যে দেশের আশি ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। ভাত যেখানে প্রধান খাদ্য। অথচ সেই ভাত রান্নাতেই সবচেয়ে বড় অপচয়। হিসাব করে দেখা গেছে, বছরে এর পরিমাণ প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা। তথ্যটি শুনে যে কেউ অবাক হবেন। যে টাকায় একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। সেই বিপুল অঙ্কের টাকার অপচয় হচ্ছে ভাত রান্নাতেই। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি? খাতা কলমে তাই হাজির করেছেন গাজী রফিক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে পড়াশুনা করে যোগ দেন পিআইবিতে। কাজ করছেন স্টাফ রাইটার পদে। কিভাবে মানুষের কল্যাণ করা যায় এমন চিন্তা থেকেই এর সূত্রপাত। গাজী রফিক মূলত কবি হলেও কবিতার ফাঁকে ফাঁকেই করেছেন গবেষণা। প্রথম প্রথম এই তত্ত্ব নিয়ে হাসি টাট্টাও হয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ ইনস্টিটিউট, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং মনিটরিং ইউনিট (এফপিএমইউ), আইসিডিডিআর,বি’ ছুটে গেছেন। বিশাল অঙ্কের এই অপচয়ের কোন তথ্য তাদের জানা আছে কিনা? সরকারের খাদ্য বিভাগতো একেবারে অবিশ্বাস্য। পাশাপাশি তাদের এ বিষয়ক কোন তথ্য জানা নেই বলে জানিয়ে দেন। কৌতূহলি গাজী রফিক দমলেন না। আশপাশের এশিয়ার দেশসমূহে খোঁজ নিলেন। চালের উৎপাদন ও ব্যবহারের বহুমুখিতা নিয়ে নানা গবেষণা টেবিলে হাজির করলেন। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে মাড়-ভাতের প্রচলন। কিন্তু চীন বা জাপানে এ পদ্ধতিতে ভাত রান্না হয় না। অথচ চীনেই দুনিয়ার চার ভাগের একভাগ ধান চাষ হয়। যেহেতু চীনে বসাভাতের রীতি সুতরাং তাদের অপচয়ও নেই। এর বাইরে রাইস কুকারে রান্নায় এ জাতীয় অপচয় নেই। এই যে বিশাল অপচয়, এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। এমন অভিব্যক্তি নিয়ে রফিক জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই হোস্টেলে থেকেছেন বছরের পর বছর। হোস্টেলে বেশির ভাগ সময় নিজেই রান্না করতেন। হিটারে চাল রান্নার নানা ধরন তখন থেকেই ক্ষতির কম বেশি নিয়ে রপ্ত হন। তাড়াহুড়ায় রান্নায় সহজ ও অপচয় নেই বসাভাতে। যা আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী কখনও খেয়াল করেনি। পরে ঢাকায় ডিএফপিতে চাকরি নিলেও ভাতের বিশাল এ অপচয় গাজী রফিকের মাথা থেকে সরেনি। বাড়িতে মায়ের হাতে রান্নাভাত নিয়েও আপন খেয়ালে মগ্ন থেকেছেন। বারবার পরীক্ষায় দেখেছেন মাড়-ভাতে যে পরিমাণ চালে ভাতের ওজন তার চেয়ে বসাভাতে ভাতের ওজন অনেক বেশি। আর অপচয়ের রহস্য এখানেই লুকিয়ে রয়েছে। দু’বছর ধরে গবেষণা করে ‘বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগে রান্নায় চালের ওজনগত অসমতা’ বিষয়ে তত্ত্ব হাজির করেন। আর কখনও মাড় ফেলা পদ্ধতিতে আবার কখনও পানি কম দিয়ে বসা পদ্ধতিতে অর্থাৎ মাড়সহ একের পর এক নিরীক্ষা চলে নিজ বাসাতেই। আর ভাতের অপচয় রোধে। ওজনগত অসমতা নিয়ে গবেষণার সূচনা এভাবেই। যে কেউ খুব সহজে এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন চালের অপচয় কোন পদ্ধতি প্রয়োগে কম হয়। এ পদ্ধতি উদ্ভাবন শেষে গাজী রফিক আবারও যোগাযোগ করেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাও কর্মকর্তা আবদুল মান্নান একে ইউরেকা বলে স্বীকৃতি দেন। বলেন, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান। পরে কপিরাইট আইনে এ পদ্ধতি নিবন্ধিত হয়। এর প্রচারে আয়োজন করা হয় সেমিনারও। এ পর্যন্তই। চালের বহু ব্যবহারের এই দেশে যদি বসাভাত পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করা যায় প্রতিদিনের বিপুল অপচয় হ্রাসে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
ওজনগত অসমতা পদ্ধতি
মাড়ফেলা পদ্ধতি ও বসা পদ্ধতিতে ভাত রান্নায় রান্নার তৃতীয় স্তরে চাল রান্নার মাধ্যমে ভাতে রূপান্তরে অপচয়ের নতুন এই পদ্ধতি প্রয়োগে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে চালের চাহিদা দুই কোটি পঞ্চাশ লাখ তিপান্ন হাজার ছয় শত টন। মাড় ফেলতে গিয়ে সেকেলে পদ্ধতির কারণে ১%-১.৫০% ভাত মাড়ের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু বসাভাতে তা সম্ভব নয়। উল্টো বসাভাতে গড়ে ১ লাখ টন চাল অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। মোটামুটি ৪২-৫১ লাখ টনের সম্ভাব্য এ সাশ্রয় সুবিধাটি ভোগ করতে পারবে চালের ভোক্তা দেশের দরিদ্র প্রান্তিক পর্যায়ের প্রতিটি নাগরিক। তাছাড়া বসাভাতের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন থাকায় মাড়ফেলা ভাতের থেকে কিছুটা কম খেলেও স্বাস্থ্য নষ্ট হবে না। নষ্ট হওয়া ১৩-১৫% চাল অর্থাৎ ৪২-৫১ লাখ টন চাল অপচয় হচ্ছে। যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় বছরে ১৬৮০০-২০৪০০ কোটি টাকা (গড়ে ৪০ টাকা কেজি দরে)। তাতে যে ১৩ লাখ (কম/বেশি হতে পারে) টন চাল প্রতিবছর আমদানি করতে হয় তা প্রয়োজন হবে না। দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় এটি হবে বড় মাপের অর্জন। দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের খাদ্য তালিকা মূলত চালের উপর নির্ভরশীল। দুই পদ্ধতিতে এ অঞ্চলের মানুষ ভাত রান্না করে থাকে। এক. অতিরিক্ত পানিতে চাল সিদ্ধ করে মাড় ফেলে। দুই. পরিমিত পানিতে চাল সিদ্ধ করে রান্না। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অভ্যাসবশত মাড়ফেলা পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এ পদ্ধতিতে রান্না করে অতিরিক্ত পানি (মাড়) ফেলে দিলে তার সঙ্গে প্রায় ১৯ রকমের পুষ্টি উপাদান এবং শর্করার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হারিয়ে যায়। বর্তমান গবেষণায় সরাসরি চালের অস্তিত্বের একটি মাত্রা মাড়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়। মাড় ফেলা পদ্ধতিতে ভাত রান্নার কারণে চাল অপচয়ের মাত্রা ১৩-১৫ শতাংশ। পদ্ধতিতে রান্নার প্রচলনকে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ অঞ্চলে জনপ্রিয় করা গেলে পুষ্টিঘাটতি দূর হওয়ার পাশাপাশি মোট জনসংখ্যার চাহিদার ১৩-১৫% সাশ্রয়ের মাধ্যমে ৪২-৫১ লাখ টন চালের অপচয় রোধ সম্ভব হবে। আঙ্কটাডের ২০০৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পৃথিবীতে চালের উৎপাদন ৪০৬.০৬৮ টন। ১% গ্রোথ হারে ২০১১ তে উৎপাদন দাঁড়ায় ৪৩৪.৪৯২ টনে। আর পৃথিবীর ৯০% চাল এশিয়া উৎপাদন ও ভোগ করে। চায়নার কনজামশন মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশের বেশি। অর্থাৎ ১১ কোটির উপরে। চীন, জাপানসহ কয়েকটি দেশে বসাভাত প্রচলিত, তাহলে ৯০%-এর বাকি চাল ২৮১ টন। ২৮১ টন থেকে মোটামুটি দাঁড়াতে পারে ৩-৪ কোটি টন। মাড় ফেলা পদ্ধতিতে ভাত রান্নার প্রবণতার কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশসহ এসব দেশে বসাভাত পদ্ধতি জনপ্রিয় করার মাধ্যমে এ ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব।
আর বসাভাত পদ্ধতিতে প্রতিবছর গড়ে ৩০-৩৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে যা রপ্তানির মাধ্যমে বাড়তি আয় সম্ভব। অপচয় মোকাবিলা করতে পারলে বাংলাদেশ খুব সহজেই নাম লিখাতে পারবে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশের তালিকায়। আর এ থেকে সম্ভাব্য আয় হতে পারে ১৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ২১৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার (১ ডলার ৭৪ টাকা হারে ২০১১)। সুবিধাভোগী হবে সরাসরি প্রান্তিক পর্যায়ের প্রতিটি দরিদ্র মানুষ পর্যন্ত। আমাদের অর্থনীতি হবে শক্তিশালী। সামগ্রিক সুবিধা হতে পারে সম্ভাব্য ২৪১ কোটি ৫০ লাখ ২৯৩ কোটি ২৫ লাখ মার্কিন ডলারের। বাঁচবে বৈদেশিক মুদ্রা ৭৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, সামপ্রতিক ক্রয় মূল্য অনুযায়ী। পুষ্টিভাত বা বসাভাত পদ্ধতি সফল হলে বছরে ৪২-৫১ লাখ টন চাল অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির নতুন অধ্যায় সূচিত হবে বাংলাদেশে।
পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি
এক কেজি কলে ছাঁটা সেদ্ধ চালকে ৫০০ গ্রাম করে দুই ভাগে বসা ও মাড় ফেলা পদ্ধতিতে চাল রান্না করে তা ওজন করলেই পার্থক্য বেরিয়ে আসবে। বসাভাতে চালের অপচয় কি পরিমাণ আর মাড়ভাতে অর্থাৎ ফেন ঝড়ালে ভাতের ওজনের তফাত কি পরিমাণ। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বসা পদ্ধতিতে রান্নায় ৫০০ গ্রাম চালে ভাত হয় ১৬৫০ গ্রাম আর মাড় ফেলা পদ্ধতিতে ভাত হয় ১৫০০ গ্রাম। অর্থাৎ বসা পদ্ধতিতে ১৫০ গ্রাম বেশি ভাত হয়। প্রতি ১০০ গ্রামে ৩০ গ্রাম বেশি ভাত হয়। উল্টো দিকে মাড় ভাতে প্রতি ১০০ গ্রামে ক্ষতি হয় ঠিক তার উল্টো। কেজিতে প্রায় ৯০.০৯ গ্রাম চাল মাড়ের সঙ্গে চলে যায়। এছাড়া মাড় ঝড়াবার সময় ১.৫০%-২% চাল নষ্ট হয়ে অপচয়ের মাত্রা আরও বাড়ে। একই সঙ্গে খাদ্যের প্রায় প্রোটিন, শর্করাসহ দেড় ডজনের মতো পুষ্টিগুণও নষ্ট হয়। যে কেউ গাজী রফিক উদ্ভাবিত ডিফারেন্স অব মাস ইন এপ্লাইয়িং অলটারনেটিভ মেথড বা ওজনগত অসমতা পদ্ধতিতে চালের এই অপচয় পরীক্ষা করতে পারেন। গাণিতিকভাবে কয়েকটি সাংকেতিক রাশিতে এই পদ্ধতি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বসা ও মাড় ফেলা দুই রকম ভাতের ভরের পার্থক্যকে ১০০ দিয়ে গুণ করে বসা ভাতের ভর দিয়ে গুণফলকে ভাগ করলে শতকরা সংযুক্তিকরণ হয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন-
বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। আর এই ভাতেই রয়েছে আমাদের অতি প্রয়োজনীয় ৭৩ ভাগ ক্যালরি। ভিটামিন বি, থায়ামিন, নয়াসিন, রিবোপ্লাবিন, খণিজ লবণ, লৌহ তার মধ্যে অন্যতম। প্রোটিন ক্যালরির ঘাটতি ছাড়াও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতি করছে। তারপরও দেশে ৭০ ভাগ লোকের রয়েছে রক্তশূন্যতাজনিত এনিমিয়া। চালের পরিমাণগত অপচয় রোধ করতে পারলে প্রোটিন, নিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খুরশীদ জাহান। একই সুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশেরও। তিনি বসাভাত রান্নায় চালের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন ও পরিমাণে ভাত বাড়ে উল্লেখ করে বলেন, মাড় না ফেলে চাল ভাতে রূপান্তরিত করলে ভাতের পরিমাণ বেড়ে যায়। এবং তা পরিমাণে মোট চালের নয় ভাগ। সুতরাং নয় ভাগ কম ভাতে এখন যেটুকু ভাত খাচ্ছি তা থেকে নয় ভাগ কম চালেই সেই ভাতটা আমরা পেয়ে যাবো। খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিবেচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র