টিকটকার অনামিকা ঐশী বেশ কিছুদিন আগে একটি চলচ্চিত্রের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ঐশী ছাড়াও আরো ডজনখানেক টিকটকারের নাম বলা যাবে, যারা টিকটকের ভিডিও বানাইতেন কিন্তু আরো বছরখানেক আগে থেকেই টিভিতে, ওটিটি প্লাটফরমে নিয়মিত কাজ করতেছেন। কিন্তু তাদেরকে নিয়া বাংলাদেশের কোন থিয়েটার কর্মীরে আফসোস করতে দেখা যায় নাই। কেউ আফসোস কইরা বলেন নাই, এতে তারা ডিমোরালাইজড হইছেন। সাধারণ জনতাকেও এদের মিডিয়ায় কাজ করা নিয়া ট্রল করতে, বাংলা সংস্কৃতি উচ্ছনে যাওয়ার হাহাকার করতে দেখা যায় নাই। কিন্তু পরিচালক অনন্য মামুন যখনই অপুভাইরে তার ওয়েব সিরিজে কাস্ট করলেন, তখনই বাংলার থিয়েটারে দশ বিশ বছর ধইরা পারফরম করা থিয়েটার কর্মী আরেকটু হইলে দুঃখে হতাশায় সুইসাইড খায় আর জাতি এই নাপিতের ভিতরে বংগ সংস্কৃতির বারোটা বাজতে দেখে।
অপুর সমস্যাটা কোথায় যেটা তার আগের টিকটকারদের ছিল না?
অপু আমাদের এভারেজ যে সোশাল ও ইকোনমিক ক্লাস তার চাইতে নিচের থেকে উইঠা আসছে। আর ঐশী বা তার মত আরও যারা আছে তারা আগে থেকেই সেই ক্লাসের অনেক উপরে। আর অপুর এই নিচ থেকে উঠে ‘আমাকে’ ছাড়িয়ে যাওয়াটা দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ, থিয়েটার কর্মী, মিডিয়া কর্মী তাদের অবচেতন মনে মেনে নিতে পারতেছে না।
মানুষের একটা সাধারণ প্রবনতা হইলো, এরা তাদের চেয়ে উপরের ক্লাসের মানুষকে পুঁজা করে আর নিচের ক্লাসের মানুষকে অবহেলার চোখে দেখে। উপরের মানুষটার কাছাকাছি যেতে পারাকে নিজের জন্য সম্মানের মনে করে আর নিচের মানুষটাকে তাচ্ছিল্য করার মধ্যে এক ধরনের সম্মানিত বোধ করে এবং এর মধ্য দিয়ে উপরের মানুষ হইয়া উঠা ফিল নেয়। সে কারণেই দেখবেন, ট্রল ভিডিওগুলা খুব ভাইরাল হয়, কারণ তার চাইতে নিচের মানুষটাকে অপমানিত হতে দেখে মানুষ তার মধ্যে সে এক ধরণের পুলক অনুভব করে। হিরো আলম, অপুভাই এদের সবার বেলায় এ কথা সত্য (হিরো আলমের কাজ পছন্দ না করলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে হিরো আলমের বিরোধিতা করি না, সে যা করছে তা করার অধিকার তার আছে। দেখা বা না দেখা আমার ব্যাপার। আর হিরো আলম বাংলাদেশের অনেক ট্রল ভিডিও মেকারের ভাতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত)। আবার আপনি দেখবেন একই কাজ যখন ঐশী বা সালমান মুকতাদির করতেছে (এদের কারো প্রতি আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ নাই, জাস্ট উদাহরণ ও বাস্তবতা দেখানোর জন্য নামগুলা উঠে আসছে), তখন তাদেরকে বাহবা দিয়া আকাশের উপরে উঠায়া দিতেছে সেই একই মানুষ। এসবের পিছনে আমাদের অবচেতন শ্রেণিবৈষম্যপ্রীতি দায়ী।
এবার অপুর ওয়েব সিরিজে কাজ করা নিয়ে জনগণের কিছু কমেন্ট উল্লেখ না কইরা পারতেছি না।
১. দেশে এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে, অনন্য মামুনের মত স্বনামধন্য এমন একজন নির্মাতা এমন বিকারগ্রস্থ থার্ডক্লাস একজনকে নিয়ে কাজ করছে সত্যি অবাক হওয়ার ব্যাপার। (খেয়াল করেন, ক্লাস কিন্তু চইলা আসছে। অপু থার্ডক্লাস হওয়াতে সমস্যা)
২. ওর মতো কিছু আবাল কুবালদের কারণে দেশের বিনোদন জগত হুমকীর মুখে। ভবিষ্যতে এদেশে সালমান শাহ, আসাদুজ্জামান নুর মোশাররফ করিমের মত গুনী শিল্পীদের জন্ম হবে না। (এক অপুর কী ক্ষমতা, ভবিষ্যৎ মেয়েদের ফার্টিলিটি নষ্ট কইরা দিবে। )
৩. আজ যদি অপু অভিনয়ের সুযোগ পায় তাহলে তাকে দেখে এদেশের হাজারো যুবক অনুপ্রাণিত হবে। অপুর মতো চুলে রঙ করবে, গাঞ্জা খাবে, নেশা করবে, টাকার জন্য অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে টিকটক বানাবে, মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরী করবে। (লক্ষ্য করেন, অপুর সম্পর্কে এখানে যা যা বলা হইছে, আজ থেকে আরো পাঁচ বছর আগেই সালমান মুক্তাদিররা সেসব করে ফেলেছে যখন অপুর জন্মও হয় নাই। দুই বছর আগে বইমেলাতে সালমান মুক্তাদিরের বই ছাপা হইছিল, তখন তার বইয়ের তার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ভীড়ের ছবি নিশ্চই অনেকেরই মনে আছে। এদের কেউই বা তাদের ভাই বেরাদর এই কমেন্টটা করছে)
৪. হাজারো থিয়েটার কর্মী পায়ের চামড়া ছিঁড়ে, পকেটের টাকা নষ্ট করে, বাড়ির বকা খেয়ে এদেশের সংস্কৃতিকে লালন করে যাচ্ছেন। তাদেরকে বাদ দিয়ে এই বখাটেকে নেয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা আমার মাথায় আসে না। (আমি নিজেও একজন থিয়েটার কর্মী। কিন্তু শুধু থিয়েটার মঞ্চেই বাংলার সংস্কৃতি লালন হচ্ছে এটা কে বলল। সারা বছর এদেশের মঞ্চে যতগুলো নাটক হয় তার কয়টা বাংলাদেশি নাটক? এত কষ্ট করেও তো আপনাকে দর্শক ছাড়া থিয়েটার করা লাগে। আর থিয়েটার কর্মীকেই টিভিতে সুযোগ দিতে হবে, একটা সাধারণ মানুষকে দেয়া যাবেনা, এটা তো নতুন বুর্জোয়াগিরি, নতুন ক্লাস। টেলিভিশনের অভিনয় আর থিয়েটারের অভিনয় তো এক নারে ভাই। আর কেউ থিয়েটার না করে যদি অভিনয় শিখে টিভিতে কাজ করে সমস্যা কোথায়। বরং অপু আপনার চেয়ে আগায়া আছে। অপুর মার্কেট ভ্যালু আছে। আপনি তো টিভির দর্শকদের কাছে দুই টাকা দিয়া বিক্রি হবেন না।)
তো, মোটামুটি এই হইতেছে আমাদের জাতীয় কপট মনোবৃত্তির প্রকাশ। মোদ্দা কথা, ধইরা নিলাম অপু খারাপ। অপুর রুচিবোধ, স্ট্যাটাস সো কল্ড ভদ্র সমাজে যায় না। এবার সে যদি তারে শোধরাইয়া এই সমাজের মানুষ হইতে চায় তাহলে তা হইতে দেয়া যাবে না। এই সমাজ এমন এক সমাজ, একজন মানুষ খারাপ থেকে ভালো হয়ে গেলেও সমাজ সারাজীবন তার খারাপ থাকাটারে মনে রাখে আর প্রতি মুহুর্তে তারে মনে করাইয়া দেয়- আরে জানো না, অমুকের বাপ তো চোর আছিল। এই দেশে যদি গুণি জন্ম না নেয় তবে তার কারণ হইলো এইটা।
অপু যদি এই সিরিজের পর ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকে আমি খুব খুশি হবো। আর যদি অপু হারায়া যায়, তাইলেও আমি অবাক হবো না, বা অপুকে দোষ দিব না। আমাদের এই সমাজে মানুষের মস্তিষ্কভর্তি হিংসা। আমরা সারাজীবন ব্রাজিলের বাদামবিক্রেতা প্রেসিডেন্টের উদাহরণ দিব, কিন্তু কোন ঝালমুড়িওয়ালা প্রধানমন্ত্রী হইলে তা মেনে নিতে পারবো না। আমাদের সেই হিংসার আগুনে অপু পুড়ে যাইতেই পারে। তবে আমি খুব অধীর আগ্রহে অপুর প্রথম কাজটার জন্য অপেক্ষায় আছি।
যাই হোক, অপুর জন্য শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:৪০