স্টুডেন্ট লাইফে বন্ধুদের আড্ডায় একটাও বাজে শব্দ উচ্চারণ না করে সবচেয়ে অশালীন কথা কইতাম। এক পর্যায়ে কেউ কেউ কানে আঙুল দিয়া রাখতো। আমি কিন্তু সত্যিই কোন কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন শব্দ উচ্চারণ করতাম না। এই ব্যাপারে এখনো আমি কাবিল। আমার বন্ধুমহল এই বিষয়টা অবগত। এই প্রসঙ্গটা কেন টানলাম সেইটা একটু পরে ব্যাখ্যা করতেছি। সামুতে সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্য, যৌনতা ও অশালীনতা বিষয়ক বিতর্ক তৈরী হইছে। ব্যাপারটা ভালই, মাঠ গরম থাকলে ভালো লাগে । মনে হইলো কিছু কথা কইতে পারি। আগেই বইলা রাখি কারো সাথেই আমার এইখানে শত্রুতা বা ইগো জাতীয় সম্পর্ক নাই, এটা এসব করার জায়গাও না। তবে অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকবে, এইটাই স্বাভাবিক। এই লেখায় আমি আমার দ্বিমতগুলা প্রকাশ করবো, মতামত প্রদানকারীর নাম উল্লেখপূর্বক, তার প্রতি শ্রদ্ধা রাইখাই। আকারে ইঙ্গিতে কথা কইতে আমার ভালো লাগে না।
জনাব ইফতেখার ভূঁইয়া ভাই চাঁদগাজী ভাইয়ের একটা লেখায় মতামত দিয়েছেন, “কুরুচিপূর্ণ এবং অশালীন শব্দসম্পন্ন লিখাগুলোকে রিপোর্ট করার অনুরোধ থাকছে।” বুঝাই যাচ্ছে ফড়িং অনুর ‘ব্রা’ আর জটিল ভাইয়ের ‘প্যান্টটি’ প্রসঙ্গে এসব বলা। চাঁদগাজী ভাইও সেদিকে ইঙ্গিত করেই তার লেখাটা লিখছেন। ফড়িং অনুর ‘ব্রা’ কবিতাটি পড়লাম, জটিল ভাইয়ের ‘প্যান্টটি’ যেকোন কারণে সরায়া ফেলা হইছে, তাই পড়তে পারিনি। সেটা পাইলে আলোচনাটা করতে সুবিধা হইতো। লেখা সরায়া নেয়ার বিষয়টা আমার পছন্দ না। লেখা সরায়া নেয়াটা অনেকটা নিজের অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার মতো ব্যাপার। তবে এইটাও কইয়া রাখি, এদের দুইজনের লেখাকে লিগেসি দিতে আমি এখানে আসি নাই। কিন্তু এই বিতর্কে আমার একটা অবস্থান আছে, সেইটা নিয়াই বলবো। এখন প্রশ্ন হইতাছে একটা শব্দ বা বাক্য শ্লীল নাকি অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ নাকি সুরুচিপূর্ণ সেইটা কিভাবে নির্ধারিত হবে? অভিধানে শব্দটার যে অর্থ আছে তার বিচারে নাকি কোন পরিপ্রেক্ষিতে শব্দটা ব্যবহার করা হইলো তার বিচারে? ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য আমি কিছু উদাহরণ দিতাছি।
ছবির লিংক
হুমায়ুন আহমেদের (কাউকে কাউকে দেখি কালিদাসের সাথে হুমায়ুনরে তুলনা দিয়া হুমায়ুনকে তুচ্ছ করেন। হুমায়ুন অন্য জিনিস, কালিদাস সেখানে পৌঁছাইতে পারবে না। এটা নিয়ে ভবিষ্যতে লিখার ইচ্ছা আছে) একটা অনবদ্য সৃষ্টি ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। উপন্যাসের এক জায়গায় কোন একটা চরিত্র আরেকটা চরিত্ররে একটা শিলুক (ধাঁধাঁ) জিগাইতাছে-
“চামড়ার বন্দুক বাতাসের গুল্লি-বলেনতো এইটা কী?
জানি না, কী এইটা?
এইটা হইল গিয়া "পাদ"। পাদের শব্দ হইল গুলি,আর চামড়ার বন্দুক হইল "পুটকি"।”
হালের আরেকজন গল্পকার হিমেল হাসান বৈরাগি। তার ‘একজন গল্পকার ও কয়েকটি চরিত্র’ নামের একটা গল্পের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতেছি-
“কিতাব আলী বিড়িতে আগুন ধরিয়ে লম্বা টান দেয়। মাথা এবং পাছা ভয়ংকর গরম, অথচ পুরো শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। মাথা গরম লোক যা ইচ্ছা তাই করে ফেলতে পারে। পাছা গরম লোকদের কিছুই করার থাকেনা, শুধু ঘন ঘন পাদ মারে। কিতাব আলী এই মুহূর্তে ঘন ঘন পাদ মারছে আর বিরক্ত হচ্ছে। বিরক্ত হবার কারণ হলো তার পাদে কোন গন্ধ নাই, শব্দ নাই।” গল্পের লিংক
আপনি কি এইখানে কুরুচিপূর্ণ বা অশ্লীল কিছু পাইতেছেন? আমি আসলেই পাইতেছি না। আপনি যখন পুরা গল্পটা বা উপন্যাসটা পড়বেন, আপনার কাছে স্বাভাবিকই মনে হবে। এইবার অন্য উদাহরণে যাই। আমি কিছুদিন টিকটকে ভিডিও দেখছিলাম। আসলে ভিডিও না, ভিডিওর চাইতে আমার কমেন্টগুলা পড়তে ভালো লাগতো। এই রকম কমেন্ট পড়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। কয়েকটা কমেন্টের কথা কই। স্বাস্থ্যবান একটা মেয়ে (আমি কিন্তু কোন অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করি নাই) মোটামুটি খোলামেলা একটা ভিডিও দিছে। তো সেই ভিডিওর নিচে একজন কমেন্ট করছে, “যারা লিজেন্ড তাদের চোখ বিশেষ একটা জায়গায় আটকে আছে।” আরেকজনের কমেন্ট, “পাহাড় দু’টিতে চড়তে চাওয়া আমার নিষ্পাপ মন।” ভালো মেটাফর। আরেকজন আরো এক কাঠি সরস। ঐ কমেন্টটি পড়ে আমি অভিভূত, সে ঐ ভিডিওতে কমেন্ট করছে, “তোমার ফ্রিজে আমার শসাটা রাখতে দিবা?” আপনি কি এইখানে সুরুচিপূর্ণ বা শ্লীল কিছু পাইতেছেন, কন দেখি? এই তিনটা কমেন্টে তো একটাও অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ শব্দ নাই, কিন্তু কী ভয়াবহ অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত তারা বহন করতাছে।
প্রতিটা শব্দেরই অর্থ আছে কিন্তু তা ভাবনিরপেক্ষ যতক্ষণ না তাকে আপনি কোন কনটেক্সটে ফেলবেন। ব্যাপারটা অনেকটা আপনার ঘরের গ্লাসের মতো, মদ খাইলে মদের গ্লাস আর পানি খাইলে পানির গ্লাস। আমি যখন ‘চুৎমারানী’ বলি, তখন এইটা গালি হয় আর হেলাল হাফিজ যখন তার ‘যার যেখানে জায়গা’ কবিতায় ব্যবহার করেন, তখন তা প্রতিবাদের ভাষা হয়, উৎকৃষ্ট সাহিত্য হয়: “আমিও গ্রামের পোলা, চুৎমারানী গাইল দিতে জানি।” আপনি চাইলে হেলাল হাফিজকে রিপোর্ট মারতে পারেন বা আদি মধ্য যুগের কবির মতো গালি কবিতায় ব্যবহার করতে পারে নাই বইলা তারে রিজেক্ট কইরা দিতে পারেন।
এবার সামুতে অশ্লীল লেখা বনাম সাহিত্য নিয়া যে খুনসুটি চলছে তা নিয়া একটু কথা কই, বেয়াদবি লইয়েন না। পর্ন কন্টেন্ট আর লিটারেচারের ফারাকটা বুঝতে হইলে আপনারে রসময়গুপ্ত আর নির্মলেন্দু গুণের ফারাকটা বুঝা লাগবে। ছোটবেলায় আমরা অনেকেই রসময়গুপ্তের লেখা পড়ছি। (আপনাদের কথা জানি না, তবে আমি আগ্রহ নিয়াই পড়ছিলাম।) ঐ ধরণের লেখার বিষয়বস্তু নিয়া বিস্তারিত যাইতে চাই না, আমার মতো যারা আছেন, তারা জানেন। বিষয়বস্তু সোজা কথায় যৌনতা। রসময়গুপ্তের কোন লেখা এখানে কোট করা যাবে না। এইটা সেই জায়গা না। ঐ ধরণের লেখাগুলার লেখক ও পাঠকের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকতো, বিশেষ অনুভূতি জাগ্রত করা ও চরিতার্থ করা। কবি নির্মলেন্দু গুণেরও পুরা দুইখান কবিতার বই আছে, যার বিষয়বস্তুও নিরেট যৌনতা। ফড়িং অনু তার ব্রা কবিতায় তেমন কিছুই লেখেন নাই যা গুণ সাহেব তার কবিতায় নিয়ে আসছেন। নির্মলেন্দু গুণের একটা বইয়ের নাম ‘বাৎসায়ন’ আরেকটার নাম ‘কামকানন’ যেখানে তিনি শুধুমাত্র যৌনতা বিষয়ক কাব্যগুলারেই অন্তর্ভূক্ত করছেন। শুধু নির্মলেন্দু নন, বিশ্বের অনেক নামী-দামী সাহিত্যিক এই ধারায় বিচরণ কইরা গেছেন। ব্যাপার হইলো যেই বিশেষ অনুভূতি রসময়গুপ্ত জাগ্রত করতেন, সেই অনুভূতি এনাদের সাহিত্য পড়লে জাগ্রত হয় না, এটা তাদের উদ্দেশ্যও না। আসেন এই উসিলায় নির্মলেন্দুর এমন দুইখান কাব্য পাঠ করি-
১. বর্ষা ছিল পাকতে-শুরু ডাঁসা ভুবির স্তনে,
দিন-দুপুরে আঁধার করা যোগীশাসন বনে।
বর্ষা ছিল ধান-ডোবানো মাঠ-ভাসানো জলে,
সাঁতার কাঁটা বুনো হাঁসের কামার্ত দঙ্গলে।
তাদের কাছেই চিনেছিলাম তেপান্তরের মাঠ,
তারাই আমায় দিয়েছিল কামশাস্ত্রের পাঠ।
কামকলাতে এই যে আমার একটু বাহাদুরি,
বর্ষাবালার কাছ থেকে তা করেছিলাম চুরি।”
২. রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে,
বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়াসে ঢুকে যাও-
সে যেখানে নগ্ন দেহে স্নানার্থেই তৈরি হয়ে আছে
আলোকিত দুপুরের কাছে- মনে রেখো,
তোমার রাত্রি নেই, অন্ধকার বলে কিছু নেই।
বিবাহিত মানুষের কিছু নেই একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রীশয্যা ছাড়া।’
দ্বিতীয় কবিতার নাম ‘স্ত্রী’। এখন এই দুই কবিতা পইড়া যদি আপনারে বাথরুমে দৌড়াইতে হয়, রসময় পড়লে আপনি মারাই যাইবেন। এখন আপনি যদি নির্মলেন্দু গুণরে কবি বইলা স্বীকার করতে না চান, যেভাবে চাঁদগাজী সাহেব কবি সৈয়দ শামসুল হককে স্ট্যান্টবাজ বলেছেন (এ বিষয়ে শীঘ্রই লিখবো) তাইলে তালগাছ নিয়া বিচারে বসার বোকামীর দায় আমাকে নিতেই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২১ দুপুর ১:৩০