টুকরো টুকরো ভালবাসা- ১১
আনন্দে ছোট্ট শিশুর মতো লাফাতে ইচ্ছে করে মেয়েটির। কিন্তু সে তো আর এখন ছোট্ট মেয়েটি নেই। তাই নাচের ইচ্ছেটা মনে রেখে চোখ-মুখের উজ্জ্বল হাসিতেই ধরে রাখে আনন্দটুকু। স্টেজ থেকে নিচে নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে। দর্শক সারির মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় এদিক ওদিক থেকে সিনিয়র-জুনিয়র-ব্যাচমেটদের হাততালি-শিস আর ছুঁড়ে দেওয়া মন্তব্য তার আনন্দের সাথে মিশিয়ে দেয় লজ্জার আভাও। দর্শকসারির মাঝামাঝি ওর কয়েক ব্যাচমেটকে বসে থাকতে দেখে মেয়েটি এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে ছেলেটির কথা। ওরা জানায়, কিছুক্ষণ আগে এখানেই ছিল ছেলেটি। এখন কোথায় গেছে তারা জানে না। কিন্তু ফ্যাশন-শোর অংশটুকু ছেলেটি দেখেছে বলে ওরা জানায়। কলেজের রোটার্যাক্ট ক্লাব আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। কলেজের ছাত্রছাত্রীরাই এখানে পারফরমার, তারাই দর্শক। ফ্যাশন-শো মানে এখানে নির্দিষ্ট কারো ডিজাইনের পোশাক-প্রদর্শনী নয়। মিউজিকের তালে-তালে ছেলে-মেয়ে জুটি বেধে ক্যাট-ওয়াকের মতো কিছু একটা করার চেষ্টা। এক এক জুটির এক এক ধরণের পোশাক। 'কোরিওগ্রাফার'ও কলেজের ছাত্রছাত্রী। এটাই তাদের কাছে 'ফ্যাশন-শো'।
স্টেজের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি দেখে, জুনিয়র কাশ্মীরী একটা মেয়ে গান গাইছে এখন। আবছা আলোয় যতটুকু দেখা যায় অডিটরিয়ামের হলের ভেতরটা দেখে নেয়। ছেলেটিকে চোখে পড়ে না কোথাও। মেয়েটি বেরিয়ে আসে হলের বাইরে।
ছেলেটিকে ফোন করে। কয়েক রিংয়ের পর ফোন ধরে ছেলেটি।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে - 'কোথায় তুমি?'
'এইতো চত্বরে।'
'চত্বরে কেন?'
'এমনি।'
অডিটরিয়ামের মূল গেটের সামনে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে লেডিস হোস্টেলের ঠিক বাইরেই কলেজ চত্বরের মাঝে বসে থাকার জায়গাটা। কিন্তু এখন রাত বলে গেট থেকে বোঝা যাচ্ছে না ছেলেটা ঠিক কোথায়। মেয়েটা চত্বরে এসে ছেলেটিকে এক কোণায় চুপ করে বসে থাকতে দেখে।
ছেলেটির পাশে গিয়ে বসে মেয়েটি। জিজ্ঞেস করে - 'প্রোগ্রাম দেখবা না?'
ছেলেটি কোন জবাব দেয় না। মেয়েটি জানে, ছেলেটির মন খারাপ। জানে মন খারাপের কারণটাও। কিন্তু কারণটা মেনে নিতে পারে না মেয়েটি। কি এমন খারাপ কাজটা করেছে সে? ফার্ষ্ট ইয়ার থেকেই সে ব্যাচ আর কলেজের বিভিন্ন ফাংশনে ফ্যাশন-শো আর নাচ করে আসছে। এবারও বরাবরের মতো প্রোগ্রামের আয়োজক সিনিয়র ভাইয়া-আপুরা ধরেছে। মেয়েটির নিজেরও উৎসাহ ছিল। কিন্তু ছেলেটির তাতে সায় ছিল না। ছেলেটি অবশ্য এ নিয়ে খুব বেশী জোরাজুরি করেনি। প্রথমে একবারই বলেছে, এটা তার পছন্দ না। এ কারণে মেয়েটি করবে না বলেই ভেবেছিল। কিন্তু সহপাঠী আর অন্যদের কাছে কারণটা বলতে বাধছিল তার। নিজেকে এবং ছেলেটিকেও তাতে সবার সামনে ছোট করা হবে বলে মনে হয়েছিল। মেয়েটি যখন ফ্যাশন-শো করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার ছেলেটির সাথে আলোচনা করতে চেয়েছে, ছেলেটি শুধু বলেছে - 'তোমার ইচ্ছে।' তবে জোড়া বেধে নাচটা সে বাদ দেয়। ফ্যাশন-শোর জন্য ছেলেটিকেই নিজের জোড়া হিসেবে নিতে চায় সে। কিন্তু ছেলেটিই রাজী হয় না। পরে সহপাঠী আরেক ছেলে ওর জুটি হয়।
এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই ছেলেটির মুখ ভার ভার। মেয়েটির কোন রিহার্সালও দেখতে আসেনি সে। বুঝতে পারলেও মেয়েটি এ নিয়ে কোন কথা বলেনি আর ছেলেটির সাথে। অনুষ্ঠান দেখার পর ছেলেটির রাগ পড়ে যাবে বলে ধারণা ছিল ওর। কেননা, ছেলেটি যখন শুধুই মেয়েটির সহপাঠী বা বন্ধু ছিল, যুগল সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তখনো, ছেলেটি ওর নাচ আর ক্যাটওয়াকের ভক্ত ছিল, সময়ে-অসময়ে এ নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতো সে।
কিন্তু আজ ছেলেটি এ নিয়ে কোন কথা বলে না। মেয়েটি নিজেই জানতে চায়- 'দেখছো?'
'হু'- সংক্ষিপ্ত জবাব ছেলেটির।
'কেমন হইছে?'
'ভাল'- শুষ্ক, নিরাসক্ত কন্ঠ।
'লোকজন কেমন তালি দিচ্ছিল দেখছো? আমাদেরটাই সবচেয়ে ভাল হইছে।'
ছেলেটি কোন জবাব দেয় না। মেয়েটির মনে উড়ে বেড়ানো আনন্দের প্রজাপতিটা রং হারায়।
তবু সে চেষ্টা করে ছেলেটিকে স্বাভাবিক করতে। ছেলেটির হাতের আঙুলের ভেতর নিজের আঙুলগুলো রেখে চেপে ধরে সে। কিন্তু ছেলেটি কোন সাড়া দেয় না। তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। মেয়েটির দুচোখ জলে ভরে যায়। সে মৃদু স্বরে বলে- 'এর আগে তুমি আমার নাচ আর ফ্যাশন-শোর কত প্রশংসা করছো। আর আজকে? কি এমন খারাপ কাজটা করছি আমি? ঐ ছেলের হাতও তো ধরি নাই।'
ছেলেটির কোন জবাব নেই।
মেয়েটির চোখ দিয়ে জল গড়ায়। ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে- 'খাইছো রাতে?'
'না।' - ছেলেটি বোঝে, কিন্তু তাকিয়ে দেখে না মেয়েটির দিকে।
'খাবা না?'
'কোথায়?'
'কোথায় মানে?'
'কোথায় মানে এতরাতে কোথায় খাব?' ঠান্ডা স্বর ছেলেটার।
রাত কেবল নটা বাজে। এখনও তারা বেরোলে পুরানো ঢাকার নিরব বা কাঁটাবনের অষ্টব্যঞ্জন বা হাতিরপুলের শর্মায় খেয়ে আসতে পারে। এমন সময়ে কত রাতেই তো খেয়েছে ওরা।
মেয়েটি এবার একটু কঠিন গলায় বলে, 'বল যে, তোমার আমার সাথে থাকতে অসহ্য লাগতেছে।'
'আমি তা তো বলি নাই।'
'যা করতেছ তাতে আর বলার কি বাকী রাখছো?'
ছেলেটি কোন জবাব দেয় না।
'আমি কি চলে যাব?' -মেয়েটি জানতে চায়।
'তোমার থাকতে ইচ্ছে না করলে আমি তো আর জোর করে থাকতে বলতে পারি না।'
অভিমানভরা চোখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকায় মেয়েটা। বুকের ভেতর চাপ চাপ কষ্টের তীব্রতা বাড়ে।
'তুমি এমন করতেছো কেন? আমি সরি বলতেছি। জীবনে আর কখনো কোন শো করবো না।'
ছেলেটি তবু জবাব দেয় না।
মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।
'তুমি যাচ্ছ?' ছেলেটির প্রশ্ন শুনে মেয়েটি ভাবে, হয়তো এখন ছেলেটি মত বদলাবে। বলে, 'হ্যাঁ।'
'আচ্ছা ঠিক আছে। হোস্টেলে খেয়ে নিও।' - বলে ছেলেটি সোজা হাঁটা দেয় তার হোস্টেলের দিকে। মেয়েটি পিছন থেকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। কিন্তু ছেলেটি ফিরে তাকায় না। দৃষ্টির সীমা থেকে চলে যাওয়ার পরও পথের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে মেয়েটি। আশা করে, হয়তো কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসবে।
আসে না ছেলেটি। শো শেষ হয়। সবাই একে একে বেরিয়ে আসছে অডিটরিয়াম থেকে। চোখের পানি মোছে মেয়েটি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে ঢুকে পড়ে ওর হোস্টেলের ভেতর।
................................................................................................
টুকরো - ১০, টুকরো - ৯, টুকরো - ৮, টুকরো - ৭, টুকরো - ৬, টুকরো - ৫, টুকরো - ৪, টুকরো - ৩, টুকরো - ২, টুকরো - ১