যখন স্কুলে মাস্টারি করতাম, তখন হুট কইরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম- আজ থেকে সব ছাত্র-ছাত্রীরে স্যার ডাকুম। ব্যাপারটার মধ্যে একটা মজা অনুভব করতেছিলাম ছাত্র-ছাত্রীদের রিয়েকশন কী হবে তা ভাইবা। তবে সিরিয়াসলি এর পিছনে আমার একটা আমার একটা যুক্তিও ছিল, ছাত্র-ছাত্রীদের ফিল করানো যে তাদেরও রেসপেক্ট আছে। তারপর দিনের প্রথম ক্লাসেই গিয়া শুরু করলাম- গুড মরনিং, হাউ আর ইউ, স্যার। সেটা ছিল ক্লাস থ্রি। তো যেইটা বুঝলাম আমার স্যার ডাকা তারা খুবই পছন্দ করছে। তারমানে এক্সপেরিমেন্ট সফল। এরপর ক্লাস টেন, সিক্স, সেভেন (আমি ছাত্র হিসাবে মেধাবী না হইলেও টিচার হিসাবে কাবিল। অংক ছাড়া দুনিয়াতে খুব কম সাবজেক্টই আছে যা আমি পড়াইতে পারতাম না, তাই আমারে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিচিত্র বিষয়ে পাঠদান করতে হইতো। যেমন ধরেন ইংলিশের মাস্টার হইয়া আমারে ক্লাস টেনের বাংলা ব্যাকরণের ক্লাস নিতে হইতো, কারণ স্কুলের প্রিন্সিপালের বিশ্বাস ছিল এতে ছাত্র-ছাত্রীদের রেজাল্ট ভালো হবে। স্কুলের বাংলার মাস্টারেরা এই বিষয়ে কোন প্রতিবাদ করে নাই, বরং তাদের কেউ কেউ খুশিই হইছিলেন)। যাই হোক, এরপর টিচারস রুমে কেউ দেখা করতে আসলে তারেও- স্যার, কী সমস্যা বল। একসময় বুঝলাম সারা স্কুল আমার এই বিষয়টা পছন্দ করছে এবং এই নিয়া ছাত্র-ছাত্রীমহলে তো অবশ্যই, শিক্ষক ও অভিভাবক মহলেও ব্যাপক আলোচনা হইছে। তবে বেশির ভাগই পজিটিভ আলোচনা। আমিও চরম উৎসাহিত হইয়া আমার এই ‘স্যার’ সম্বোধনক্রিয়া চালাইয়া গেলাম। একবার ক্লাস নাইনের এক ছাত্রী জিগাইলো, স্যার, হোয়াই ডু ইউ এড্রেস আস “স্যার”? আমি কইলাম, এজ মাই স্টুডেন্ট ইউ ডিজার্ভ রেসপেক্ট। আই এম জাস্ট গিভিং ইউ দেট। যাই হোক, এরপর প্রায় তিন বছর স্কুলে মাস্টারি করছি। ততদিনে ছাত্র ছাত্রীদের ‘স্যার’ ডাকার ব্যাপারটা আমার মুদ্রা দোষে পরিণত হইছিলো, যা থেকে আমি এখনো মুক্ত হইতে পারি নাই। তবে বিশেষ কোন প্রবলেম হয় নাই।
এই মুদ্রাদোষ নিয়া সমস্যায় পড়লাম যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করতে গেলাম। আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেইটা মেয়েদের জন্য একটা বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ার আঠারোটা দেশ থেকে মেয়েরা এইখানে আইসা পড়ালেখা করে। প্রথম দুই বছর স্যার ডাকা নিয়া কোন প্রবলেম হয় নাই। কেউ এই নিয়া কোন প্রশ্নও উঠায় নাই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ক্লাসে আফগানিস্তানের এক ছাত্রী হাত তুললো। আমাদের কথোপকথন বাংলায় অনুবাদ করলে তা এমন দাঁড়ায়-
-প্রফেসর, আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? (আমি এখনো প্রফেসর হই নাই, তবে এইখানে স্টুডেন্টরা সবাইরেই প্রফেসর ডাকে।)
-একশ’বার।
-আপনি আমাদের ‘স্যার’ ডাকেন কেন?
-কারণ আমি তোমাদের রেসপেক্ট করি।
-তাহলে আমাদেরকে ম্যাডাম বলে ডাকতে পারেন, স্যার কেন ডাকেন?
- হ্যাঁ ডাকা যায়, তবে আমি স্যার ডাকতে কমফোর্ট ফিল করি, আমার টিচিং লাইফের শুরু থেকেই আমি এটা করছি। অভ্যাস বলতে পারো। আমি তো কোন সমস্যা দেখি না।
-কিন্তু প্রফেসর, আমার মনে হচ্ছে আপনার এন্টি-ফেমিনিস্ট পেট্রিয়ারকাল মেন্টালিটির কারণে আপনি আমাদের ম্যাডাম না ডেকে স্যার ডাকেন, যা মূলত আমাদেরকে অসম্মান করা হয়।
আমি তো এই কথা শুইনা তবদা খাইয়া গেলাম। এই জিনিস তো আমি জীবনেও ভাবি নাই!
-দেখো বিষয়টা আসলে এতটা জটিল না। আমাদের বাংলাদেশে বাবা তার মেয়েকে আদর করে ‘আব্বু’ ডাকে, বড় ভাই তার ছোট বোনকে ‘ভাইয়া’ ডাকে। তোমাদেরকে ম্যাডাম না ডেকে স্যার ডাকার বেলায়ও আমার ভিতরে এই বিষয়টাই কাজ করছে। আর কিছু না। এইখানে এত থিওরি দেয়ার কিছু নাই।
সাথে সাথে একটা নেপালি ছাত্রী বইলা উঠলো, “হ্যাঁ প্রফেসর, আমরা যখন মালামাল কিনতে সুপার শপে গিয়েছি, তখন সেলসম্যান আমাদেরকে ‘ভাইয়া’ ডেকেছিল বলে আমরা রাগ করেছিলাম। এখন বুঝলাম ওরা কেন আমাদের ভাইয়া ডেকেছে।
যাই হোক আমার সেই আফগান স্টুডেন্টকে বুঝানো গেলো না, সে আমারে চ্যালেঞ্জ দিল, প্রফেসর আপনি যদি আমাকে ১০ মিনিট সময় দেন আমি আপনারে বুঝায়া দিব, আই এম রাইট।
আমি কইলাম, দেখ তার প্রয়োজন নাই। কারণ তুমি সারাজীবন চেষ্টা করলেও আমারে বুঝাইতে পারবা না। কারণ তুমি যেই পয়েন্ট থেকে অবজেকশন জানাইতেছ, আমি তো সেই পয়েন্টেই নাই। তোমাদের ম্যাডাম না ডেকে স্যার ডাকার পেছনে আমাদের ভাষাগত সাংস্কৃতিক অভ্যাস জড়িত, অন্য কিছুই না। একজন শিক্ষক হিসাবে তোমার প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ আর সম্মান ছাড়া এর ভিতরে আর কিছুই নাই। তুমি থিওরি দিয়া এইটারে কলুষিত কইরো না। তোমাদের সমস্যা থাকলে আমি তোমাদের ‘স্যার’ ডাকবো না।
আমার স্যার বিষয়ক প্যাঁচাল এইখানেই শেষ করলাম। তবে আমি এখনো আমার ছাত্রীদের স্যার কইয়াই ডাকি।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা ঘটনা দিয়া শেষ করি। ঘটনাটা হুমায়ূন স্যার তার আত্মজীবনীমূলক একটা বইয়ে লিখছিলেন। (গল্পের ভাব ঠিক আছে তবে স্পয়লার দোষে দুষ্ট হইতে পারে, তার দায় আমার) তো উনি উনার একটা বইয়ে ‘গণ্ডগ্রাম’ শব্দটা ব্যবহার করলেন অজপাড়াগাঁ, ছোটগ্রাম হিসাবে। বই প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর হুমায়ূন স্যারের সাথে জনৈক পাঠক দেখা কইরা বললেন তিনি শব্দটির ভুল ব্যবহার করছেন। ডিকশনারি নিয়া দেখায়া দিলেন গণ্ডগ্রাম শব্দের অর্থ বিশাল গ্রাম, প্রধান গ্রাম ইত্যাদি এবং সামনে শব্দের অর্থ জেনে ব্যবহার করতে বলে চলে গেলেন। হুমায়ূন স্যার তো ডিকশনারি ঘাইটা দেখেন কথা তো সত্যি, গণ্ডগ্রাম মানে বিশাল গ্রাম। তো স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাংলার প্রফেসরকে ফোন দিলেন। দিয়া জিগাইলেন গণ্ডগ্রাম মানে কী। সেই প্রফেসরও কইলেন, অজ পাড়াগাঁ, ছোট ক্ষুদ্র গ্রাম। হুমায়ূন স্যার কইলেন, কিন্তু ডিকশনারিতে তো লেখা বিশাল গ্রাম। আপনি ঠিক, না ডিকশনারি ঠিক? তখন প্রফেসর সাব কইলেন, ডিকশনারিও ঠিক আছে, আমিও ঠিক আছি। গণ্ডগ্রাম শব্দটার আসল মানে বড় গ্রাম, প্রধান গ্রাম কিন্তু সবাই ভুল কইরা অজ পাড়া গাঁ অর্থে গণ্ডগ্রাম ব্যবহার করতে থাকল। আজ তাই অজ পাড়া গাঁ হইতাছে স্বীকৃত অর্থ। এইটাই শুদ্ধ। ... ভাষা কোন স্থির কিছু না। এইটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাইতে পারে। শব্দের অর্থ পাল্টায়া যাইতে পারে।
‘স্যার’ বিষয়ক যে ক্যাঁচাল, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্যার শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ বিষয়ে এই ঘটনা থেকে সেই বিষয়ে একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যাইতে পারে আরকি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ‘স্যার’ শব্দটারে এত সিরিয়াসলি নেয়ার কিছুই নাই। যে আপনারে সম্মান করবে না, সে স্যার ডাইকাও আপনারে অসম্মান করতে পারে, যদি আপনি ‘স্যার’ শব্দটারে এমন কিছু মনে কইরা থাকেন। আর কাউরে স্যার ডাকার মানে এই না যে তিনি আপনার চাইতে অনেক সম্মানিত হইয়া গেলেন। তবে এইটাও ঠিক বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক শ্রেণিসংস্কুতির বিচারে স্যার শব্দটা গণ্ডগ্রামের চাইতে একটু জটিল অবস্থায় আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৫:০২