টুকরো - ৮, টুকরো - ৭, টুকরো - ৬, টুকরো - ৫, টুকরো - ৪, টুকরো - ৩, টুকরো - ২, টুকরো - ১
( এটা একটা 'টেস্ট ট্রান্সমিশন'। এই লেখাটা পুরাতন। এই কাহিনীর সাথেও আমার জীবনকাহিনীর কোনই মিল নাই। লেখাটা আগেই 'মৌচাকে ঢিল' ফাল্গুনী ভালবাসা সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। আমি লিংক দেয়া শিখেছি কিনা এটা দেখলাম। একই সাথে আগের লেখা কপি পেস্ট করে ইউনিকোড কনভার্ট করে পোস্ট করলে কেমন দেখায় দেখলাম।)
স্বাতীর ফোনে ঘুম ভাঙলো -‘চত্বরে আয়।’
-‘কয়টা বাজে?’ আমি হোস্টেলে আমার রুমে। বাতি নেভানো।
-‘দুইটা।’
-‘দুইটা!! এখন তুই বের হবি কেমনে?’
-‘হবো, তুই আয়। চত্বরে এসে মিসকল দিস।’
আমরা দুজন একই ব্যাচে। পাশাপাশি রোল। প্রথম ডিসেকশন ক্লাসেই পরিচয়। খুবই ভাল ছাত্রী চট্টগ্রামের মেয়ে স্বাতী- এসএসসি-এইচএসসি দুটোতেই স্ট্যান্ড করা। আমি অতটা ভাল ছাত্র না হলেও কিভাবে যেন ভর্তি পরীক্ষাটা ভাল হয়ে গেল -চান্স পেয়ে গেলাম ঢাকা মেডিক্যালে। কিন্তু এখানে এসে পড়লাম কূলবিহীন অথৈ সাগরে। বইয়ের সবকিছুই ইংরেজীতে লেখা, তার উপর ধহঃবৎরড়ৎ-ঢ়ড়ংঃবৎরড়ৎ,সবফরধষ-ষধঃবৎধষ-অদ্ভূত অচেনা সব শব্দ। মৃতদেহের চামড়া কাটার পর এত এত নার্ভ-আর্টারী-মাসল! টিচার কি পড়াতেন তা-ই বুঝতাম না প্রথমদিকে। খুবই অসহায় লাগতো। কি জন্য যেন আমার উপর দয়া হলো স্বাতীর। ক্লাসের আগে-পরে ও আমাকে পড়া বুঝিয়ে দিত,মৃতদেহে চিনিয়ে দিত সব স্ট্রাকচার। এভাবে সময় গড়িয়ে বন্ধুত্ব। মফস্বল থেকে এসেছি,ঢাকা মেডিক্যালে এসেই প্রথম কো-এডুকেশনে। এর আগে মেয়েদের সাথে পরিচয়েরই তেমন সুযোগ ছিলনা,বন্ধুত্ব তো বহুদূর। স্বাতীর সাথে বন্ধুত্বই আমার কাছে অনেক কিছু। ধীরে ধীরে আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমি জানি,আমি ওকে ভালবাসি। কিন্তু কখনোই কিছু বলতে পারিনি। যদি ‘না’ বলে দেয়। অন্য কোন সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যেটুকু আছে তা-ও হারাতে চাইনি। তাছাড়া স্বাতীও কোথায় যেন একটা দূরত্ব বজায় রাখতো। এমনিতে সব ঠিক -আমি ওর খুব ভাল বন্ধু। ঘুরতে যাওয়া,গিফট,নোট নেয়া-দেয়া, পরীক্ষার সময় হেল্প করা সবই আন্তরিক -তারপরও কোথায় যেন একটা কিছু আছে যা মুখে না বললেও অন্যকে বুঝিয়ে দেয় সম্পর্কের সীমানা কতটুকু।
মেডিক্যাল কলেজ ভবনের সামনেই মেয়েদের হোস্টেল। ছেলেদের হোস্টেল থেকে হেঁটে তিন-চার মিনিট। হোস্টেলের সামনে মিলন চত্বরে এসে মিসকল দিলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই স্বাতী বেরুলো। চোখ মুখ ফোলা। বোঝা যায় অনেকক্ষণ কেঁদেছে। চোখের ফোলা ভাবটা ঢাকার জন্য এত রাতে কাজলও দিয়েছে- তবে তাতে ঢাকা পড়েনি। সারাদিন ওর সাথে দেখা হয়নি আজ। আমি ক্লাসেই আসিনি। তাই বুঝতে পারছি না কি ঘটেছে।
‘এখানে বসা যাবে না,ওদিকে চল। হাসপাতালে আমার এক রোগী এসেছে,ইমারজেন্সী - দারোয়ান মামাকে এ কথা বলে বেরিয়েছি।’
চত্বর থেকে বেরিয়ে রেডিওলজি বিভাগের সামনের সিঁড়িতে এসে বসলাম দুজনে। আকাশে থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষা এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে।
‘হুঁ, বল -কি সমস্যা?’
‘তোর নাকি ঊর্মির সাথে অ্যাফেয়ার হয়েছে, আমাকে জানাসনি কেন?’ আমি পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। রাত দুইটার সময় ডেকে এনে এ কেমন ধারা প্রশ্ন!
‘ঊর্মির সাথে আমার...? .. নাতো। কে বললো?’
‘ক্লাসে সবাই বলাবলি করছিলো। মেয়েরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম, জানিনাতো। ওরা খোঁচা দিল -কেমন ফ্রেন্ড তোর -এই খবরই জানায়নি তোকে?’
ছেলেরাও কিছুদিন থেকে টুকটাক খেপাচ্ছিল আমাকে। কিন্তু সেটাতো শুধু দুষ্টামির পর্যায়েই। ঘটনাটা হয়েছে ইয়ার এন্ডিং প্রোগ্রাম নিয়ে। কাল রাতে আমাদের ব্যাচের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে প্রোগ্রাম ছিল। আমরাই পারফরমার, আমরাই দর্শক। কেউ নেচেছে, কেউ গেয়েছে, কেউ কবিতা আবৃত্তি। ছিল ফ্যাশন শোও। ফ্যাশন শোতে আমি আর ঊর্মি জুটি বেধে হেঁটেছি - ‘বিড়াল-হন্টন’ আরকি। প্রথমে স্বাতীকেই বলেছিলাম করতে। ও মানা করে দিয়েছিল। ফ্যাশন শো-এর রিহার্সাল থেকেই এ রকম দুষ্টামি হয়ে আসছিল। আমি আর ঊর্মিও এ নিয়ে মজা করেছি। আমাদের জুটি বেশ হাততালিও পেয়েছে প্রোগ্রামে। কিন্তু এক রাতে এমন সিরিয়াস কিছু নিশ্চয়ই হয়ে যায়নি যে পরদিন পুরো ব্যাচই এ নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে! ক্লাসে না এলেও বিকেলে তো মিথুন-সম্পদ-জয়দের সাথে হোস্টেলে দেখা হয়েছে। ওরা তো কিছু বললো না।
‘সত্যি কথা বল -আসলে কিছু হয়েছে তোদের মধ্যে?’ স্বাতী খুবই সিরিয়াস।
আমি হালকা করতে চাইলাম ব্যাপারটা -‘হলে তো তুই-ই আগে জানতি,তাই না? তোর চেয়ে আপনজন আর কে আছে আমার?’
দুজনেই চুপচাপ বসে রইলাম কতক্ষণ। আমার দিকে না তাকিয়ে স্বাতী জিজ্ঞেস করলো- ‘তুই কি আমাকে তোর ভাল বন্ধু মনে করিস?’
‘কেন? কোন সন্দেহ?’
‘তোর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি।’
‘হ্যাঁ,মনে করি।’
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ।
‘আমি যদি বন্ধুত্বের চেয়েও বেশী কিছু চাই, তুই কি রাগ করবি?’
মনে হলো -বাজ পড়লো যেন কোথাও! ঠিক শুনছি আমি?
‘দেখ, আমি হুট করে এভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু আজ সারাদিন ধরে মনে হচ্ছিল,পরে না আবার দেরী হয়ে যায়। ততদিনে না আবার অন্য কেউ তোকে অধিকার করে নেয়। ঊর্মির কথা শুনে আমার সারাটা দিন আজ কিভাবে কেটেছে তা তুই বুঝবি না।’
হাতের পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে দিল ও আমাকে। কার্ডের উপর দুটো ভালুকছানার ছবি। একটা ছেলে ভালুক,একটা মেয়ে। ছানাদুটো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর ভালবাসা চোখে নিয়ে। ভেতরে স্বাতীর হাতের লেখা অনাদিকাল থেকে ব্যবহৃত, অনুভূতিটা প্রকাশের বিকল্পহীন সেই তিন শব্দ -‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’
আমি চেয়েই রইলাম লেখাটার দিকে -গভীর রাতে স্বপ্ন দেখছি নাতো?
-‘তুই হ্যাঁ-না কিছু বলবি না?’
বলতে চাচ্ছি, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না।
-‘তোর উত্তর যা-ই হোক, আমি তোর মতো বন্ধুও হারাতে চাইনা।’
কি বলা উচিত এখন আমার?
হঠাৎ করে বৃষ্টি আরম্ভ হলো।
-‘কি রে! তুই তো একেবারে মেয়েদের মতো লজ্জায় মরে যাচ্ছিস।’ আমার চোখের দিকে তাকালো স্বাতী।
গত এক বছর ধরে মনে মনে যা চেয়েছি, এমন আচমকা তা পেয়ে আমি বাকরুদ্ধ। জানি, আমি মুখে কিছু না বললেও ও উত্তর পেয়ে গেছে।
‘বৃষ্টিতে ভিজবি?’-স্বাতী আমার ডান হাতের উপর ওর বাঁ হাতটা রাখলো।
আমি উপর নিচে একবার মাথা ঝাঁকালাম। সিঁড়ি থেকে উঠে সামনের রাস্তায় দাঁড়ালাম। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছি,ভিজছি অচেনা অদ্ভূত এক ভাললাগায়। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না।
আমরা দুজনেই জানি, দুজনেই অন্যের কাছ থেকে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করছি।