সপ্তাহ তিনেক আগে আমার করোনার প্রাথমিক সকল পদের আলামতসহ জ্বর দেখা দেয়। ডাক্তার কইলেন টেস্ট করাইতে। জেনারেল হাসপাতালে চইলা যান। সকাল সকাল যাইবেন। খুব ভীড় হইব। আমি চিন্তা করলাম, প্রাইভেট ক্লিনিকে ট্রাই কইরা দেখি, যদি ওইখানে করা যায়, তাইলে আর সরকারী হাসপাতালে গিয়া লম্বা লাইন ধরা লাগবে না। যথারীতি একটা ক্লিনিকে কল দিলাম যারা কোভিড টেস্ট করায়। এরা আমার কল রিসিভ কইরা আমারে “স্যার” বইলা সম্বোধন করলো, সকাল নয়টা থেকে বিকাল ৫টার মইধ্যে আমার সুবিধামতো যাইতে কইলো। জিগাইলাম খরচ কত? সে কইলো প্রতিবার টেস্ট ৩০০০ টাকা। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। কয় কি? এত টাকা দিয়া তো টেস্ট করানো সম্ভব হইলেও তো করামু না। পরদিন সকালে সরকারী হাসপাতালে গিয়া ১০০ টাকা দিয়া টেস্ট করায়া আসছি। এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াইতে হইছে। যেই মানুষগুলার সাথে লাইনে দাঁড়াইছিলাম এদের বেশিরভাগরে দেখলেই বুঝা যায় এদের পক্ষে কখনোই ৩০০০ টাকা দিয়া টেস্ট করানো সম্ভব হইতো না। যাই হোক, আমার রেজাল্ট নেগেটিভ আইছে। মালিকের মেহেরবানী।
সিম্পল করোনা টেস্ট, সরকারি-বেসরকারি টেস্ট ফির রেশিও ১ঃ৩০! পার্থক্যটা ভাবা যায়?
এবার ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আসি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে আজকে পর্যন্ত এক কোটি ১০ লাখ মানুষ ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আসছে, যার মধ্যে ৪২ লক্ষ জন দুই ডোজ পূর্ণ করেছেন । নানা ধরণের জটিলতা থাকা সত্ত্বেও সরকার এখনো নানা জায়গা থেকে ভ্যাকসিন জোগাড় করছে যা অনেকের ভাষায় ভিক্ষা করে জোগাড় করছে। মাঝখানে ভ্যাকসিনের অভাবে টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ হইয়া গেছিলো। ইদানিং আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটা দেশ থেকে বড় কয়েকটা চালান আসছে। সামনে চীন থেকে সরকার দেড় কোটি ডোজ সিনোফার্মের টিকা কেনার সবকিছুই চূড়ান্ত। আগামী তিন মাসে প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে আসার কথা। সরকার চাইলেই এত ঝামেলা না কইরা প্রাইভেট অনেকগুলা প্রতিষ্ঠানরে দিয়া আমদানী করায়া কিছু প্রাইভেট ক্লিনিকরেও নিজেদের মতো টিকা দেয়ার পারমিশন দিতে পারতো। তাইলে কি হইতো?
১. প্রতিটা টিকা আপনারে আমারে ৩০-৪০ হাজার টাকায় কিনতে হইতো।
২. স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত সরকারী কর্মচারিরা সরকারি টিকা গোপনে বেইচা দিত (অনেকে বলেন, এখনও তারা তা অল্পবিস্তর করতেছেন, এ ব্যাপারে কোন অথেনটিক সূত্র পাওয়া যায় নাই, তবে ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না।)
৩. কিছু গোপন কারখানায় নকল টিকা উৎপাদিত হইতো। আপনি আমি শরীরের ভিতরে পানি পুশ কইরা টিকা দিছি ভাইবা শান্তি পাইতাম।
৪. জাতি হিসাবে আমরা ভালই দুর্নীতিবাজ হইয়া উঠছি। এ নিয়ে আরো বহুত কিসিমের দুর্নীতির ঘটনা ঘটতো, ত্রাণের ঘটনার মতোন।
সরকার মহাজন এসবের সুযোগ না দিয়া এখনো পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতে রাইখা দিছেন এবং নানা জায়গা থেকে ভিক্ষা কইরা টিকার ব্যবস্থা করতেছেন। অনেকেই কইতাছেন রিজার্ভে অনেক টাকা আছে, টিকা কিন্যা তাড়াতাড়ি মাইরা দেয়া উচিৎ সরকারের। ১৭ কোটি মানুষের জন্য ৩৪ কোটি ডোজ টিকা দরকার। এই বিপুল পরিমাণ টিকা যদি কিনা লাগে তাইলে বিশাল অংকের ডলার রিজার্ভ থেকে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের শুধু করোনার টিকার সংকট মোকাবেলা করলেই হবে না, এই সংকট চলাকালীন ও করেনা পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতিও রাখা দরকার। রিজার্ভ একটা ভরসার জায়গা। তাই যত বেশি পরিমাণ টিকা সাহায্য বা উপহারের নামে গ্রহণ করা যায়, ততটাই সঞ্চয়। এটা সরকারের একটা পলিসিও হইতে পারে।
সিনোফার্মের টিকার দাম পড়বে প্রায় ১০ ডলার কইরা। যদিও আগে ৫ ডলারে ভারতের সেরাম থেকে প্রথমবার টিকা আমদানী করার সময় টিকার অতিরিক্ত দাম নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু কইছিলেন, তবে তারা এখন চুপ। যাই হোক, ১০ ডলার হিসাবে এক এক নাগরিকের জন্য ২০ ডলারের টিকা লাগবে। সাথে সেই টিকার পরিবহণ ও মেইটেইনেন্স খরচও আছে। ৩৪ কোটি ডোজ মানে ডলারের অংকটা বুঝতে পারতেছেন। এক কোটি টিকাও যদি উপহার হিসেবে, অনেকের ভাষায় যা ভিক্ষা, আনা যায় তাহলে আমাদের রাষ্ট্রের একটা বড় অংকের টাকা বাইচ্যা যাবে। এই ভিক্ষার পরিমাণটা যতটা বাড়ানো যায়, ততটাই মঙ্গল। হয়তো টিকা আমদানীতে যা কিছুটা সময়ক্ষেপণ তার একটা কারণ এইটা।
সম্প্রতি ভিক্ষায় পাওয়া টিকার একটা সোর্স নিয়া কথা বলি। আমেরিকার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্লোবাল একসেস (কোভেক্স) কর্মসূচির আওতায় এই পর্যন্ত ৫৬ লাখ ভ্যাকসিন পাইছে বাংলাদেশ। সম্ভবত গত সপ্তাহে সর্বশেষ ৩০ লাখ ডোজ মর্ডানার টিকা এসে পৌঁছায়। তবে এই টিকার পেছনে বাংলাদেশের ৪ জন প্রবাসি আমেরিকান বাংলাদেশির সরাসরি অবদান জড়িত। অনেক বাংলাদেশিই আমেরিকায় স্থায়িভাবে আছেন, যারা ওইখানে বইসা টিকা নিয়া, শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিকা নিয়া এইখানে, ওইখানে, ব্লগে, সামুতে বাগাড়ম্বর কইরা সরকারের ১৪ গুষ্ঠি উদ্ধার কইরা ফেলতেছেন। কিন্তু কাজের বেলায় নাই। তাদের মতো এই চার জন এই প্রশ্ন ভাবেন নাই যে, সরকারের রিজার্ভে তো অনেক টাকা, টিকা তো কিনতেই পারে, ভিক্ষা চাওয়ার দরকার কী? এই চার মহৎ ব্যক্তি হইলেন, কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. চৌধুরী হাফিজ আহসান, কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান, নেফ্রলজিস্ট প্রফেসর ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ সাদেক ও সাবেক সিনিয়র ইউএন অফিসিয়াল মাহমুদ উস শামস চৌধুরী (আহা একজনের নামের লগে আমার নামের মিল আছে)। এই চারজনের একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফসল এই ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি, সূত্র ডেইলি স্টার।
বাঙালী যেইখানে যায় সেইখানেই দুর্নীতি করে। আমেরিকার কোভেক্স প্রজেক্টটা স্বল্পোন্নত দেশগুলার জন্য। প্রথমে যেই ১৮১টা দেশের লিস্ট করা হইছিল, বাংলাদেশের নাম সেইখানে সঙ্গত কারণেই ছিল না। কারণ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ না, উন্নয়নশীল দেশ। তারা যে কোন ভাবেই হোক আমেরিকার ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটিতে ঢুকেন, বাংলাদেশের নাম লিস্টে ঢুকান, সর্বশেষ যে ১৮ টি দেশের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়, সেখানেও বাংলাদেশের নাম আসে। আরো ভয়ংকর দুর্নীতির ব্যাপার হইলো, এখন পর্যন্ত মাত্র দুইটা দেশ কোভ্যাক্সের আওতায় টিকা পাইছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একাই ৫৬ লাখ আর ইউক্রেন ১০ লাখ। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র কোভেক্সের আওতায় যতবার ভ্যাকসিন দিবে, বাংলাদেশ ততবার ভ্যাকসিন পাবে। তারমানে এই ৫৬ লাখই শেষ না।
যারা এইটাকে ভিক্ষা বলতে চান বলেন, দুর্নীতি বলতে চান, বলেন, তবে আমি তাদেরকে জাতীয় বীর বলে স্যালুট জানাই। অবশ্য আমার স্যালুটে তাদের কিছু যায় আসে না। আমি হইলাম কেচকি মাছ।
আমরা বাঙালীরা আসলেই নিচু মানসিকতার। খোদ আমেরিকাও এই টিকা দেয়ার সময় এটাকে আমেরিকার জনগণের পক্ষ থেকে উপহার বলে ঘোষণা দিছে। আর আমরা সেটাকে গ্রহণ করছি ভিক্ষা হিসাবে। জাতি হিসাবে আমাদের এই দৈন্যতা ঘুঁচবে কবে।
যাই হোক, তিন দিন আগে আমি প্রথম ডোজ টিকা নিছি, টিকার ব্র্যান্ড মডার্না, সরকারের কল্যাণে হোক, যুক্তরাষ্ট্রের কল্যাণে হোক, অথবা সেই চার মহান প্রবাসি বাংলাদেশীর কল্যাণেই হোক, আই এম ভ্যাকসিনেটেড।
কার্টুনের লিংক
ডেইলি স্টার নিউজ লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৪১