স্মরণ
[তরুণ কবি রাকিবুল হক ইবন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন। না, কর্কট রোগ তাকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলেনি, ছিনিয়ে নিয়েছে একটি সড়ক দুর্ঘটনা। প্রায় এক যুগ আগের কথা, ইবন অসুস্থ। কিছুটা আর্থিক সমস্যা চলছে। আমি তখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে কর্মরত। বসকে অনুরোধ করলাম সম্মানজনকভাবে কবি-পরিবারকে সহযোগিতা করতে। আবেদন মঞ্জুর হলো। ইবনের মা সেই থেকে আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতেন, অন্তত যদ্দিন দেশে ছিলেন। পরে ২০০৫ সালে ইবনের ‘উপমানব’ কাব্য বেরুনোর পর দৈনিক প্রথম আলো ১০ তরুণ লেখকের নির্বাচিত বইয়ের তালিকায় বইটি স্থান পায় এবং আমি একটি আলোচনা লিখি। সেই আলোচনাটি এখানে তুলে দেয়া হলো প্রয়াত তরুণ কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। ]
নবীন কবির কাব্য
কবি-কিশোর, শুদ্ধ কেশর
মারুফ রায়হান
উপমানব ॥ রাকিবুল হক ইবন ॥ আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ॥ ফেব্র“য়ারি ২০০৫ ॥ প্রচ্ছদ: রনি আহম্মেদের পেইন্টিং॥ পৃষ্ঠা ১০৪॥ মূল্য ১২০ টাকা॥
কবিতার উৎকৃষ্ট রসাস্বাদনের জন্যে অনেকেই কবির ব্যক্তিগত জীবন, ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অবস্থান এবং পারিপার্শ্ব সম্পর্কে অবহিত থাকাকে জরুরি বলে বিবেচনা করেন। কিন্তু সৎ কবির কবিতায় কি কবির জীবন ও জগৎ লুকোছাপা থাকে? তবে গোটা সত্যের যৎসামান্য প্রকাশ, কিংবা অসত্যের বাড়তি উপস্থাপনাÑ কোনোটাই আমাদের কবিতাঙ্গনে এখন দুর্লভ নয়। বলছি না যে কবিরা অভিনয়শিল্পীর মতো অন্যের সংলাপ আওড়ান না, কিংবা সুন্দর মিথ্যাকে বিস্ময়-জাগানো উপমা ও চিত্রকল্প সহযোগে, মাপা ছন্দে পরিবেশন করেন না। তাই কবিকে জানা জটিল, কবিতা নিয়ে কিছু লেখা জটিলতর। আমরা দেখেছি যে, আষাঢ় আসার আগেই বর্ষা বিষয়ক কবিতার বর্ষণ নামে কবিদের খাতায়; শত্রুসম সতীর্থের প্রয়াণের পরে রাতারাতি স্মরণাঞ্জলিতে ছয়লাপ হয় দৈনিকের সাহিত্য পাতা।
রাকিবুল হক রিবনÑ কৈশোরউত্তীর্ণ এই কবিকে জানি কিছুটা; এই প্রথম আলো-তেই কর্কটরোগের শিকার এই নবীন কবিকে সহায়তাদানের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন একজন প্রবীণ কবি । ‘উপমানব’ কবিতার বইটির ব্ল¬ার্ব থেকে জানা হলোÑ ‘ভারতের অসংখ্য প্রদেশ, মালয়েশিয়া, ও বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের বহু হোটেলে, ক্যাফে ও অনামা বিচে আর প্রায় জনমানবহীন অরণ্য ও সমুদ্রঘেরা দ্বীপে বসে কবিতাগুলো রচিত।’ ভাবছি এতসব যদি না জানতামও তাহলে আমার টুপি খুলে অভিনন্দন জানানো স্থগিত থাকতো কি না!
প্রথম কবিতাটি দিয়েই কথা শুরু করি। ‘প্রস্তুতির জন্যে উদ্বেগÑ এবার চিতাঘেষা বনবালিকার সামনে’ (ঘেষা-য় চন্দ্রবিন্দু নেই, গোটা বইয়েই বেশ বানানসমস্যা দেখছি!) কবিতাটির সবচাইতে সরল পঙক্তি হলোÑ ‘আমার সুস্থতার জন্য শিয়াল-কুকুরের প্রার্থনা’। অথচ লাইনটিতে পাচ্ছি কবিত্ববরণকারী ব্যক্তির বাহ্যিক একটি পরিচয়। সত্যি বলতে কি, অল্পসংখ্যক কবিতাতেই রয়েছে মারণব্যাধি ক্যান্সারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। জানি না সতর্ক সচেতন বিন্যাস কিনাÑ এই সূচনা কবিতাতে আছে ভবিষ্যৎবাদের কথা; আর গ্রন্থের শেষ কবিতার নাম ‘ভবিষ্যৎবাদ’। এখানেও আছে অসুস্থতার প্রসঙ্গÑ তবে বড়োই অপ্রত্যক্ষ এবং আকস্মিকভাবে, লাইনটি তুলেই দিইÑ ‘মৃত্যুর একটি থাপ্পড়ের সঙ্গে আমাদের পিছিয়ে যাওয়া রোমান্স’। গ্রন্থের একেবারে শুরুতেই আমরা মুখোমুখি হবো একটি শনাক্তযোগ্য শক্তিমান কাব্যভাষার; এই ভাষা যেন বেরিয়ে আসছে কবিতাঅভিজ্ঞ, নিঃসঙ্গ, অভিমানী, খোঁচা-খাওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক এক জীবন-পর্যটকের ডায়েরি থেকে। তাতে শুদ্ধতাসন্ধানীর সৌরভ, সংহত আবেগের গাম্ভীর্য।
ষোল থেকে কুড়িÑ জীবনের এমন থরোথরো কালপর্বে রচিত হয়েছে ‘উপমানব’-এর কবিতাগুচ্ছ। এই ‘কাঁচা’ বয়সের ভেতর নিজস্ব একটি শনাক্তযোগ্য কাব্যভাষা অর্জনে সমর্থ হয়েছেন ক’জন বাঙালী কবি? সব গায়ক পাখির গান শুনতে একই রকম লাগায় সমস্যার কিছু নেই, কিন্তু সৃজনশীল লেখকের, প্রধানত একজন কবির জন্যে অপরিহার্য তাঁর স্বকীয় স্বরভঙ্গি ও বিশিষ্ট বাচন খুঁজে পাওয়া। প্রায় অভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন প্রজন্মের দুই কুড়ি কবি কথা বলতে চাইলে তা কি ক্লীশে এবং তাৎপর্যহীন হয়ে উঠবে না? ইবনের এই অর্জনকে সাধুবাদ দিতে হবে। যদিও কবিতার জন্যে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়াই শেষ কথা নয়। কবিতায় অভাবিত অনুভূতির ছটা, বিষয়বস্তু, সারকথা, শিল্পরূপ এবং সত্যান্বেষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইবনের কাব্যভাষার দু’টি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি :
১. ...শিশুর
বুকের সূর্যাস্ত খেয়ে যাচ্ছে যে বিড়াল, ঔষধের জন্য
ঘৃণা, পরীমাংসে গেঁথে রাখা ছুরি ও চাবুক এবং শিক্ষক
ও মনুষ্যরোপিত বন! তোমার মুখের ইচ্ছাকৃত
দধি, বিষণœ ঝিঁ ঝিঁ ও মা; জোয়ারের আস্ত ঘোড়া,
কৃষকরা পেলে ছিঁড়ে খেতে চাচ্ছে... যে রাজপুত্রকে আর
আমার হোটেলের আকাশে একনাগাড়ে উড়তে থাকা
কিরণ, মৃত মানবীকে মৈথুন করে বেড়ে উঠেছে যে নকল
প্রবক্তারা আর, ডিম নিয়ে নন্দন...
(তুমি তো জানো, এশিয়া প্রদেশের সবাই আমাকে ছেড়ে)
২.
আমার জলজীবন-পশুজীবন-উদ্ভিদজীবনের স্মৃতির সঙ্গে ‘আমি তোমাকে খুন
করবো’Ñ এমন একটি উপলব্ধি
আর সাপের হাই লেগে ঝরে পড়া শস্য বসতের সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করা স্বপ্নের কুকুর
দ্রুত একটি গন্ধরাজের সঙ্গে ও গ্রাম শহর থেকে তুমি ফিরবে কবে?
দেশপ্রিয় চির সন্ত্রাসীদের জোটের সঙ্গে রক্ত দিয়ে আমি মুছে যেতে আসি
শিশুদের মৃত মুখগুলি!
(ভবিষ্যৎবাদ)
দু’টি উদ্ধৃতি থেকে অবশ্য স্পষ্ট হলো না যে আধুনিক ফরাসী কবিতার বাকভঙ্গির সঙ্গে এই কবির বাকভঙ্গির কিছুটা সমধর্মিতা বিদ্যমান। এই মন্তব্যের সঙ্গে এটাও যুক্ত করতে দ্বিধা নেই যে ইবনের কোনো কোনো কবিতা আমাদেরকে ষাটের শুদ্ধতাবাদী কবি সিকদার আমিনুল হকের কবিতাপাঠের স্মৃতি মনে পড়িয়ে দেয়। তবে সিকদারও সিকদার হয়ে ওঠেন তাঁর কবিজীবনের পরিণত পর্যায়ে, সুনির্দিষ্ট করে বললে, নব্বুই দশকের প্রথম দিকে ‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরই।
প্রচলিত কোনো ছন্দেই লেখেননি ইবন। পারফেক্ট পয়ারে কিংবা খুঁতহীন মাত্রাবৃত্তে লিখে ছন্দে দখল বা ছন্দোস্বাচ্ছন্দ্য প্রদর্শনকে এখন আর জরুরি বলে ভাবছেন না কবিতার নবীন অনেক পথিক। মিল, মধ্যমিল বা অন্ত্যমিল, অনুপ্রাসÑ কবিতার এইসব গীতল গরিমাকে উপেক্ষা করে যান অনেকেই। ইবনও আছেন এই দলে; তাঁর কবিতার মূল সম্পদ রূপক ও চিত্রকল্প। পঙ্ক্তিবিন্যাসে তিনি প্রবহমানতা বজায় রাখার পক্ষপাতী। তাঁর বেশির ভাগ কবিতার লাইনগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে গদ্য-স্তবকের অবয়ব দিলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটবে না। তবে কখনো বামে, কখনো ডানে, কখনো প্রায় মিডল রেঞ্জ করে পঙ্ক্তি সাজানোর বিষয়টি কবির সজ্ঞান ইচ্ছাপ্রসূত কিনা সে-ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না।
সমকালের দিকে চোখ রয়েছে কবির, তবে রাজনৈতিক কবিতা লেখায় তাঁর সায় নেই। একটি কবিতায় সাড়ে তিন বছরের মেয়ে বলছে : কেক কাটা ছুরি দিয়ে তোমার গলা কেটে তারপর ড্রেনে ফেলে দেব; আরেকটি কবিতায় কবিই বলছেন, ‘... আর প্রধানমন্ত্রী কী চায়? সে চায় আমার ছোটো বোনটিকে ঠেলে দিতে ক্রসফায়ারে, নিশ্চয়ই!’ তাঁর কবিতা পড়লে নিমজ্জিত হতে হয় এমন একটি ভুবনে যেখানে নিসর্গ আর মানব-ঊনমানব, এবং বিচিত্র প্রাণীর বিবিধ নিঃশ্বাসের নেপথ্যে যুগপৎ বহে যায় জ্যোৎস্না ও রক্তধারা; মুখ ভেসে ওঠে অনেক অনেক শিশুর এবং খলনায়ক রাষ্ট্রপতিদের। বাংলাদেশের বর্তমান কবিতাঙ্গনে বিবিধ প্রচারের কল্যাণে অনেক কবিসিংহেরই বিচরণ, তবে তার অধিকাংশই প্রকৃত কবিত্বের ‘কেশর-রহিত’। বলতে ভালো লাগছে, সত্যিকারের শুদ্ধ কেশরের সৌন্দর্য-সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করলাম কবি-কিশোর রাকিবুল হক ইবনের মধ্যে। তাঁকে সেলাম।