টুকরো - ৬, টুকরো - ৫, টুকরো - ৪ , টুকরো - ৩, টুকরো - ২, টুকরো - ১
'আর দুটো দিন থাকলে হতো না?' - ছেলেটির চোখে আকুতি।
'কিভাবে বলো? বিদেশী তিনজন ছাড়া হোস্টেলে কেউ থাকবে না, ক্যান্টিনও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাসায়ও জানে ছুটি।' মেয়েটি বলে।
বোঝে ছেলেটি। কিন্তু তার খুব মন খারাপ হয়। পুরো দশ দিনের বন্ধ। অন্যান্য ক্যাম্পাসে অবশ্য এর চেয়েও বেশী দিনের ছুটি। কিন্তু দশ দিনই ছেলেটির কাছে দশ বছরের মতো মনে হয়। রিক্সা ডেকে দুজন উঠে বসে। বাস স্ট্যান্ডে যাচ্ছে দুজন। মেয়েটি বাড়ি যাবে, সাভার। ছেলেটি তাকে বাসে তুলে দিয়ে আসবে। ছেলেটিকে সেখান থেকে টিউশনীতে যেতে হবে, আজ না গেলে আবার ঈদের আগে টাকাটা পাওয়া যাবে না।
'তুমি আসতে পারবা না এর মধ্যে দু-তিনদিন?' অনর্থক প্রশ্ন, তবুও জিজ্ঞেস করে ছেলেটি।
'তোমার কি মাথা খারাপ? ঢাকায় আসবো কি কাজের কথা বলে?'
'বলবা ঈদের শপিং আছে।'
'আমার ঈদের শপিং করা শেষ, এটা আব্বু-আম্মু জানে।'
'আচ্ছা, তাহলে আমি আসি সাভার? সকালে বাসা থেকে রওনা দেব, রাতে চলে আসবো। তুমি স্মৃতিসৌধে বা জাবির সামনে আসতে পারবা না?'
'আরে নাহ! বাসা থেকে বের হবো কেমনে? কেউ দেখে ফেললে বিরাট ঝামেলা হবে।'
'আমি তোমার বাসার সামনে দাঁড়ায়ে থাকব। তুমি বারান্দায় আসতে পারবা না?'
মেয়েটি এবার হেসে ফেলে। - 'তোমার সিনেমা করা লাগবে না। মাত্র তো দশ দিন। আর ফোনে তো কথা হবেই প্রতিদিন।'
'ফোনে কথা বলা আর দেখা করা এক হইলো?' বলে মুখ ভার করে বসে থাকে ছেলেটা। মেয়েটারও মন খারাপ হয়। কিন্তু কি আর করা? ছুটির সময় এটুকু তো মেনে নিতে হবে দুজনকেই।
মতিঝিলে গিয়ে টিকিট কেটে বাসে ওঠে মেয়েটি। জানালার পাশের সীটে বসে। বাসের বাইরে জানালার ধারে দাঁড়ায় ছেলেটি। তার চোখের দিকে তাকালে যে কারও মনে হবে,তার চেয়ে অসহায় এ মুহূর্তে আর কেউ নেই। ছেলেটিকে দেখে মেয়েটিরও মুখ আঁধার হয়ে যায়। তবু প্রাণপণে গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে - ' এভাবে মুখ কালো করে বিদায় দিবা নাকি? দশ দিন ধরে তো এ চেহারাটাই মনে থাকবে আমার।'
ছেলেটি উত্তর দেয় না। মেয়েটি বলে, 'আরে তোমার তো এখন খুশী হওয়ার কথা। কোন ছেলের পাশে বসতে হয় নাই। পাশের সীট খালি পাইছি। তোমার তো দুশ্চিন্তা আরও কমলো।'
মেয়েটির দুষ্টুমি করার চেষ্টায় কোন ফল হয় না। ছেলেটির চেহারায় একই রকম বিষণ্ণতা রয়ে যায়। দেখে মনে হয়, যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে। হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটি।
মেয়েটিও মুখ ঘুরিয়ে বাসের ভেতর তাকায়। ড্রাইভার স্টার্ট দিচ্ছে গাড়ি। মেয়েটি মুখ নিচু করে কান্না গোপন করার চেষ্টা করে।
বাস চলতে শুরু করেছে এ সময় মেয়েটি টের পায়, কেউ একজন পাশে এসে বসেছে।
মাথাটা একটু তুলে বুঝতে পারে, ছেলেটি। ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকায় না। সামনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে,'চলো, আমিও সাভার ঘুরে আসি। স্মৃতিসৌধ দেখা হয় না অনেক দিন, দেখে আসি। একটু দেরী করে বাসায় গেলে তোমার সমস্যা নাই তো? আমি বিকেলের বাসে চলে আসবো।'
মেয়েটি হেসে ফেলে। ডান হাতটা বাড়িয়ে ছেলেটির হাত ধরে। ছেলেটিও শক্ত মুঠোর ভেতর ধরে মেয়েটির হাত। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকায় না। মেয়েটি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় যেন ব্যস্ত, ছেলেটির চোখ সামনের দিকে। এই মুহূর্তে কেউ কাউকে চোখের পানি দেখাতে রাজী না।