাম। ভোরে সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল খাওয়া সেরে যথাসময়ে উত্তরা বাসস্টপে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কলিগের সাথে ফোনে আলাপ হয়ে গিয়েছে। সে বলল গাড়ি ঠিক সময়মত ছেড়েছে। উত্তরায় গাড়ি পৌছাতে ২০ মিনিট মত সময় লাগল। গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম। কিছু শুকনা খাবার নিয়ে নিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ওগুলো খাওয়া হল। গাড়ি মোটামুটি ভরাই ছিল আর সকালবেলা এবং ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তাও ছিল জ্যামমুক্ত। ভালই চলছিল গাড়ি। ময়মনসিংহ হয়ে গাড়ি নালিতাবাড়ি যাবে। এই বাসে যাওয়ার সুবিধা হল শেরপুর শহরে যাওয়া লাগবে না।
ময়মনসিংহ শহরে পৌছানোর আগে আমাদের গাড়ি একটা ব্রেক দিল ২০ মিনিটের। আমরা দুজন বাস থেকে নেমে ছোট টম দোকান থেকে চা বিড়ি খাওয়া শুরু করলাম। কিছুক্ষন সেলফি টেলফি তুলে আবার বাসে উঠে পড়লাম। আবার বাস গড়াতে শুরু করল। কিছু সময় পর আমরা ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করলাম। ময়মনসিংহ শহর দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, বিশেষ করে ব্রক্ষপুত্র নদীটাকে। অনেক আগে তসলিমা নাসরিন পড়েছিলাম। সেখানে ময়মনসিংহ আর ব্রক্ষপুত্র নদীর বর্ণনা ছিল। সেই নদী দেখার সাধ এতদিন পর কিছুটা মিটল। নদীর উপর ব্রিজ যখন পার হচ্ছিলাম তখন যতটুকু পারা যায় নদীটাকে ভালভাবে দেখে নিচ্ছিলাম আর মনে মনে শিহরিত হচ্ছিলাম।
যা হোক ফুলপুর পার হওয়ার পর রাস্তা অনেক সরু হয়ে আসল আর যেখানে সেখানে ভাঙ্গা ছিল। বেশ ঝাকুনি হচ্ছিল। অবশেষে একসময় ঝাকুনি খেতে খেতে নালিতাবাড়ি এসে পৌছলাম। নালিতাবাড়ি এসে যখন পৌছলাম তখন প্রায় সকাল ১০ টা বেজে গিয়েছে। আমরা নেমে প্রথমে কিছু খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। তারপর এর ওর কাছে শুনলাম কিভাবে মধুটিলা ইকো পার্কে যাওয়া যাবে। একজন বলল কিছুদুর হাটার পর মেইন বাজার পড়বে সেখান থেকে আপনি শেয়ারে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাতেও যেতে পারেন আবার মটরসাইকেল ভাড়া করেও যেতে পারেন। আমারা বাজারে গিয়ে প্রথমে কোন অটোরিকশা দেখলাম না। তবে কিছু মটরসাইকেল দেখতে পেলাম। আমাদের দেখে উৎসুক মটরসাইকেল ড্রাইভাররা ভিড় করতে লাগল। আমাদের ও খুব তাড়া ছিল কেননা আমাদের আর দিনের দিন ঢাকা ফিরতে হবে। দ্রুত যাওয়া যাবে বলে আমরা ২০০ টাকা দিয়ে মটরসাইকেল ভাড়া করলাম। চুক্তি হল একদম মধুটিলা ইকোপার্কের সামনে নামিয়ে দিবে। মটরসাইকেলের ছিট বেশ প্রশস্তই ছিল তাই তিন জন (ড্রাইভারসহ) বসতে তেমন কষ্ট হল না।
ছোট সরু রাস্তা বেয়ে এঁকেবেকে চলতে শুরু করল আমাদের মটরসাইকেল। পথিমধ্যে এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাজার নন্নি পড়ল। গ্রাম্য বাজার হিসেবে বাজারটা বেশ জমজমাট ছিল। ও হ্যা আমাদের অটোরিকশা না নেওয়ার আর একটা কারণ ছিল। সেটা হল কোন অটোই সরাসরি মধুটিলা যাচ্ছিল না। তারা কেবল বলছিল নন্নি যাবে। আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা মটরসাইকেল ভাড়া করেছিলাম। আসলে নন্নি এসে অটো চেঞ্জ করে আবার মধুটিলা যাওয়া যেত। যারা মধুটিলাই যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন কম খরচে তাদের মনে এই তথ্য কাজে লাগবে। যা হোক একসময় আমরা পৌছে গেলাম মধুটিলা ইকোপার্কে। পার্কে ঢোকার মুখে টিকিট কাটতে হল। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল পুরো ইকোপার্কের ম্যাপ। আমরা ভালমত ম্যাপটা দেখে নিলাম যাতে করে ঘুরতে সুবিধা হয়। অফ সিজন হওয়ার দর্শনার্থীদের তেমন কোন ভিড় ছিল না। তবুও একটা বাস দেখলাম অনেক দর্শনার্থী নিয়ে ঘুরতে এসেছে। আমরা হাটতে শুরু করলাম।
বেশ সুন্দর জায়গা। আশেপাশে প্রচুর গাছগাছালী তার মধ্যে দিয়ে ছোট ছোট ওয়াক ওয়ে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন বেশ গরম ছিল। কিন্তু পার্কের মধ্যে প্রচুর গাছপালা থাকায় গরম কি জিনিস ভুলে গেলাম। তারপর আবার উচু নিচু ঢালু রাস্তা ছিল। আমরা কিছুদুর সামনে গিয়ে বায়ে মোড় নিলাম। কারণ ওয়াচ টাওয়ার টা ছিল এই দিকেই। আমরা শুধু হাটছিলাম না সাথে চলছিল সমানে ছবি তোলা। দুজন বিভিন্ন এঙ্গেলে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছিলাম। ওয়াচ টাওয়ারটা ছিল একটা ছোট টিলার উপর। ওয়াচ টাওয়ারের কাছে আসতেই মানুষজন চোখে পড়ল। সেখানে আবার স্থানীয় মানুষজন বিভিন্ন খাবারদাবার আর ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসেছিল। পার্কে এই যায়গাটায় একটু মানুষজন চোখে পড়ল। অফ সিজন হওয়ায় পুরো পার্ক একপ্রকার ফাকায় ছিল।
ওয়াচ টাওয়ারে উঠতে আবার টিকিট কাটতে হল। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দুচোখ জুড়িয়ে গেল। আশেপাশের দৃশ্য এত অসাধারণ ছিল যে বর্ণনা করে বলা সম্ভব না। উচু নিচু পাহাড় আর সবুজ গাছপালা দেখে পুরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শুধুমাত্র তখনই মনে হল এখানে আসা পুরোপুরি সার্থক। ওয়াচ টাওয়ারে উঠলে আশেপাশের পুরো এলাকা চোখে পড়ে এমনকি দুরে মেঘালয় রাজ্যের বিএসএফ ক্যাম্প ও দেখা যায়। ওয়াচ টাওয়ারের উপর টাকার বিনিময়ে দুরবিন দিয়ে বিএসএফ এর ক্যাম্প এবং দুরের মেঘালয় দেখার সুযোগ ছিল। আমরা দুরবিন দিয়ে পুরো এলাকাটা দেখছিলাম। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আবার নীল আকাশের শুরু। আকাশটা যেন উল্টানো বাটির মত লাগছিল।
নীল আকাশে আবার প্রচুর সাদা মেঘ ছিল। সবুজ অরণ্যের উপর নীল আকাশে সাদা মেঘ দেখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম “আজ নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা”। ওয়াচ টাওয়ারে প্রকৃতি দেখা শেষ করে আবার আমরা নীচে নেমে পার্কের এরিয়া ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। কিছুদুর হাটার পর পার্কের এরিয়ার বাইরে বের হওয়ার একটা রাস্তা চোখে পড়ল। তার্ ওপারে আবার উচু পাহাড় আর জঙ্গল চোখে জড়ল। আবার পাহাড়ে চড়ার খুব নেশা। কলিগকে বললাম চলেন ঔ উচু পাহাড়ে চড়া যাক। সে তো কিছুতেই রাজি নয়। এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেলাম। খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে গেলাম। অবশ্য পায়ে চলা সরু রাস্তা ছিল। তারপরও লতাপাতা সরিয়ে সরিয়ে হাটা লগছিল। সামনের দিকে জঙ্গল আর ঘন হয়েছে। সেদিকে আর কোন রাস্তা না পাওয়ার আমরা আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ফিরতি পথে যেখানে পার্কের এরিয়ার বাইরে যাওয়ার রাস্তা দেখেছিলাম, সেখানে এসে পৌছলাম। আমরা সেদিক দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলাম।
কিছুদুর যাওয়ার পর ধানক্ষেত দেখতে পেলাম, আর দুরে গারো আদিবাসিদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। কিছুদুর চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমার মাটির বড় রাস্তা দেখতে পেলাম। সেই রাস্তা ধরেই হাটা শুরু করলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর মাঠে কর্মরত এক গারো পুরুষ লোকের দেখা পেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই রাস্তা দিয়ে ইকোপার্কের সামনে বের হওয়া যাবে কিনা? সে বলল যাবে। আমরাও হাটতে লাগলাম আর চারিদিকের ছবি তুলছিলাম। এই রাস্তাটা ছিল পাহাড়ের একেবারে কোল ঘেষা। কিছুদুর যাওয়ার পর একটা সাইনবোর্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- সাবধান হাতির সামনে হাতির বিচরণ এলাকা। এই দেখে আমর কলিগকে আর পাইকে। সে বলল ভাই চলেন ফিরে যাই, যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়েই ফিরে যাই।
আমি তাকে একটু সাহস দেয়ার জন্য বললাম- আরে কি যে বলেন, হাতি কি সবসময় আসে নাকি? মাঝে মাঝে আসে, চলেন যাই সামনে কোন অসুবিধা নেই। এই বলে নিজের বুক কাঁপা শুরু করল। কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে সামনে দিকে যাওয়া শুরু করলাম। পথে একজন লোকের সাথে দেখা হল। আমরা হাতির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন হ্যা হাতি প্রায়ই আসে এবং ফসল খেয়ে যায়। আমি বললাম তখন আপনারা কি করেন? সে বলল- হাতিগুলো সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। তখন আমরা তাদের তাড়ানোর জন্য মশাল জ্বালিয়ে ভয় দেখায়। কিছু দুরের একটা ক্ষেত দেখিয়ে বলল গত সম্পাহে একপাল হাতি এসে ঐ ক্ষেতের ধান সব খেয়ে ফেলেছে।
এই সব শুনে আবার আমরা আগাতে লাগলাম। সামনে আরও একজনের সাথে দেখা হল। তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম- ভাই সীমানার ওপারে যে বিএসএফ ক্যাম্প আছে সেটা দেখতে যেতে চাই কিভাবে যাব? উনার তো এই কথা শুনে চক্ষু ছানবড়া হয়ে গেল। সে বলল- পাগল হইছেন নাকি? আর গুলি খাওয়ার ইচ্ছা হইছে নাকি? এইসব বলে সে চলে গেল। আমি আমার কলিগকে বললাম ভাই এত চিন্তার কিছু নেই, ওরা সবাইকে গুলি করে না। শুধুমাত্র যারা চোরাকারবারী তাদের কে গুলি করে। আমার অবশ্য ক্যাম্প দেখতে যাওয়ার কিছু কারণ ছিল। তা হল- পার্কের বাইরে এই পাহাড় পুরোপুরি জঙ্গল এলাকা, মানুষের পদচারণা কম তাই একটু এ্যাডভেঞ্চার নেওয়ার স্বাদ আরকি। যাই হোক কলিগকে রাজি করাতে পারলাম না। বিষন্ন মন নিয়ে সামনে যখন যাচ্ছি তখন একদল পর্যটকের দেখা মিলল। তাদের সাথে টুকটাক পরিচয় হল। তারা সবাই শেরপুর থেকে এসেছিল। তারা দলে প্রায় ১৫-২০ জন ছিলেন। তারাও দেখি এক আদিবাসীর সাথে আলাপ আলোচনা করছে।
এই আদিবাসীটি অবশ্য অন্য সবার মত ভয় দেখায়নি। সে বলল কিভাবে বিএসএফ ক্যাম্পে যাওয়া যায় তার একটা পথ বাতলে দিল। শেরপুর থেকে আসা দলটির মধ্যে আবার দুই ভাগ হয়ে গেল। খুব নগন্য সংখ্যক লোক যাওয়ার জন্য রাজি হল। কিন্তু তারা কেউই এগোচ্ছিল না। আমি তাদের কে একটু সাহস দেয়ার চেষ্টা করলাম। মনে মনে ভাবলাম আমার কলিগতো রাজি হচ্ছে না পাছে এখান থেকে কিছু লোক সাথে পাওয়া গেলে কলিগও আর না বলতে পারবে না। বেশ কিছুক্ষন তাদের সঙ্গে কথা বলে একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। পরে আমার ও মনে জিদ চেপে বসল। আমি আমার কলিগকে বললাম- ভাই চলেন, যা হওয়ার তাই হবে। এটা কোন ব্যাপার না। এখানকার আদিবাসী লোকজন যদি যেতে পারে, তাহলে আমাদের আর কি সমস্যা?
যাই হোক অনেক কষ্টে একপ্রকার জোর করে ধরেই তাকে নিয়ে বিএসএফ ক্যাম্প অভিমুখে গহীন জঙ্গলের পথ ধরে আগাতে শুরু করলাম। আমরা কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম আমাদের দুজনের দেখাদেখি শেরপুর থেকে আসা দলের কয়েকজন অতি উৎসাহী আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগল। আমরাও ভাবলাম যাক খারাপ না। চারিদিকে গাছপালা অনেক ঘন হতে শুরু করল আর রাস্তাও অনেক সরু হতে লাগল। ঐ পথে যেতে যেতেও আমরা দুয়েকজন মানুষ পেলাম যারা বনে কাঠ সংগ্রহ করতে এসেছে। তাদের কাছে আরও পথের বিস্তারিত জানা গেল। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে যখন চলছিলাম তখন প্রায় ২০ মিনিট পর সামনে দেখি আমাদের পথ বন্ধ করে দিয়েছে পানি আর কাদা। আমরা গিয়েছিলাম জুতা মুজা পরে। আমি বললাম এতদুর এসে নিশ্চই ফিরে যাব না? তাই আমরা জুতা মুজা খুলে পানির রাস্তাটুকু পার হলাম। আবার হাটা শুরু করলাম। রাস্তা সরু থেকে আরও সরু হচ্ছিল। এতক্ষন যে চিকন পায়ে চলার রাস্তা দেখা যাচ্ছিল তা আর দেখা যাচ্ছিল না।
আমরা গাছের লতাপাতা হাত দিয়ে সরাতে সরাতে বনের আরও গভীরে যাচ্ছিলাম। যে আদিবাসী আমাদের পথের হদিস দিয়েছিল তার তথ্য মতে এবার আমাদের পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে হবে। আমারা পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু করলাম। পাহাড়ের একেবারে উপরে পৌছে দেখলাম কিছুটা দুরে ভারতীয় বিএসএফ এর ক্যাম্প। জঙ্গল এখানে অনেক বেশী ঘন হওয়ায় দেখতে একটু কষ্ট করতে হচ্ছিল। পাহাড়ের চুড়ায় উঠতে পেরে আর ভারতীয় বিএসএফ ক্যাম্প দেখতে পেরে আমাদের সবার মধ্যে একটা জয় করার আনন্দ বিরাজ করছিল।
যেহেতু বেলা বয়ে যাচ্ছিল তাই আমরা কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ফিরতি পথে যে লোক আমাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল তার সাথে আবার দেখা হল। সে তখন বিশ্রাম নিচ্ছিল আর বিড়ি ফুকছিল। আমাদের মধ্যকার বিড়ি ফোকাররা তার কাছ থেকে স্থানীয় বিড়ি চেয়ে নিল। তারপর আমরা হাটতে হাটতে মধুটিলা ইকো পার্কের সামনে চলে আসলাম। পার্কের গেটের সামনে কিছু হোটেল ছিল। আমরা বেশ সস্তায় দুপুরের খাবার খেলাম প্রায় ৪ টার সময়। আসার সময় আমরা নালিতাবাড়ি হয়ে এসেছিলাম এবার আর সে রাস্তা দিয়ে গেলাম না। আমরা নন্নি হয়ে চলে গেলাম শেরপুর শহরে। সেখান থেকে ঢাকার বাস ধরে ঢাকা পৌছলাম। গাজীপুর চৌরাস্তায় আর টঙ্গি অনেক জ্যাম ছিল বিধায় বাসায় পৌছাতে পৌছাতে প্রায় রাত ১১টা বেজে গিয়েছিল।
দুদিন পর পর মন শুধু ছটফট করে। শুধু মনে হয় কোথায় যাই কোথায় যাই। কোথাও যে যাব তা আবার ভারী কঠিন ব্যাপার। একা একা যাওয়ার মধ্যে বেশ কিছু সমস্যা আছে। সর্বদা চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আমার মত অলসের কাছে এই কাজ খুব যন্ত্রণাদায়ক। বেড়াতে গেলে আমি ভাই দায়িত্বের যাবতীয় বোঝা অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা মানুষ। অচেনা কোন গ্রুপের সাথে গেলেও কাউকে না কাউকে পেয়েই যাই, যার কাধে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরাঘুরি করি।
দায়িত্বজ্ঞানের কথা যখন আসল তখন ছোট একটা গল্প বলা যাক। একবার হল কি, ছোট বোনকে নিয়ে দেশের বাড়িতে যাব। সকাল ৮টায় গাড়ি। বিশাল দায়িত্ব নিয়ে ৭:২০ এ ঘুম থেকে উঠলাম। গোসল, খাওয়া সারতে সারতে ৭:৪০। উত্তরা ৪ নং সেক্টর থেকে রওনা দিলাম আব্দুল্লাহপুর বাসষ্ট্যান্ড যাব বলে। হাউজবিল্ডিং এর কাছে যখন রিকশায় জ্যামে ঠেকলাম তখন ৮:০০ বাজে। ভাবলাম, বাস তো একটু দেরী করেই আসে। আর যে জ্যাম দেখছি তাতে তো অবশ্যই দেরী করা উচিৎ।
তো যাহোক মহাদায়িত্ব নিয়ে যখন কাউন্টারে পৌছলাম তখন ঘড়ির কাটা বলছে ৮:১৫। এ আর এমন কি দেরী। লোকে তো আরও কত দেরী করে। সর্বদা গোমড়া মুখে বসে থাকা কাউন্টারের লোকটাকে যখন সুধালাম ওমুক নম্বর গাড়ি কখন আসবে? আমার কথা শুনে লোকটা আকাশ থেকে না মনে হল অন্যা কোন গ্যালাক্সি থেকে পড়ল। কিছুক্ষণ পর বিরস কন্ঠে বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? মনে মনে বললাম কেন রিকশায় ছিলাম। আবার বলতে শুরু করল- বাস ঠিক আটটায় এসে আপনাদের জন্য ১০ মিনিট অপেক্ষা করে চলে গিয়েছে। তারা আর কোন ব্যবস্থা করতে পারবেনা। অগত্যা নতুন করে টিকিট কাটতে হল পরের বাসে। গুনে গুনে ৯৬০ টাকা পকেট থেকে বের হয়ে গেল। আগের দিন দুলাভাই টিকিট করে দিয়েছিল, এবার লেও ঠ্যালা। তো এই হচ্ছে আমার দায়িত্বজ্ঞান (নিজেকে কি একটু বেশী পঁচানি দিলাম? যাওজ্ঞা সামনের দিকে আউজ্ঞা, সবতো আমরা আমরাই)।
যাই হোক বেড়াতে গেলে বন্ধু বান্ধব, কলিগ, বড় ভাই কাউকেই পাওয়া যায় না (যারা অন্তত শেয়ারে কিছু কন্ট্রিবিউট করতে পারে)। কি জানি কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার আশে পাশের মানুষগুলো বড্ড ভ্রমণ বিমুখ। কাউকেই এ ব্যাপারে রাজি করানোর চেয়ে দুবার এভারেষ্টে চড়া সহজ। তো অনেক বলে কয়ে, ১ সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ব্লগের বিভিন্ন জনের লেখা পড়িয়ে আমার কলিগকে রাজি করালাম গারো পাহাড় দেখতে যাওয়ার জন্য। বাজেট তুলনামুলক কমে হওয়ায় এই প্যাকেজে তার রাজী হওয়ার অন্যতম কারণ।
আগেরদিন আলাপ আলোচনা সব শেষ করে যে যার মত বাড়ি চলে গেলাম। ওহ তার আগে আমরা অবশ্য মহাখালি বাসষ্টান্ডে গিয়ে গাড়ির খোজ খবর নিয়ে এসে ছিলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম সরাসরি নালিতাবাড়ি যায় এমন গাড়ির। নালিতাবাড়ি এক্সপ্রেস (শিউর না, ভুলে গেছি, আমার মেমরি খুব খারাপ) নামে গাড়িটি সবার আগে অর্থাৎ ৬ টায় ছাড়ে। আমার কলিগ মহাখালি বাসষ্টান্ড থেকেই উঠবে আর আমি উঠব উত্তরা থেকে। কথাবার্তা ঠিক করে সবাই বাড়ি চলে গেলাম। ভোরে সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল খাওয়া সেরে যথাসময়ে উত্তরা বাসস্টপে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কলিগের সাথে ফোনে আলাপ হয়ে গিয়েছে। সে বলল গাড়ি ঠিক সময়মত ছেড়েছে। উত্তরায় গাড়ি পৌছাতে ২০ মিনিট মত সময় লাগল। গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম। কিছু শুকনা খাবার নিয়ে নিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ওগুলো খাওয়া হল। গাড়ি মোটামুটি ভরাই ছিল আর সকালবেলা এবং ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তাও ছিল জ্যামমুক্ত। ভালই চলছিল গাড়ি। ময়মনসিংহ হয়ে গাড়ি নালিতাবাড়ি যাবে। এই বাসে যাওয়ার সুবিধা হল শেরপুর শহরে যাওয়া লাগবে না।
ময়মনসিংহ শহরে পৌছানোর আগে আমাদের গাড়ি একটা ব্রেক দিল ২০ মিনিটের। আমরা দুজন বাস থেকে নেমে ছোট টম দোকান থেকে চা বিড়ি খাওয়া শুরু করলাম। কিছুক্ষন সেলফি টেলফি তুলে আবার বাসে উঠে পড়লাম। আবার বাস গড়াতে শুরু করল। কিছু সময় পর আমরা ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করলাম। ময়মনসিংহ শহর দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, বিশেষ করে ব্রক্ষপুত্র নদীটাকে। অনেক আগে তসলিমা নাসরিন পড়েছিলাম। সেখানে ময়মনসিংহ আর ব্রক্ষপুত্র নদীর বর্ণনা ছিল। সেই নদী দেখার সাধ এতদিন পর কিছুটা মিটল। নদীর উপর ব্রিজ যখন পার হচ্ছিলাম তখন যতটুকু পারা যায় নদীটাকে ভালভাবে দেখে নিচ্ছিলাম আর মনে মনে শিহরিত হচ্ছিলাম।
যা হোক ফুলপুর পার হওয়ার পর রাস্তা অনেক সরু হয়ে আসল আর যেখানে সেখানে ভাঙ্গা ছিল। বেশ ঝাকুনি হচ্ছিল। অবশেষে একসময় ঝাকুনি খেতে খেতে নালিতাবাড়ি এসে পৌছলাম। নালিতাবাড়ি এসে যখন পৌছলাম তখন প্রায় সকাল ১০ টা বেজে গিয়েছে। আমরা নেমে প্রথমে কিছু খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। তারপর এর ওর কাছে শুনলাম কিভাবে মধুটিলা ইকো পার্কে যাওয়া যাবে। একজন বলল কিছুদুর হাটার পর মেইন বাজার পড়বে সেখান থেকে আপনি শেয়ারে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাতেও যেতে পারেন আবার মটরসাইকেল ভাড়া করেও যেতে পারেন। আমারা বাজারে গিয়ে প্রথমে কোন অটোরিকশা দেখলাম না। তবে কিছু মটরসাইকেল দেখতে পেলাম। আমাদের দেখে উৎসুক মটরসাইকেল ড্রাইভাররা ভিড় করতে লাগল। আমাদের ও খুব তাড়া ছিল কেননা আমাদের আর দিনের দিন ঢাকা ফিরতে হবে। দ্রুত যাওয়া যাবে বলে আমরা ২০০ টাকা দিয়ে মটরসাইকেল ভাড়া করলাম। চুক্তি হল একদম মধুটিলা ইকোপার্কের সামনে নামিয়ে দিবে। মটরসাইকেলের ছিট বেশ প্রশস্তই ছিল তাই তিন জন (ড্রাইভারসহ) বসতে তেমন কষ্ট হল না।
ছোট সরু রাস্তা বেয়ে এঁকেবেকে চলতে শুরু করল আমাদের মটরসাইকেল। পথিমধ্যে এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাজার নন্নি পড়ল। গ্রাম্য বাজার হিসেবে বাজারটা বেশ জমজমাট ছিল। ও হ্যা আমাদের অটোরিকশা না নেওয়ার আর একটা কারণ ছিল। সেটা হল কোন অটোই সরাসরি মধুটিলা যাচ্ছিল না। তারা কেবল বলছিল নন্নি যাবে। আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা মটরসাইকেল ভাড়া করেছিলাম। আসলে নন্নি এসে অটো চেঞ্জ করে আবার মধুটিলা যাওয়া যেত। যারা মধুটিলাই যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন কম খরচে তাদের মনে এই তথ্য কাজে লাগবে। যা হোক একসময় আমরা পৌছে গেলাম মধুটিলা ইকোপার্কে। পার্কে ঢোকার মুখে টিকিট কাটতে হল। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল পুরো ইকোপার্কের ম্যাপ। আমরা ভালমত ম্যাপটা দেখে নিলাম যাতে করে ঘুরতে সুবিধা হয়। অফ সিজন হওয়ার দর্শনার্থীদের তেমন কোন ভিড় ছিল না। তবুও একটা বাস দেখলাম অনেক দর্শনার্থী নিয়ে ঘুরতে এসেছে। আমরা হাটতে শুরু করলাম।
বেশ সুন্দর জায়গা। আশেপাশে প্রচুর গাছগাছালী তার মধ্যে দিয়ে ছোট ছোট ওয়াক ওয়ে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন বেশ গরম ছিল। কিন্তু পার্কের মধ্যে প্রচুর গাছপালা থাকায় গরম কি জিনিস ভুলে গেলাম। তারপর আবার উচু নিচু ঢালু রাস্তা ছিল। আমরা কিছুদুর সামনে গিয়ে বায়ে মোড় নিলাম। কারণ ওয়াচ টাওয়ার টা ছিল এই দিকেই। আমরা শুধু হাটছিলাম না সাথে চলছিল সমানে ছবি তোলা। দুজন বিভিন্ন এঙ্গেলে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছিলাম। ওয়াচ টাওয়ারটা ছিল একটা ছোট টিলার উপর। ওয়াচ টাওয়ারের কাছে আসতেই মানুষজন চোখে পড়ল। সেখানে আবার স্থানীয় মানুষজন বিভিন্ন খাবারদাবার আর ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসেছিল। পার্কে এই যায়গাটায় একটু মানুষজন চোখে পড়ল। অফ সিজন হওয়ায় পুরো পার্ক একপ্রকার ফাকায় ছিল।
ওয়াচ টাওয়ারে উঠতে আবার টিকিট কাটতে হল। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দুচোখ জুড়িয়ে গেল। আশেপাশের দৃশ্য এত অসাধারণ ছিল যে বর্ণনা করে বলা সম্ভব না। উচু নিচু পাহাড় আর সবুজ গাছপালা দেখে পুরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শুধুমাত্র তখনই মনে হল এখানে আসা পুরোপুরি সার্থক। ওয়াচ টাওয়ারে উঠলে আশেপাশের পুরো এলাকা চোখে পড়ে এমনকি দুরে মেঘালয় রাজ্যের বিএসএফ ক্যাম্প ও দেখা যায়। ওয়াচ টাওয়ারের উপর টাকার বিনিময়ে দুরবিন দিয়ে বিএসএফ এর ক্যাম্প এবং দুরের মেঘালয় দেখার সুযোগ ছিল। আমরা দুরবিন দিয়ে পুরো এলাকাটা দেখছিলাম। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আবার নীল আকাশের শুরু। আকাশটা যেন উল্টানো বাটির মত লাগছিল।
নীল আকাশে আবার প্রচুর সাদা মেঘ ছিল। সবুজ অরণ্যের উপর নীল আকাশে সাদা মেঘ দেখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম “আজ নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা”। ওয়াচ টাওয়ারে প্রকৃতি দেখা শেষ করে আবার আমরা নীচে নেমে পার্কের এরিয়া ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। কিছুদুর হাটার পর পার্কের এরিয়ার বাইরে বের হওয়ার একটা রাস্তা চোখে পড়ল। তার্ ওপারে আবার উচু পাহাড় আর জঙ্গল চোখে জড়ল। আবার পাহাড়ে চড়ার খুব নেশা। কলিগকে বললাম চলেন ঔ উচু পাহাড়ে চড়া যাক। সে তো কিছুতেই রাজি নয়। এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেলাম। খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে গেলাম। অবশ্য পায়ে চলা সরু রাস্তা ছিল। তারপরও লতাপাতা সরিয়ে সরিয়ে হাটা লগছিল। সামনের দিকে জঙ্গল আর ঘন হয়েছে। সেদিকে আর কোন রাস্তা না পাওয়ার আমরা আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ফিরতি পথে যেখানে পার্কের এরিয়ার বাইরে যাওয়ার রাস্তা দেখেছিলাম, সেখানে এসে পৌছলাম। আমরা সেদিক দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলাম।
কিছুদুর যাওয়ার পর ধানক্ষেত দেখতে পেলাম, আর দুরে গারো আদিবাসিদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। কিছুদুর চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমার মাটির বড় রাস্তা দেখতে পেলাম। সেই রাস্তা ধরেই হাটা শুরু করলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর মাঠে কর্মরত এক গারো পুরুষ লোকের দেখা পেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই রাস্তা দিয়ে ইকোপার্কের সামনে বের হওয়া যাবে কিনা? সে বলল যাবে। আমরাও হাটতে লাগলাম আর চারিদিকের ছবি তুলছিলাম। এই রাস্তাটা ছিল পাহাড়ের একেবারে কোল ঘেষা। কিছুদুর যাওয়ার পর একটা সাইনবোর্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- সাবধান হাতির সামনে হাতির বিচরণ এলাকা। এই দেখে আমর কলিগকে আর পাইকে। সে বলল ভাই চলেন ফিরে যাই, যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়েই ফিরে যাই।
আমি তাকে একটু সাহস দেয়ার জন্য বললাম- আরে কি যে বলেন, হাতি কি সবসময় আসে নাকি? মাঝে মাঝে আসে, চলেন যাই সামনে কোন অসুবিধা নেই। এই বলে নিজের বুক কাঁপা শুরু করল। কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে সামনে দিকে যাওয়া শুরু করলাম। পথে একজন লোকের সাথে দেখা হল। আমরা হাতির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন হ্যা হাতি প্রায়ই আসে এবং ফসল খেয়ে যায়। আমি বললাম তখন আপনারা কি করেন? সে বলল- হাতিগুলো সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। তখন আমরা তাদের তাড়ানোর জন্য মশাল জ্বালিয়ে ভয় দেখায়। কিছু দুরের একটা ক্ষেত দেখিয়ে বলল গত সম্পাহে একপাল হাতি এসে ঐ ক্ষেতের ধান সব খেয়ে ফেলেছে।
এই সব শুনে আবার আমরা আগাতে লাগলাম। সামনে আরও একজনের সাথে দেখা হল। তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম- ভাই সীমানার ওপারে যে বিএসএফ ক্যাম্প আছে সেটা দেখতে যেতে চাই কিভাবে যাব? উনার তো এই কথা শুনে চক্ষু ছানবড়া হয়ে গেল। সে বলল- পাগল হইছেন নাকি? আর গুলি খাওয়ার ইচ্ছা হইছে নাকি? এইসব বলে সে চলে গেল। আমি আমার কলিগকে বললাম ভাই এত চিন্তার কিছু নেই, ওরা সবাইকে গুলি করে না। শুধুমাত্র যারা চোরাকারবারী তাদের কে গুলি করে। আমার অবশ্য ক্যাম্প দেখতে যাওয়ার কিছু কারণ ছিল। তা হল- পার্কের বাইরে এই পাহাড় পুরোপুরি জঙ্গল এলাকা, মানুষের পদচারণা কম তাই একটু এ্যাডভেঞ্চার নেওয়ার স্বাদ আরকি। যাই হোক কলিগকে রাজি করাতে পারলাম না। বিষন্ন মন নিয়ে সামনে যখন যাচ্ছি তখন একদল পর্যটকের দেখা মিলল। তাদের সাথে টুকটাক পরিচয় হল। তারা সবাই শেরপুর থেকে এসেছিল। তারা দলে প্রায় ১৫-২০ জন ছিলেন। তারাও দেখি এক আদিবাসীর সাথে আলাপ আলোচনা করছে।
এই আদিবাসীটি অবশ্য অন্য সবার মত ভয় দেখায়নি। সে বলল কিভাবে বিএসএফ ক্যাম্পে যাওয়া যায় তার একটা পথ বাতলে দিল। শেরপুর থেকে আসা দলটির মধ্যে আবার দুই ভাগ হয়ে গেল। খুব নগন্য সংখ্যক লোক যাওয়ার জন্য রাজি হল। কিন্তু তারা কেউই এগোচ্ছিল না। আমি তাদের কে একটু সাহস দেয়ার চেষ্টা করলাম। মনে মনে ভাবলাম আমার কলিগতো রাজি হচ্ছে না পাছে এখান থেকে কিছু লোক সাথে পাওয়া গেলে কলিগও আর না বলতে পারবে না। বেশ কিছুক্ষন তাদের সঙ্গে কথা বলে একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। পরে আমার ও মনে জিদ চেপে বসল। আমি আমার কলিগকে বললাম- ভাই চলেন, যা হওয়ার তাই হবে। এটা কোন ব্যাপার না। এখানকার আদিবাসী লোকজন যদি যেতে পারে, তাহলে আমাদের আর কি সমস্যা?
যাই হোক অনেক কষ্টে একপ্রকার জোর করে ধরেই তাকে নিয়ে বিএসএফ ক্যাম্প অভিমুখে গহীন জঙ্গলের পথ ধরে আগাতে শুরু করলাম। আমরা কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম আমাদের দুজনের দেখাদেখি শেরপুর থেকে আসা দলের কয়েকজন অতি উৎসাহী আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগল। আমরাও ভাবলাম যাক খারাপ না। চারিদিকে গাছপালা অনেক ঘন হতে শুরু করল আর রাস্তাও অনেক সরু হতে লাগল। ঐ পথে যেতে যেতেও আমরা দুয়েকজন মানুষ পেলাম যারা বনে কাঠ সংগ্রহ করতে এসেছে। তাদের কাছে আরও পথের বিস্তারিত জানা গেল। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে যখন চলছিলাম তখন প্রায় ২০ মিনিট পর সামনে দেখি আমাদের পথ বন্ধ করে দিয়েছে পানি আর কাদা। আমরা গিয়েছিলাম জুতা মুজা পরে। আমি বললাম এতদুর এসে নিশ্চই ফিরে যাব না? তাই আমরা জুতা মুজা খুলে পানির রাস্তাটুকু পার হলাম। আবার হাটা শুরু করলাম। রাস্তা সরু থেকে আরও সরু হচ্ছিল। এতক্ষন যে চিকন পায়ে চলার রাস্তা দেখা যাচ্ছিল তা আর দেখা যাচ্ছিল না।
আমরা গাছের লতাপাতা হাত দিয়ে সরাতে সরাতে বনের আরও গভীরে যাচ্ছিলাম। যে আদিবাসী আমাদের পথের হদিস দিয়েছিল তার তথ্য মতে এবার আমাদের পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে হবে। আমারা পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু করলাম। পাহাড়ের একেবারে উপরে পৌছে দেখলাম কিছুটা দুরে ভারতীয় বিএসএফ এর ক্যাম্প। জঙ্গল এখানে অনেক বেশী ঘন হওয়ায় দেখতে একটু কষ্ট করতে হচ্ছিল। পাহাড়ের চুড়ায় উঠতে পেরে আর ভারতীয় বিএসএফ ক্যাম্প দেখতে পেরে আমাদের সবার মধ্যে একটা জয় করার আনন্দ বিরাজ করছিল।
যেহেতু বেলা বয়ে যাচ্ছিল তাই আমরা কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ফিরতি পথে যে লোক আমাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল তার সাথে আবার দেখা হল। সে তখন বিশ্রাম নিচ্ছিল আর বিড়ি ফুকছিল। আমাদের মধ্যকার বিড়ি ফোকাররা তার কাছ থেকে স্থানীয় বিড়ি চেয়ে নিল। তারপর আমরা হাটতে হাটতে মধুটিলা ইকো পার্কের সামনে চলে আসলাম। পার্কের গেটের সামনে কিছু হোটেল ছিল। আমরা বেশ সস্তায় দুপুরের খাবার খেলাম প্রায় ৪ টার সময়। আসার সময় আমরা নালিতাবাড়ি হয়ে এসেছিলাম এবার আর সে রাস্তা দিয়ে গেলাম না। আমরা নন্নি হয়ে চলে গেলাম শেরপুর শহরে। সেখান থেকে ঢাকার বাস ধরে ঢাকা পৌছলাম। গাজীপুর চৌরাস্তায় আর টঙ্গি অনেক জ্যাম ছিল বিধায় বাসায় পৌছাতে পৌছাতে প্রায় রাত ১১টা বেজে গিয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৯