রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। ঘুম আসছে না ছেলেটির। মন মেজাজ দুটোই খারাপ। মেয়েটির সাথে ঝগড়া হয়েছে বেশ। খুবই তুচ্ছ কারণ। এক কথা, দু কথায় তুমুল ঝগড়া। তারপর মুখ কালো করে যে যার হোস্টেলে ফেরা।
ছেলেটি জানে, মেয়েটিও নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছে। ওর উপর যতটা রাগ উঠেছিল ঝগড়া করার সময়, এখন তার চেয়ে শতগুণ রাগ ছেলেটির হচ্ছে নিজের উপর। ফোন করে ‘সরি’ বলবে কিনা ভাবছে, এ সময় মেয়েটির মোবাইল থেকেই ফোন এলো। নিশ্চয়ই ‘সরি’ বলার জন্যই ফোন।
কিন্তু না - ফোনের অন্যপ্রান্তে মেয়েটির রুমমেট, একই ব্যাচে পড়ে সে-ও। রুমমেট কোন ধরণের ভূমিকার মধ্য দিয়ে গেল না - 'তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়। ও ঘুমের ওষুধ খাইছে, অনেকগুলা। ওকে ইমারজেন্সীতে নিয়ে যাচ্ছি। তুই সরাসরি ওখানেই আয়।'
মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই হাত-পা দুর্বল হয়ে ভেঙে আসতে চাইছে যেন ছেলেটির। এ কি করেছে মেয়েটি? এটুকুর জন্য..? ছোটখাট ঝগড়াঝাঁটি তো এ দুবছরে অনেকবারই হয়েছে। একদিন-দুদিন- বড়জোর এক সপ্তাহ। তারপর মিটেও গেছে। কখনো এরকম কান্ড ঘটায়নি ও। ও এরকমটি না। অনেক মেয়েই তাদের প্রিয় মানুষটির সাথে একটু মান-অভিমান বা ঝগড়া হলেই ঘুমের বড়ি খায়, ব্লেড দিয়ে হাত-পা কাটে, আরও কত কি! কিন্তু ওর তো ওরকম স্বভাব নেই। টেবিলের ড্রয়ারে থাকা হাজারখানেক টাকা বের করে টি-শার্টটা গায়ে চড়িয়ে ছেলেটি বেরিয়ে পড়ে।
জরুরী বিভাগে ছেলেটি যখন এসে পৌঁছে, দেখে, স্টমাক-ওয়াশ দেওয়া শেষে অচেতন মেয়েটিকে বের করে নিয়ে আসছে ওর দুই রুমমেট। আলুথালু বেশে, মাথা-মুখ ভেজা মেয়েটিকে দেখে ছেলেটি অসহায় বোধ করে।
তিনজনে ধরাধরি করে মেয়েটিকে নিয়ে আসে তিনতলায় স্টুডেন্টস কেবিনে। কিভাবে ঘুমের ওষুধগুলো যোগাড় করলো মেয়েটি?- রুমমেটরা জানে না। কতগুলো খেয়েছে বা কোন কোন ট্যাবলেট খেয়েছে তা-ও জানে না। রুমমেটরা পড়ছিল টেবিলে বসে। অচেতন হওয়ার প্রায় পূর্ব মুহূর্তে মেয়েটি ওদের ডাক দিয়ে বলে, ও ট্যাবলেট খেয়েছে। দুই ধরণের ঘুমের বড়ির দুটো খালি পাতা মেয়েটির বিছানার উপর পেয়েছে ওরা। প্রতি পাতায় থাকে দশটা করে ট্যাবলেট। কিন্তু আরও খেয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে খবর দিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসে ছেলেটি। ডাক্তার ওদের পরিচিত, সিনিয়র ভাই; একই মেডিক্যাল থেকে পাস করেছেন। দুজনের সম্পর্ক জানেন। মেয়েটিকে পরীক্ষা করে তিনি স্যালাইন দেয়ার অর্ডার দেন। মেয়েটি তখনো অচেতন। ওকে বসিয়ে রাখতে বলেন ডাক্তার। ও যেন শুতে না পারে। হাতের তালু-পায়ের পাতা ঘষে দিতে বলেন। তাকে জাগানোর জন্য অনবরত কথা বলে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে যান।
ছেলেটির মাথা তখন এলোমেলো। কি করবে বুঝতে পারে না। মেয়েটির রুমমেট দুজনই সবকিছু করে। মেয়েটিকে ধরে পেছনে বালিশ রেখে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসায়। ওর গা ঘেঁষে একদিকে বসে এক রুমমেট, যাতে কাত হয়ে ও পড়ে না যায়। ছেলেটিকে বলে মেয়েটির হাত-পা ডলে দিতে।
মেয়েটির পায়ে হাত দিয়ে ছেলেটি চমকে যায়- বরফের মতো ঠান্ডা। ছেলেটার ভেতরটাও যেন ঠান্ডা হয়ে আসে। মনে হয়, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। প্রাণপণে মেয়েটির পায়ের তালু ঘষে। অচেতন মুখটার দিকে চেয়ে ছেলেটির চোখে পানি চলে আসে। মেয়েটির রুমমেট তাকে ধমক দেয়।
কিছুক্ষণ পর এক রুমমেট ওয়ার্ডে খবর দিয়ে ওর হোস্টেলে চলে যায়। আরেকজন রয়ে যায়। ডাক্তার ভাইয়াটি আবার এসে দেখেন মেয়েটিকে। পালস দেখেন, ব্লাড প্রেসার মাপেন, স্টেথো দিয়ে হার্ট-লাংসের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেন। স্যালাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে - 'সকালের মধ্যে ইনশাল্লাহ জেগে যাবে, ঘাবড়িও না' - বলে চলে যান।
কিন্তু ছেলেটির মনের অস্থিরতা তাতে কমে না। রাজ্যের সব অশুভ চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। মেয়েটির কি জ্ঞান আর ফিরবে না কখনো? আর কখনোই যদি সে চোখ মেলে না তাকায়? প্রথম পরিচয়ের দু’বছর পর মেয়েটি এখন ছেলেটির অস্তিত্বের অংশ। মেয়েটিকে ছাড়া একটা দিনও সে এখন ভাবতে পারে না। আর সেখানে ওকে ছাড়া বাকী জীবন তো অকল্পনীয়!
আরো জোরে জোরে মেয়েটির হাত-পায়ের তালু ঘষে দেয় ছেলেটি। মাঝে মাঝে দু-হাত ধরে জোরে ঝাঁকি দেয়। চোখের উপরের হাড়ে জোরে চাপ দেয় যেন ব্যথা পেয়ে হলেও ওর মাঝে জীবনের স্পন্দন জেগে ওঠে। কিন্তু ছেলেটিকে অসহায় করে তুলে নিঃসাড় পড়ে থাকে মেয়েটি। মাঝে মাঝে মেয়েটির কব্জি ধরে পালসটা অনুভব করে ছেলেটি বুঝতে পারে প্রাণের স্পন্দন।
একসময় মেয়েটির গায়ে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে ওর রুমমেটটি। ছেলেটি জেগে থাকে নির্ঘুম। মেয়েটির একটিবার চোখ মেলে তাকানোর আশায়।
....অবশেষে সকাল আটটার দিকে দুচোখের পাপড়ি একটু ফাঁক করে মেয়েটি। উৎসাহে ছেলেটি তাকে ধরে আরো জোরে ঝাঁকি দেয়। চিৎকার করে ডাকে। রুমমেটও জেগে ওঠে। মেয়েটি ‘উ’ করে একটু খানি শব্দ করে। চোখটা আরেকবার মেলে। শূন্য, ভাবলেশহীন দৃষ্টি। কিন্তু ওতেই ছেলেটির সারারাতের উদ্বেগ-আশংকা-অস্থিরতা যেন ধুয়ে-মুছে যায়। অদ্ভূত এক প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। আনন্দে ঠাস করে মেয়েটির গালে একটা চড় বসায়। রুমমেট হেসে ফেলে। মেয়েটির মুখের কাছে পানির গ্লাস ধরলে ঢুলতে ঢুলতেই এক ঢোক পানিও খেয়ে ফেলে সে।
ছেলেটি কেবিন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়। গরম চা বা কফি যোগাড় করতে হবে। ডাক্তার ভাইয়াটি বলে গেছেন, জেগে উঠলে মেয়েটিকে যত বেশী সম্ভব গরম গরম চা-কফি খাওয়াতে হবে।
.......................................................................................................
টুকরো টুকরো ভালবাসা - ১০,
টুকরো টুকরো ভালবাসা - ৯,
টুকরো - ৮, টুকরো - ৭, টুকরো - ৬, টুকরো - ৫, টুকরো - ৪, টুকরো - ৩, টুকরো - ২, টুকরো - ১