নতুন কোন জায়গায় বেড়াতে গেলে তা হোক দেশ আর বিদেশ প্রথম যে জিনিসটি আমার চোখে পড়ে তা হল ঐ স্হানের প্রকৃতি এরপর অবকাঠামো তারপর লোকজন।আসলে বেড়ানো মানে শুধু নির্দ্দিষ্ট কিছু জায়গা আগে থেকে নির্বাচন করে তা দেখা আর ছবি-টবি তুলে চলে আসা এটা আমার কাছে কেমন জানি খাপছাড়া খাপছাড়া লাগে....। এজন্য যেখানেই যাই যে কয়টা লোকেশনে যাইনা কেন, পারিপার্শ্বিকতা এমনভাবে গ্রাস করে আমাকে..মাঝে মাঝে নিজেই ভাবি এতটা আত্মনিমগ্ন হয়ে প্রকৃতি,বস্তু,মানুষজনকে দেখার কি দরকার আছে?আর ভ্রমন সঙ্গীটি যদি হ্য় আমার মত বাউন্ডুলে তাহলে আর কথাই নেই.''এমনিতেই নাচুনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি''।
আগের পর্বে প্যারিস পৌঁছে স্টেশনে বন্ধুর সাথে পূণর্মিলনের মাধ্যমে যবনিকা টেনেছিলাম আজ এর পর থেকে শুরু করব।অনেকে (যে দু একজন পড়ছেন) হয়ত বিরক্ত বোধ করছেন ডিটেইল্সের আধিক্য দেখে ।এক্ষেত্রে আমি স্বীকার করব যে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাবার ক্ষেত্রে আমি কম গতিময় কারণ আমি লেখালেখি করিনি কোনদিনও যার কারনে নির্দ্দিষ্ট কোন ছকে আমি এগুতে পারছিনা।গরগর করে বলে যেতেও পারছিনা।কিছু ডিটেইল্স(ধান ভানতে শিবের গীত ) হ্য়ত বাদ দেয়া যায় বেড়ানোর এ কাহিনীটিকে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে নেবার জন্যে এবং পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটানোর জন্যে(এই যেমন এলাম দেখলাম খেলাম এবং ছবি তুললাম) তাহলে হয়ত নির্মেধ ,বাহুল্য বর্জিত ভ্রমন কাহিনীটি এক পোস্টে শেষ করা যেত। যাহোক আপনাদের কাছে নিবেদন থাকবে নতুন হিসাবে আমার এ ত্রুটিকে আপনারা একটু প্রশ্রয় দিবেন বা লিখতে লিখতে লিখেন !!( গাইতে গাইতে গায়েন!!!) হবার একটি সুযোগ আপনারা দিবেন ...।
Gare du Nord স্টেশনের নীচেই আন্ডারগ্রাউণ্ড স্টেশন যেটাকে ওরা মেট্রো স্টেশন বলে ..এলিভেটরে আমরা নীচে নামলাম।নেমেই প্রথম ধাক্কাটা খেলাম!! মেট্রো তে চড়ে আমরা যাব ইমনের বাসায় সেটা শহরের উপকন্ঠে লিল্যাক নামক জায়গায়।সুতরাং আমাদের দুজনের টিকেট বা পাস লাগবে।ইমন টিকেটের জন্য কিউতে দাড়াল।সেদিন ছিল শুক্রবার।আমরা ইমনকে প্রথমেই বলেছিলাম উইকলি পাস করার জন্য(পুরা এক সপ্তাহ বাস বা মেট্রোতে যত খুশী ততবার ভ্রমন করা যায়) কারন আমরা ওয়াইড্লি বা রেনডম্লি ঘুরব।তাকে আমি পন্চাশ ইউরো দিলাম। সে কাউন্টারের মহিলাকে ফ্রেন্চ ভাষায় কি যেন বলল; ফিরে এসে দুইটা স্লিম টিকেট আর কিছু চেইন্জ আমাকে দিয়ে বলল,''চল''।সে আগে আগে চলছে আর আমি হাসান তার পিছু পিছু ।
আমি স্লিম সেই পাসটা মতান্তরে টিকেট টা এন্টারিং হোলে ঢুকালাম কিন্তু গেইট খোলে না(ওদেরটা হুইল সিসটেম বাট লন্ডনের টা গেইট সিসটেম এবং সুইজারল্যান্ড এ ও একই)।বারবার পাসটি ডুকাই আর ওটা এক্সিট হোলে বের হয় কিন্তু হুইল ঘোরে না আমিও ভেতরে যেতে পারিনা।এটা হওয়ার একটাই কারন হতে পারে -টিকেটটি মেয়াদোত্তীর্ণ কিন্তু এটা যে এইমাত্র কিনলাম! সাতদিনের মেয়াদসহ!! ইমন বেরিয়ে এসে টিকেট দুটা নিয়ে মহিলার কাছে গেল ততক্ষণে লম্বা কিউ পড়ে গেছে তার কাউন্টারের সামনে।যাহোক, সে পাশে গিয়ে ইমারজেন্সী বলে কয়ে মহিলার সাথে কথা বলল..দুজনেই দেখি বাকযুদ্ধে লিপ্ত ,থামাথামির কোন লক্ষণ নাই।আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম ,ব্যাপার কি? সে যা বলল তার সারমর্ম হল : সপ্তাহ শুরু হয় সোমবার থেকে তাই আমাদের টিকেট দুইটার মেয়াদকাল শুরু হবে আগামী সোমবার থেকে(আজ হল শুক্রবার)ইমন ঐ মহিলাকে বোঝাতে চাইল 'এরা দুজন লণ্ডন থেকে এসেছে ট্যুর এ' সে বোঝাল - তার মনে ছিলনা যে উইক সোমবারে শুরু হবে এবং ভূলবশত্ঃ সে উইকলি টিকেট কিনে ফেলেছে এখন মেহেরবানি করে তিনি যেন ঐ টিকেট গুলো রিফান্ড করে ডে টিকেট দেন দশটি(একটা দিয়ে একবার যাওয়া আসা করা যায় তারপর বাতিল) কিন্তু মহিলা গোঁ ধরে বসে আছেন উনি টিকেট ফেরত নিতে পারবেন না এবং কিউ যে লম্বা থেকে লম্বাতর হচ্ছে সেটার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আরো ১১ ইউরো দিয়ে ডে ট্রাভেল টিকেট কিনতে হল..।সাথে রইল আগামী সোমবার থেকে কার্যকর ঐ দুইটা টিকেট কাম পাস।
ইমন এতদিন ওখানে থাকত কেনা ফ্ল্যাটে।তিনরুমের ফ্ল্যাট উইদ কিচেন।তারা টোনাটুনি ,তার শ্যালিকা আর দেড় বছর ব্য়সী একমাত্র মেয়েকে নিয়েই ছোট্ট ছিমছাম সংসার।আমরা ওখানে পৌঁছানোর সপ্তাহ খানেক আগে সে ওখানকার সরকারী ফ্ল্যাট পেয়েছে(আজীবনের জন্য তবে শর্তসাপেক্ষে) আমাদের ভাগ্য ভাল যে আমরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠছি (পরে দেখেছি ফ্ল্যাটে বিশাল বিশাল চারটি রুম)পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে প্রায় আধকিলোমিটার হেঁটেই তারপর তার সেই ''মেরীর ফ্ল্যাট'' ওখানে মেয়রকে বলে ''মেরী'। ফ্ল্যাট এ্যালোকেশন হয় '' মেরীর দপ্তর'' থেকে।
আমি চাটগাঁইয়া, পাহাড় আর সমতল দুটোতেই বিচরণে অভ্যস্ত- সব্যসাচী , কিন্তু বেচারা হাসান ''মেইড ইন নিউখালি''(এটা তার নিজেরই স্বগতোক্তি ,আমার খুব ভাল লাগে তার এই সহজ সরল অকপট স্বগতোক্তি) এমন ভাবে হাঁপিয়ে উঠেছিল মনে হচ্ছিল মাটিতেই বসে পড়বে বুঝি.!!..এমন না যে আমিও তড়তড় করে উঠছিলাম!!!..কিছুদুর গিয়ে একটু দাঁড়াই ,হাসানের জন্য অপেক্ষা করি।অবশেষে মন্জিলে মকসুদে পৌঁছুলাম ব্যাপক শারীরিক জ্বালানী নিঃশেষ করে...অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গায় তার চারতলা বাসাটি...একটা নয় মোট পাঁচ পাঁচটা ভবন ঐখানে..পরপর..।দুপাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝের স্পেসটা বিস্তীর্ণ করেই এই ফ্ল্যাটবাড়ীগুলো নির্মান করা হয়েছে।প্রচুর গাছ গাছালিতে পূর্ণ দুপাশের পাহাড়।প্রতিটা ভবনের আগে পিছে যথেষ্ট স্পেস এবং ইমনের বাসার সামনের খোলা জায়গায় বাচ্চাদের জন্য ছোট্ট পরিসরে পার্ক ও আছে।মোমের মত তুলতুলে বাচ্চাগুলোকে খেলতে ও দেখলাম সেখানে বেশ সাবলীলভাবে (ওগুলোকে ফ্ল্যাট বা বাসা না বলে আমি বাড়ীই বলব কারন লন্ডনের ফ্ল্যাটগুলো কাঠের মেঝেতে মেঝায়িত দেয়ালগুলো ও পারটেক্স বা বোর্ড দিয়ে দেয়ালিত যা আমার কাছে বাড়ী বাড়ী বলে মনে হয়না..এক একটা মুরগীর খোপের মত মনে হয় ,অন্তত যে কয়টা আমি দেখেছি আর বসবাস করেছি..পায়ে ইট কংক্রিটের মেঝের অনুভুতিই অন্যরকম আর কাঠের! ছু!!! .(বর্তমানে যে ডুপ্লেক্স মুরগীর খোপে আমরা থাকি .রাতের বেলায় দোতলায় হাটাচলা করি বেড়ালের মত পাছে নীচের রুমে ঘুমন্ত বন্ধুটির ঘুম ভেঙ্গে যায়) আমার এক কাজিন স্টেটস্ এ থাকে হাবি-কে নিয়ে ওর অবস্হা তথৈবচ!!! যাক অবশেষে আমি ইহাকে পাইলাম!!! মানে কংক্রিটের মেঝে, দেয়াল আর ছাদ বিশিষ্ট বাড়ী..হোকনা শর্ট স্টে আমাদের; অন্তত পাঁচটা দিন কাটবে ভালো।
লিফটে উঠলাম চারতলায়..ববি দরজা খুলে দিল (ইমনের বউয়ের নাম -ববি ,আমি অবশ্য যে কদিন ছিলাম বেবীই ডেকেছি..) ওর বাবামা ভাইয়েরা থাকে জার্মানীতে ওখানে সেটেল্ড।ভাবীর প্রেগনেন্সির সময় ইমন তার শ্যালিকাকে এখানে নিয়ে আসে, বর্তমানে এখানকার একটা কলেজে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করছে... কোলে মেয়েকে নিয়ে ভাবী দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন আসুন মিস্টার ছন্নছাড়া(এই নামে আমি মেসেনজারে ইমনের সাথে চ্যাট করতাম)।উনার সাথে এই প্রথম দেখা আর অভ্যাগতের সাথে প্রথম জড়তাহীন এই সম্ভাষণে আমার আড়ষ্টতা কেটে যায়..মনে মনে বলি এই ক'দিন বেশ আনন্দেই কাটবে আমার বন্ধু আর বন্ধু পত্নীর সাহচর্যে।কিন্তু পাশের জন কে....অমন মায়াভরা মুখ আর উদ্দাম দীর্ঘ কেশরাশি ছড়ানো শ্যামলবরণ তরুনীটি? (ভাবী তুলনামুলকভাবে হলুদাভ..গৌরবর্ণের )ভাবী কতকটা উচ্ছ্বলভাবে পরিচয় করিয়ে দেন-''আমার একমাত্র ছোটবোন-স্নিগ্ধা।'' মৌনী দুপুরের নিস্তব্দতা ভেংগে খান খান হয়ে আমার কানে বাজতে থাকে ..স্নিগ্ধা (বাইরের কড়া পাহাড়ীয়া রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে এসে কেমন জানি স্নিগ্ধই লাগছিল)....একটু হেসে সে অভ্যর্থনা জানায়. .আসুন ভেতরে ..ততক্ষনে পতুলের মত সুন্দর আর খরগোশের মত নরম ইমনের ছোট্ট মেয়েটি আমার কোলে এসে ঠাঁই নিয়েছে ..রূপ (ওদের কন্যার নাম)..সতত কন্যাশিশু প্রিয় এই আমি রূপকে আদর করতে করতে মনে মনে বলি- "নাহ্ ! এইবার একটা বিয়ে করতে হবে; জাস্ট রূপমনির মত পুতুলের বাবা হতে!! চাওয়াটা একটু বড্ড বেশী বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে পড়াতে ঠোঁঠের কোণে সবার অলক্ষ্যে ঝুলে পড়ল এক চিলতে হাসি.....স্নিগ্ধা কি অগোচরে দেখেছে সেই হাসি..হ্য়ত হয়তবা না।
রাতে খাবার দাবারের পর সবাই বসলাম কালকে সকালে বেড়ানোর প্লান নিয়ে।আমাদের গাইড-স্নিগ্ধা।মোটামুটি সব জায়গা চেনে সে(পরবর্তীতে বুঝেছি সে শুধু চেনেই না, ভালো চেনাতেও পারে; অনেকে যা পারেনা) ইমন ব্যস্ত থাকবে কাল,অফিসীয় ব্যস্ততা: মঙ্গলবার অবধি কোন ফুরসত নাই তার।সুতরাং এই স্হির হল যে ,ভাবী বাসায় বাচ্চা সামলাবে আর আমাদের জন্য রান্নাপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে: সকাল দশটায় নাশতা শেষ করেই আমরা তিনজন বেরিয়ে পরব আগামীকাল ।এরপর ইমন আর ভাবী আড্ডা ছেড়ে ঘুমুতে যান: কাল ভোরে উঠতে হবে দুজনকেই।
আমরা তিনজন মিলে আড্ডা দিই -এটা সেটা অনেক কথাই হয়।আচ্ছা কাল সকালে আমরা প্রথম কোথায় যাচ্ছি? স্নিগ্ধার এই প্রশ্ন শেষ না হতেই আমি বললাম, কেন?''আইফেল টাওয়ার''। সে বলল,না!! আইফেলে যাব কাল বিকালে: ফিরব মধ্যরাতে...বলে কি মেয়েটা? হুমম্।
কাল সকালে যাব 'লুভ' মিউজিয়ামে(আমি জানতাম ল্যুভর মিউজিয়াম) -''মশাই ! লোহার জবরজং টাওয়ারটা দেখা আর চড়ার আগে মানবীয় মোনালিসার রহস্যপূর্ণ ও ঐন্দ্রজালিক হাসিটির মর্মভেদের চেষ্টা করাটা কি একজন রোমান্টিক পুরুষের অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিৎ নয় ?--যদি আপনি অতটা দুর থেকে প্যারী তে এসে থাকেন??''
আর শুনুন '' এক্সকিউজ মি'' এর ফ্রেন্চ হল - ''এক্সকিউজমোঁয়া''(আমি বলতাম এক্সকিউজোঁয়া) আর ''সরি'' হল -''পাঁদো''..."আপাতত এই দুইটাই মনে রাখলে চলবে; পরে আরো শেখাব..এবার ঘুমুতে যান।"
স্নিগ্ধার এমনতরো মাস্টারি দেখে আমি সত্যি সত্যি একেবারে মেঝায়িত!!!(মেঝেতে শায়িত-বিব্রত হওয়া বুঝার্থে)
৩য় পর্ব : Click This Link
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৯:০২