আমার এক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক এক শব্দে এই হাসপাতাল নির্মাণ প্রজেক্টকে সজ্ঞায়িত করছেন, যা আমার কাছে যথার্থ মনে হইছে- তার ভাষায় এটা হলো ‘ইকোসাইডাল প্রজেক্ট’। জেনোসাইড যেমন গণহত্যা, ইকোসাইড হইলো তেমন গণভাবে প্রকৃতিরে হত্যা। চট্টগ্রাম সিআরবিতে হাসপাতাল বানাইতে গিয়া এখানকার হাজার হাজার গাছ যার মধ্যে অসংখ্য শতবর্ষী গাছ আছে, এই সব গাছের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা হবে। শুধু ঝুঁকি ফেলা নয়, বিগত সময়ে দেশের রাস্তাঘাটসহ যে কোন অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রথমেই ঐ জায়গার গাছগুলো কাইটা সাফাই করতে দেখা গেছে। গাছগুলোকে রক্ষা করেও তো পরিকল্পনা করা যাইতো। কিন্তু না, তা হয় নাই কখনোই। কারণ এই গাছ কাইটা বিপুল পরিমাণ অর্থের খুব কমই সরকারের ঘরে যায়। নেতা আর আমলাদের পকেট ভারি হয়, তাই সবার আগে গাছের গায়ে কোপ পড়ে। বছরখানেক আগে চট্টগ্রাম হইয়া হাটহাজারি, ফটিকছড়ি যাওয়ার রাস্তা চার লেইন করার নামে রাস্তার দুই পাশের কয়েক হাজার বিশাল বিশাল গাছ কাইটা ফেলা হইছিল। সিআরবিতেও সেইটাই হবে।
সিআরবির এই প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতাল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় একটা প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় এইখানে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হবে। ৫০ বছরের জন্য এই হাসপাতাল ব্যক্তিমালিকানাধীন থাকবে, মানে এইক্ষেত্রে মালিক হবে ইউনাইটেড, এরপর এর মালিক হবে রেলওয়ে। কোন কোন সুবিধাভোগী কুযুক্তি দিতাছেন চট্টগ্রামে কোন ক্যান্সার হাসপাতাল নাই, সেইক্ষেত্রে এইটা হইলে তো ভালই হয়, পাশাপাশি সাধারণ জনগণের উপকারও হয়। আর আমাদের রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হইছে, এই হাসপাতাল বানাইতে একটা গাছও কাটতে হবে না।
প্রথমত, চট্টগ্রামে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল হইলে অবশ্যই ভালো হয়, তবে এর জন্য কি সিআরবি ছাড়া রেলওয়ের আর কোন জায়গা নাই? রেলওয়ের হাজার হাজার একর জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় পইড়া আছে। সেইখানে গিয়া করুক। বুঝতে হবে, এই হাসপাতাল হবে একটি প্রাইভেট বানিজ্য প্রতিষ্ঠান, সিআরবি হইলো একটা প্রাণকেন্দ্র, এইখানে হইলে ব্যবসা ভালো হবে। সাধারণ জনগণের এখানে হাসপাতাল হইলে হারামও উপকার হবে না, কারণ এইটা জনগণের কথা মাথায় রাইখা হইতাছে না। এই হাসপাতাল হইবো অ্যাপোলো, ইউনাইটেডের মতোন বড়লোকের হাসপাতাল। সাধারণ জনগণের এইখানে কোন একসেসই থাকবে না।
ধইরা নিলাম, একটা গাছও কাটা হবে না। রেলওয়েওয়ালারা সত্যি কইতাছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও তাদের মতামত দেয়ার বেলায় বৃক্ষ নিধনের বিষয়টারে হাইলাইট করতেছেন। তাদের ভাষায় বৃক্ষ নিধন কইরা কোন কিছু করা ঠিক হইবো না। স্থানীয় এমপি ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কইছেন, “সরকার পরিবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। বৃক্ষ রক্ষার ব্যাপারেও সরকারের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার কোন ঘাটতি নেই। এমন জনবান্ধব এবং পরিবেশ বান্ধব সরকারের সময়কালে শতবর্ষী বৃক্ষ কোনভাবেই নিধন হবে না। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই কল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত নেবেন ।” অন্যদিকে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি একটি লাইভ ভিডিওতে কইছেন, “সিআরবিতে হাসপাতাল নিয়ে একটি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, প্রথমত সবকিছু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত, এটা মাথায় রাখতে হবে। পাশাপাশি হাসপাতাল আমাদের দরকার এবং এটা চট্টগ্রামের মানুষের দাবি, আমাদের চিকিৎসার জন্য। সব মানুষ ঢাকায় আসবে এটা হতে পারে না। চট্টগ্রামের মানুষের সেবার জন্য আধুনিক হাসপাতাল দরকার। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে গাছ কেটে এখানে হাসপাতাল হবে।” তিনি আরো কইছেন, “সিআরবি অত্যন্ত একটি সুন্দর জায়গা। এটাকে সব সময় আমি মিনি সিঙ্গাপুরের আদলে দেখে থাকি। আমার মনে হয় নিঃশ্বাস ফেলার একটি জায়গা। সিআরবিতে তাপমাত্রাও অনেক কম। বাইরে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও সিআরবিতে ২/৩ ডিগ্রি কম থাকে। সকল বিষয় নিয়ে আমি নিজেও খুব চিন্তিত।” মজার ব্যাপার হইলো এই ব্যক্তি কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। তার মানে সিআরবিতে হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত তার অগোচরে হয় নাই। তিনি তো আগেই এইটা বাধা দিতে পারতেন। তাছাড়া শুধু গাছ রক্ষা হইলেই হইতাছে না, এইখানে হাসপাতাল হইলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই। কিন্তু যখন এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ ঠিকমতো চালু হইবো, এইখানে জনসমাগম বাড়বো, গাড়ি ঘোড়ার চলাচল বাড়বো, দোকান পাট হইবো, এর ফলে সিআরবির এই প্রশান্ত নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ পুরাপুরি খতম হইয়া যাইবো। সিআরবির সব রাস্তাঘাট সরু। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এইখানে যানজট বাড়বে, একটা সময় গিয়া রাস্তা বড় করার প্রয়োজন পড়বে। গাছ কাটা তখন অনিবার্য হইয়া যাবে।
(প্রতিবাদ আন্দোলনের অংশ হিসাবে মঞ্চস্থ হচ্ছে পথনাটক)
তো এইখানে হাসপাতাল করার জন্য রেলওয়ে এত সাফাই গাইতাছে ক্যান? সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ থেকে সইরা আসার সুযোগ নাই বইলা জানাইছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন। আসলে রেলওয়ে না, রেলওয়ের গুটিকয় কর্মকর্তা, পরিষ্কার বুঝা যায় তাদের এইখান থেকে টু পাইস কামানোর ভালো সম্ভাবনা আছে, হয়তো অলরেডি তারা কামায়াও ফেলছেন। তা না হইলে ৫০০ কোটি বাজারমূল্যের একটা জায়গা ৭/৮ কোটিতে কোন যুক্তিতে তারা লিজ দিলেন? এখন ইউনাইটেডের টাকা যেহেতু খাইছে তা হজম করার জন্য যেমনেই হোক তাদেরকে জায়গা বুঝায়া দেয়া লাগবে। সিডিএ অনেক আগেই এই জায়গাকে হেরিটেজ বইলা ঘোষণা দিছে। তাই এই জায়গায় কোন স্থাপনা করা আইনত অবৈধ। খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও রেল মন্ত্রনালয় অনেক কিছু গোপন কইরা এই হাসপাতালের প্রজেক্ট পাশ করাইছে একান্তভাবে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে। কিন্তু এখন সবাই দায় চাপাইতাছে প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে। প্রধানমন্ত্রী তো আর সিআরবির এই জায়গা ভিজিট করে সিদ্ধান্ত দেন নাই, সেটা তার পক্ষে সম্ভবও না। আমলারা আর নেতারা যেভাবে বুঝাইছে তিনি সেইভাবে সিদ্ধান্ত দিছেন।
তবে আশার কথা হইলো, এই লকডাউনের মধ্যেও চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণ এই হাসপাতাল বানানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোভাবে রুইখা দাঁড়াইছেন। সিআরবি পরিবেশগতভাবে ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন থেকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় আর গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা এই উপত্যকাকে বলা হয় চট্টগ্রামের ফুসফুস। কম কইরা হইলেও তিনশ শতবর্ষী গাছ আছে এইখানে। ব্রিটিশ বিরোধি সংগ্রামে ১৯৩০ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে এই স্থান সরাসরি যুক্ত। তাছাড়া এই হাসপাতালের জন্য যেই ৬ একর জায়গা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে সেইখানে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবর, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, সেইখানে সেই শহীদের নামে একটি কলোনী ও রাস্তাও আছে এবং অনেকেই ধারণা করেন সেখানে একটি বধ্যভূমিও আছে। হাসপাতাল নির্মাণ করতে হইলে এসবের উপরেই করতে হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব সংরক্ষনের কোন উদ্যোগ নেয়ই নি, বরং এখন তা ধ্বংসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এমনকি একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বছর খানেক আগে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন রেলওয়ে থেকে বলা হয় এই জায়গার মাটিতে কোন স্থাপনা করা ঝুকিপূর্ন।
শুধু গাছ না, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির স্বার্থে পুরা সিআরবিই রক্ষা করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক ও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি জনাব খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, যারা জোর জবরদস্তি এখানে হাসপাতাল নির্মাণ করতে চাইবে, তাদেরকে চট্টগ্রামের মানুষ গণদুশমন হিসাবে চিহ্নিত করবে। আমরা আশা করবো তিনিসহ সবাই তাদের অবস্থানে অটল থাকবেন এবং দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত জনগণের সাথে থাকবেন। আর সবাই যেহেতু সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে দিচ্ছেন, আমরা এও আশা করবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আদ্যোপান্ত অনুধাবন করবেন ও তিনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন তা জনগণের পক্ষে, প্রকৃতির পক্ষেই যাবে।
(পোস্টে ব্যবহৃত সকল ছবি আমার তোলা)
আপডেটঃ
আন্দোলনের প্রভাব বলতে পারেন। রেলওয়ের জিএম এর পল্টি খাওয়ার সংবাদ পড়ে নিতে পারেন।
জনতার আন্দোলন আরো বেগবান হচ্ছেঃ সিআরবি রক্ষায় আমরণ অনশনের ঘোষণা ড. অনুপম সেনের
বিদেশের মাটিতেও হচ্ছে আন্দোলনঃ সিআরবি রক্ষার আন্দোলন দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও
অক্সিজেন মুখে মুক্তিযোদ্ধার অবস্থানঃ চট্টগ্রামের ফুসফুস’ বাঁচাতে অক্সিজেন মুখে অবস্থান মুক্তিযোদ্ধার
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২১ রাত ১১:৩৬