আজকের লেখার দুইটা অংশ। প্রথম অংশে বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান সাহিত্যিক, কবি সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে অধমের কিছু ভাবনা আর দ্বিতীয় অংশ পুরাই গালাগালি, একেবারে রাখঢাক ছাড়া। যার যেই অংশটা ভালো লাগবে, পড়বেন।
এই শিরোনামের শানে নুজুলটা লেখার শেষ অংশে ভাঙ্গবো। তার আগে বলেন, ‘হায়রে মানুষ রঙীন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস্’ -এই গানটা জীবনে গুনগুন কইরা একবারের জন্যও গায় নাই এমন বাঙালী কয়জন আছে? একজন লেখকের লেখক হওয়ার জন্য বা একজন গীতিকারের গীতিকার হইবার জন্য এই রকম একটা কালজয়ী গান যথেষ্ট। আপনি সারাজীবন সামুতে লিখে, কমেন্ট কইরা ভরায়া ফেলেন, লাভ নাই। সামুতে আপনার আমার লেখা একদিন পরেই বাসি হইয়া যায়, কিন্তু এই গান বাঙালী বিগত চল্লিশ বছর যাবৎ গুনগুনইতাছে। জী হ্যাঁ, এই গানের গীতিকার সৈয়দ শামসুল হক। মানুষ তো দেশ ছাইড়া আমেরিকায় যাইয়া বসবাস করে, আর বাঙালীর এই কবি লন্ডন ছাইড়া বাঙলায় এসে বসবাস করতে শুরু করলেন ১৯৭৮ সালে, যদিও লন্ডনে তার থাকার ভালো সুযোগ ছিল। পরবর্তীতে কোন একসময় তিনি লিখলেন,
“আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?”
একজন শক্তিমান সাহিত্যিক হিসেবে তিনি আজকে হুট করে আবির্ভূত হন নাই, বা কোন রাজনৈতিক দল তারে পুট কইরা ধইরা সেরার আসনে বসায়া দেয় নাই। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে, তার প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার ১৪ বছর পর, বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়। আজকে ২০২১ পর্যন্ত বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কমবয়েসি। সাহিত্যে কী পরিমাণ ক্ষুরধার মেধাবী ও শাণিত হইলে এইটা সম্ভব ছিলো!
তাঁর পিতার বড়ই ইচ্ছা ছিলো ছেলেরে ডাক্তার বানাইবেন। কিন্তু ছেলের ইচ্ছা তো ভিন্ন - তিনি তো শৈশব থেকেই নিজের ভিতরে শিল্পমানস ধারণ করেন, ডাক্তারী তারে পোষাইব না, পিতার মনের ইচ্ছা বুঝতে পাইরা তিনি কাউরে কিছু না বইলা পলায়া গেলেন ভারতে, বম্বেতে গিয়া একটা প্রডাকশন হাউজে ফিল্মের এসিস্টেন্ট হিসেবে করলেন এক বছর। সময়টা ১৯৫১, তখন তার বয়স মাত্র ১৬, ভাবা যায়! পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই, বম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে শিইখা আসা বিদ্যা তিনি কাজে লাগাইতে শুরু করেন ১৯৫৯ সাল থেকে, যার কিছু আগে তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন, নিদারুন অর্থাভাব তারে নিয়া যায় সিনেমা জগতে। ১৯৫৯ সালে লিখছেন ‘মাটির পাহাড়’ সিনেমার চিত্রনাট্য। তোমার আমার, কাঁচ কাটা হীরে, বড় ভালো লোক ছিল, পুরস্কারসহ নানা সিনেমার সংলাপ, কাহিনী ও চিত্রনাট্য তার। ২০১১ পর্যন্ত কমবেশি ১৭টি সিনেমার হয় কাহিনীকার নয় চিত্রনাট্যকার নয় সংলাপ রচয়িতা হিসাবে কাজ করছেন। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ আর ‘পুরস্কার’ চলচ্চিত্রের জন্য পর পর দুই বছর পাইছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।
এর পাশাপাশি সিনেমার জন্য তিনি গানও লিখছেন। হায়রে মানুষ রঙীন ফানুষ, যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, তোরা দেখ দেখরে চাহিয়া চোখ থাকিতে এমন কানা কেমন করিয়া, চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা ইত্যাদি আরো অনেক কালজয়ী গান।
প্রিয় পাঠক, আমি কিন্তু এখনও সৈয়দ শামসুল হক যে পরিচয়ে পরিচিত, সে বিষয়ে কিছু লিখিই নাই- ‘কবি’ সৈয়দ হককে নিয়ে। এ নিয়ে কিছু লিখবোও না। গুটিকয় মাথামোটা, অকালকুষ্মাণ্ড ছাড়া এ নিয়ে সবাই জানেন। চর্বিত চর্বন করার কোন মানে হয় না। সৈয়দ হক একাধারে লিখছেন কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, করছেন অনুবাদ। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নাই যেইখানে তিনি সাবলীলভাবে বিচরণ করেন নাই, এক কথায় বহুমাত্রিক সাহিত্যিক তিনি। আমি সেই সবের লিস্ট দিয়া লেখার দৈর্ঘ্য বড় করাকে বাহুল্য মনে করি কারণ এই বিষয়ে আপনি নেট দুনিয়ায় অসংখ্য লেখা পাইবেন, ইচ্ছা হইলে দেইখা নিতে পারেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এমিরেটাস সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডক্টর আনিসুজ্জামান স্যারের মতে, রবীন্দ্রনাথের পরে সৈয়দ হকই একমাত্র বাঙালী সাহিত্যিক, যিনি সফলভাবে সাহিত্যের সব শাখায় স্বীয় অবদানের কারণে প্রবলভাবে আলোচিত ও সমালোচিত। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “সৈয়দ হক যৌবনে এক অসাধারণ সাহসিকতার সঙ্গে পেশা হিসেবে লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছিলেন। আমরা আশঙ্কা জানিয়েছিলাম, এটা কি সম্ভব হবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তিনি সেটাকে সম্ভব করে ছেড়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক তার রচনায় এদেশের মানুষের ব্যক্তিগত, যৌথ আনন্দ-বিষাদ, সমস্যা-সঙ্কটের কথা যেমন বলেছেন, তেমনিভাবে ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখিয়েছেন।” লিংক
অনেক সাহিত্য সমালোচকের মতে তিনি যদি শুধু ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ আর ‘পরানের গহীন ভেতর’ লিখতেন, আর কিছু না লিখতেন, তাইলেও বাংলা সাহিত্য তারে চিরজীবনের জন্য মনে রাখতো। ‘পরানের গহীন ভেতর’ পুরো কাব্যগ্রন্থটি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। বাংলা সাহিত্যে এমন কাব্যগ্রন্থ বিরল। তার রচিত কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ আর ‘নুরুলদীনের সারা জীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চে সেরা নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা সেরা নাটক।
সৈয়দ শামসুল হক কম করে হলেও ৩৮টি উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তার উপন্যাসের প্রসঙ্গ আসলেই সবাই কেবল ‘খেলারাম খেলে যা’র কথা কয় কেন? কারণ এরা খেলা খুঁজতেই উপন্যাসটা হাতে নিছিলো, অন্যগুলা পড়েই নাই।
এবার সৈয়দ হকের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কথা কই, ফাঁকে ফাঁকে আমি গালিগালাজও চালাইতে থাকবো। আমি আসলে গালিগালাজ করার নিয়তে এই লেখাটা লিখতে বসছি, এতক্ষণ যা লিখলাম তা গালিগালাজের গ্রাউন্ড তৈরি করার জন্য। এবার গালি দিব। সামু চাইলে আমাকে ব্যান করতে পারে। সৈয়দ হকের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অনেকেই জল ঘোলা করার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে একদল আছেন যারা ধর্মীয় মৌলবাদ গোষ্ঠি, জামাতি ও বামাতি ঘরানার। আরেকদল আছে এরা বলদ ও আঁতলামী দোষে দুষ্ট সম্প্রদায়ভূক্ত। এরা দুই লাইন সৈয়দ হক পড়ে নাই, শুধুমাত্র নিজেদেরকে সর্ববিষয়ে আঁতেল প্রমাণ করার জন্য ভুলভাল প্রলাপ বকে আর এরা যে বলদ তা পাবলিকলি প্রকাশ করে। এই বলদদের বলদামির নমুনা লেখার শুরুতে ছবিতে দিলাম। বলদ প্রথমে এমনভাব নিল যে সৈয়দ হকের নাড়ি নক্ষত্র সে জানে, বলে দিল যে সৈয়দ হক স্ট্যান্টবাজ। কিছুক্ষণ পর সে আবার নির্লজ্জের মতো অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে স্বীকারও করলো, “আচ্ছা আমি যেহেতু উনার লেখা পড়িনি, উনার সাহিত্যের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না।” দেখছেন অবস্থা! বলদামীর একটা লিমিট থাকা উচিৎ। একটা বিষয়ে না জানাটা দোষের না, কিন্তুু না জেনে জ্ঞানীর ভাব নেয়াটা বাল পাকনামি।
দেশের নাগরিক হিসাবে কেউই দল-মত নিরপেক্ষ না। আমাদের গর্বের জায়গা হলো সৈয়দ হক একজন স্বাধীনতা স্বপক্ষের মানুষ। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর বিবিসিতে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের আত্মসমর্পনের খবরটি পাঠ করেন। এখন আপনি যদি কুযুক্তি দেন - যুদ্ধের এই কঠিন সময়ে যুদ্ধ না কইরা উনি লন্ডনে বিবিসি অফিসে কী করতেছিলেন, তাইলে আমার কিছু বলার নাই। মনে-প্রাণে, চিন্তায় ও মননে, সাহিত্যচর্চায় তিনি দেশকে ধারণ করতেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারাই চালিত হইতেন। এই চেতনারেই তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চার ভিত্তি হিসাবে মানতেন। মৃত্যুর এক বছর আগে নিজের ৮০তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও নিজের সাহিত্যচর্চা নিয়ে সৈয়দ হক কইছিলেন :
“ভাষার জন্য শুধু রাজপথে রক্ত ঝরানোর বছর সেটি নয়, পাকিস্তানের শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখা ও বাংলাকে আরবি-উর্দু শব্দে জর্জরিত করে এই ভাষাটিকেই বিনষ্ট করবার বিপরীতে আমরা ক’জনা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাংলাভাষাকেই আঁকড়ে ধরে যে লিখে চলেছিলাম, সেদিন আমাদের দুর্বলতম লেখাটিও যে ছিল রাজপথে রক্ত ঝরানোর চেয়েও অধিক সফল যুদ্ধ, বন্দুক নয় কলম হাতেই যে হয়ে উঠেছিলাম বাংলা মায়ের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা আমরা একেকজনা।”
সৈয়দ হককে শেখ হাসিনা তার রাজকবি হিসাবে নিয়োগ দেন নাই। তাঁর সাথে শেখ হাসিনার যে সখ্যতা বা নৈকট্য তা নিতান্তই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর উছিলায়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের যে সংগ্রামের ইতিহাস, দর্শন ও আদর্শের চেতনা - সেই চেতনাগত ঐক্যই হইলো এই সম্পর্কের ভিত্তি, যারে চাঁদগাজীর মতো একটা ব্লগার স্ট্যান্টবাজী বলেন, যে শুদ্ধ বাংলা লেখতে জানে না, যার প্রতিটা লেখা গুরুচণ্ডালি দোষে দুষ্ট। সৈয়দ হক আগে স্বপরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত, নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারে মুক্তিযুদ্ধ বেচতে হয় নাই, শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু বেচতে হয় নাই্। আওয়ামী লীগ বা হাসিনার সাথে নৈকট্যকে ভিত্তি কইরা তিনি উইঠা আসেন নাই। বরং এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টা।
ঠিক মতো বাংলা লিখতে জানে না একটা একগুঁয়ে (এটার আরো খারাপ প্রতিশব্দ ছিলো, অনেক কষ্টে নিজেরে সামলাইছি) যখন সৈয়দ হকের মতো একজন বহুমাত্রিক, ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকরে ‘স্ট্যান্ডবাজ’ বইলা তার সাথে বেয়াদবি করে, তখন একজন সচেতন সাহিত্যপ্রেমি পাঠক হিসাবে আমারে হামান দিস্তা হাতে নিতে হয়। ডাণ্ডা হাতে নিতে হয় বলদ তাড়ানোর জন্য।
ছোট বাচ্চা যখন বড়মানুষের দাড়িতে হাত দেয়, তখন সবাই তারে আদর করে। কিন্তু বাচ্চা বড় হইয়া যদি এই কাজ করতে যায়, তখন ঐ বেয়াদবরে থাপড়াইতে হয়। আমরা যারা টুকটাক সাহিত্যচর্চা করি সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আহমদ ছফা... ইনারা হইতাছেন আমাদের বাপের মতোন। বাপেরে কেউ খারাপ কথা কইলে সন্তান হিসাবে আমার দায়িত্ব হইতাছে তার কপালে উষ্টা মারা। আমি উষ্টা মাইরা আমার দায়িত্ব পালন করলাম। এই ধরণের অন্ত:সারশুন্য কথা-বার্তার এইভাবেই প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ, নতুবা গাঁজাখুরি আষাঢ়ে গল্প চলতেই থাকবে এবং সামুর মতো একটা প্লাটফরম এর দায় এড়াইতে পারবে না।
একজন লেখক ৬৬টি বছর ধরে সাবলীলভাবে সাহিত্য চর্চা কইরা গেছেন, আর আপনি তার সাহিত্য পড়েন নাই, না পড়েই আপনি তাকে খারিজ কইরা দিতাছেন- আপনার মানসিক সক্ষমতা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। হয় আপনি মানসিক প্রতিবন্ধি, না হয় আপনার আর মাতাল পরীমনির মধ্যে কোন ফারাক নাই। পরিশেষে আপনার ভাষায় বলি, “লেখকদের ব্যক্তিত্ব তাদের লেখার লাইনে লাইনে লেখা থাকে।”
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০২১ দুপুর ১:১৭