ঢাকার কড়চা
বিজয়ের কবিতা গান, বাংলা ব্লগ দিবস
এবং পঁচাত্তরে দুই সাহিত্যিক
মারুফ রায়হান
বাংলা ব্লগ দিবসের ঘোষণা-সন্ধ্যায়
দেশের প্রথম কমুনিটি বাংলা ব্লগসাইট সামহোয়্যার ইন ব্লগÑ বাঁধ ভাঙার আওয়াজÑ ১৯ ডিসেম্বরকে বাংলা ব্লগ দিবস হিসেবে নির্ধারণ করে ওই দিন সন্ধ্যায় তাদের গুলশান কার্যালয়ে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলা ব্লগ দিবসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন শিাবিদ আনিসুজ্জামান। নির্ধারিত সময়ে ভেন্যুতে গিয়ে দেখি হাতে গোণা কয়েকজন ব্যক্তি। মনে শঙ্কা শেষ পর্যন্ত অর্থহীন হয়ে উঠবে নাতো এই আয়োজন। কারণ ইতোমধ্যে অপর বাংলা ব্লগসাইট ‘সচলায়তন’ এই দিবসকে উপোর ঘোষণা দিয়েছে। তারা হয়তো অন্য একটি তারিখকে ব্লগ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেবে। কে জানে অন্য কোনো প অন্য কোনো দিবস নির্ধারণ করবে কিনা। বিষয়টি একটু অস্বস্তিকর। আবার অন্যভাবে দেখলে মজারও বটে। হোক এরকম একাধিক দিবস। এতে ভিন্ন ভিন্ন দিবসে ব্যাপক আয়োজন ও প্রচারণার ভেতর দিয়ে মূলত ইন্টারনেটে বাংলা চর্চার বিষয়টিই প্রচারিত ও প্রসারিত হবে। কয়েক বছর পর আবার হয়তো সকলে মিলে একটা সমঝোতায় এসে ‘ত্যাগ স্বীকার’ করে দিবসগুলোর ভেতর থেকে একটি বা ভিন্ন কোনো একটি দিবসকে নতুন করে বাংলা ব্লগ দিবস হিসেবে মেনে নেবে। যাই হোক, এক ঘণ্টার মধ্যে কটি পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এসে গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সামহোয়্যার ইন-এর হেড অব এলায়েন্স জানা ( সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস) আনিস স্যারকে স্বাগত জানালেন। স্যার তাঁর বক্তৃতায় বাংলা ব্লগ যে যোগাযোগের নতুন জানালা খুলে দিয়েছে তার প্রশংসা করলেন। বাংলা ব্লগ দিবস করার চিন্তা যে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার একটি দিক সেকথাও বললেন।
ব্লগার কৌশিক ছিলেন অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক। প্রথম প্রথম তিনি মঞ্চমতো জায়গাটিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন বক্তব্য দেয়ার জন্য। পরে মাইক্রোফোন সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে গেল প্রত্যেক অতিথির কাছে। এরা সকলেই সামহোয়্যার ইনের ব্লগার। এঁদের ভেতর ছিলেন লীনা দিলরুবা, সুনীল সমুদ্র, সালাউদ্দিন শুভ্র, অমি রহমান, শওকত হোসেন মাসুম, অন্যমনস্ক শরৎ, কালপুরুষ, মনজুরুল হক, একরামুল হক, বৃত্তবন্দী, শয়তান, হাসিন, মাহমুদ, জিয়া রায়হান, জোহরা ফেরদৌসী, আজমান আন্দলীব, পথিক, নীল আকাশের দুঃখ, লাভলুদা, রুখসানা তাজিন, তারার হাসি, আরিন সুলতানা, যূথীসহ অনেকেই। সত্যি বলতে কি প্রত্যেকেই ভালো বক্তব্য দিলেন। বক্তব্যের ভেতর মজার উপাদানও ছিল। যেমন তাজিন বললেন যে, ইন্টারনেটে মাসুমভাইয়ের নারীপ্রীতি সম্পর্কে আমরা জানি, অথচ এখানে তাকে সেরকম মনেই হচ্ছে না। আমরা সবাই কি এতখানি ভদ্র থাকি ব্লগে? অন্যদিকে আইরিন সুলতানা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরণ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন। এক ঘর মানুষের ভেতর একজনের সঙ্গেও আমার সামনাসামনি পরিচয় ছিল না। (যদিও দু’জন বললেন আগে আলাপ হয়েছে আমার সঙ্গে, দিলরুবা নাকি প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার একটি লেখার প্রশংসা করে আমাকে মেইল করেছিলেন) এতজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগটি আমি কাজে লাগালাম। যতটা পারি গল্প করলাম, বাংলামাটি পড়তে ও এতে লিখতে বললাম। কারণ এরা প্রত্যেকেই এককজন লেখক। সৃষ্টিশীলতার আকাক্সা রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই হৃৎস্পন্দনে। যদিও রোজনামচার আঙ্গিকেই তারা লেখেন যেগুলোর পোশাকি নাম ‘পোস্ট’। আসলে সেগুলো কোনো বড় লেখারই বীজ। এই লেখকবৃন্দ যদি যথার্থ পরিচর্যা পান বা তাদেরকে যদি অনুপ্রাণিত করা সম্ভব হয় তবে এদের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসবেন আগামী দিনের শামসুর রাহমান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজীজুল হকরা।
আমি একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই ল্য করলাম যে, একটি বাংলা ব্লগের জন্মের সঙ্গে এবং তার ব্যয়ভার বহনের সঙ্গে প্রত্যভাবে জড়িয়ে আছেন একজন বিদেশি ভদ্রলোক। তাঁকে আমি বাংলাপ্রেমিক বিদেশি হিসেবেই সম্বোধন করতে চাই। তিনি জানা-র স্বামী, সামহোয়্যার ইনের হেড অব অপরচুনিটিস আরিল্ড কোক্কেরহৌগ। একজন ব্লগারের কাছ থেকে জানা গেল অনুষ্ঠানে পরিবেশিত গরম পিঠা আরিল্ডই বানিয়েছেন। পরিবেশনে বিলম্বের জন্য যে পিঠাগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল সেগুলো ভদ্রলোক পরিবেশন করেননি। এই সৌজন্যবোধটুকু আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। অপর ব্যক্তি বা সহযাত্রী অপর ব্লগ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাসিক্ত বক্তব্যও আমাদের মনকে বিশেষ ভালোলাগার ভুবনে নিয়ে গেল। ব্লগে অসদাচরণের জন্য কাউকে ব্যান করার বিষয়টি জনসমে জানানোর প্রস্তাবনাকে বিনয়ের সঙ্গে নাকচ করে দিলেন জানাÑ এই দৃষ্টিভঙ্গিটুকু সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। সামহোয়্যার ইন ব্লগ দীর্ঘজীবী হোক; বাঁধ ভাঙার আওয়াজ উঠুক সমাজের সকল স্তরে।
জন্মদিনে সৈয়দ শামসুল হক ও রাবেয়া খাতুন
গত বছর ২৭ ডিসেম্বর দেশের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের বাসভবনে তাঁর জন্মদিন পালনের বিশদ সংবাদ এই কলামে বাংলামাটির পাঠকরা পেয়েছিলেন। এবছর তিনি পারিবারিক পরিমণ্ডলে জন্মদিন উদযাপনের তেমন সুযোগ পেলেনই না। কারণ এবার তাঁর এবং দেশের আরেক বরেণ্য সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের জন্মদিন সাড়ম্বরে পালিত হলো একাধিক স্থানে প্রায় জাতীয়ভাবেই। জাতির মননশীলতার প্রতীক বাংলা একাডেমি এবারই প্রথম জীবদ্দশায় কোনো সাহিত্যিককে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা জানালেন। অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটিতে আমার যাওয়া সম্ভব হয়নি পেশাগত চাপের জন্য। তবে পরের দু’টি অনুষ্ঠানে পালাক্রমে উপস্থিত থেকেছি। শুনেছি বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানটি বেশ ভালো হয়েছে। দু’জনারই সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সত্যি বলতে কি এই দুই লেখকেরই যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। সৈয়দ শামসুল হকের বরং অপপ্রচার ও অবমূল্যায়ন হয়েছে। অপরদিকে রাবেয়া খাতুনের ত্যাগ ও নিবেদনের উচ্চতাকে উপো করে গেছে সাহিত্যিকমহল। একমাত্র ড. আকিমুন রহমানের গবেষণাতেই আমি দেখেছি যে, রাবেয়া খাতুনের অবদান নিয়ে বিশেষ আলোকপাত রয়েছে। শাহবাগের বিসিএস মিলনায়তনে বাংলাদেশ রাইটার্স কাবের আয়োজনে সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিনের উৎসবটি ছিল সত্যিই সাহিত্যমহিমাযুক্ত ও আনন্দঘন। নির্ধারিত তিন আলোচক, বিশেষ করে সলিমুল্লাহ খান লেখকের ‘খেলারাম খেলে যা’ সম্পর্কে যে আলোচনা উপস্থিত করলেন এরকম যথার্থ মূল্যায়ন এই উপন্যাস সম্পর্কে এর আগে আমরা পাইনি। কবি হিসেবে খানিকটা উপোই যেন পান দেশের অন্যতম প্রধান কবি সৈয়দ শামসুল হকÑ এমন বক্তব্যও উঠে এলো কারো কারো শুভেচ্ছা বক্তব্যে। মঞ্চে আসন গ্রহণের জন্য সৈয়দ হকের সহমর্মিনী কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হককেও আয়োজকরা আহবান জানিয়েছিলেন, বিষয়টি শোভাময় বলে বিবেচিত হয়েছে অনেকের কাছেই। একজন লেখকের অর্জনের নেপথ্যে লেখকের স্বামী বা স্ত্রীর একটি বিশেষ অবদান থাকে। মনে হয় এই বিচারে আনোয়ারা সৈয়দ হকের অবদান যে কারুর তুলনায় অনেক বেশি ও গভীর। একটা বিষয় নিশ্চয়ই কিছুটা লজ্জার জন্ম দিয়েছে সৈয়দ হকের হৃদয়ে যে, কেউ কেউ তাঁকে রবীন্দ্রনাথের পরে স্থান দিতে চেয়েছেন; কেউ আবার ভবিষ্যতে নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল সমবেত সুধিজনদের হাতে হাতে ৭৫টি প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে। সে সময় কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমান মঞ্চে গাইছিলেন ‘তুমি মঙ্গল করো...’। সব মিলিয়ে দারুণ আয়োজন। ধন্যবাদ পেতে পারেন রাইটার্স কাবের দুই কর্তাব্যক্তি মুহাম্মদ নূরুল হুদা ও মোহন রায়হান।
এর পরই ছুটে যাই শেরাটন হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে। সেখানে সন্ধ্যা থেকেই চলছে অনুষ্ঠান। জন্মদিন উপলে হলেও এর অন্য একটি গুরুত্বও রয়েছে। সেটি হলো রাবেয়া খাতুনের প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতি’-র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হওয়া। অনুবাদ করেছেন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। বিশাল মঞ্চে বসেছিলেন রাবেয়া খাতুন এবং অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও উপস্থাপক লেখক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। যথেষ্ট হৃদ্যতাপূর্ণ আনন্দময় একটি আয়োজন। পঁচাত্তরে পৌঁছেও রাবেয়া আপা দু’হাতে লিখে চলেছেন। তাঁর স্নেহের দৃষ্টি প্রসারিত সর্বত্রই। যেমন আমাকে দেখেই বললেন, খেয়েছো তো? কেক আর খাবারের প্রাচুর্যের এই সন্ধ্যায় যত প্রকাশককে দেখলাম ততজন লেখকের সান্নিধ্য যেন পেলাম না। লেখকের জন্মদিনে এত কম লেখক কেন! উত্তরায় ফিরতে ফিরতে আমার উপলব্ধির সমর্থন পেলাম সুসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের উচ্চারণে। হক ভাই এবং রাবেয়া আপা অন্তত আরো দুই যুগ আমাদের দেশকে তাঁদের মূল্যবান সাহিত্যসৃষ্টি দিয়ে উপকৃত করুনÑ মনে মনে এই ছিল আমার চাওয়া। আমি নিশ্চিত আমার এই চাওয়াটুকু অনেক অনেক সাহিত্যপ্রেমিকেরও চাওয়া।
ক্যাপশন
বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে (বাম থেকে) আসাদ চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবীর চৌধুরী, রাবেয়া খাতুন ও একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান
সম্পূর্ণ লেখাটি পড়তে কিক করুন