মেয়েটি রিডিং রুমে বসে আছে সেই সন্ধ্যা থেকে। ছয়টায় ছেলেটার আসার কথা। আটটা বাজতে চললো - ছেলেটার খবর নেই। মোবাইলও বন্ধ। কি ব্যাপার? খারাপ কিছুর চিন্তাই মাথায় আগে চলে আসে। বই সামনে খুলে রাখা, কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে? হোস্টেলের এক সহপাঠীর কাছে ফোন করে খোঁজ নিয়েছে, ছেলেটি রুমে নেই। কোথায় গেছে মেয়েটিকে বলে যায়নি।
মেয়েটি যখন ভাবছে, এবার সে নিজেই ছেলেদের হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ নেবে কিনা- এই সময় ছেলেটি রিডিং রুমে ঢোকে। হাতে দুটো প্যাকেট। মেয়েটির কাছে গিয়ে বলে - 'বাইরে আসো।'
'কোন প্রবলেম? এত দেরী যে? খারাপ কিছু ঘটেছে?'
'আরে নাহ।'
এবার একটু চটে গেল মেয়েটি -' তাহলে এত দেরী করলে কেন? মোবাইলও বন্ধ। আমাকে তো জানাবে যে দেরী হবে। এদিকে আমি চিন্তায় অস্থির।'
'রাগ করে না লক্ষীটি। চল ছাদে বসি।' ছেলেটির গলায় দুষ্টুমির সুর।
'হইছে, আর ঢং করা লাগবে না। হাতে কি?'
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন রিডিং রুমের পাশে কলেজের ছাদে এসে বসে। ছাদটায় কোন লাইটের ব্যবস্থা নেই। আধেক চাঁদের আলোয় পুরোপুরি অন্ধকার কাটেনি। তবু আবছা বোঝা যায় ছাদের এখানে-ওখানে জুটি বেধে বসে আছে ছেলে-মেয়েরা। একটু ফাঁকামতো জায়গা দেখে ওরাও বসে।
ছেলেটি প্যাকেট খোলে। মেয়েটি অন্ধকারে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এক প্যাকেটে কেক, উপরে কিছু একটা লেখা। আরেক প্যাকেটে গ্রীল চিকেন, পরোটাসহ - মেয়েটির খুবই প্রিয় খাবার। কিন্তু আজ কেন এনেছে ছেলেটি এগুলো? আজ তো তাদের কারোরই জন্মদিন না। এমনকি তাদের নিজস্ব কোন 'বার্ষিকী'ও না। তাদের অ্যাফেয়ারের এক বছর পূর্ণ হয়নি এখনো।
ভ্রূ কুঁচকে ছেলেটার দিকে তাকায় মেয়েটি - 'কি ব্যাপার? আজকে কি বিশেষ দিন? আজ তো পহেলা ফাল্গুন না, ভ্যালেন্টাইনস ডে না, পহেলা বৈশাখ না... তো এই আয়োজন কি জন্যে?'
ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। রঙচঙে একটা মোমবাতি বের করে কায়দা করে কেকটার উপর বসায় - 'আজ তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার তিন বছর পূর্তি। তোমার মনে নাই হয়তো, আমার হিসাব আছে।'
'আরে মোমবাতি জ্বালাচ্ছ কেন এখানে? আশেপাশে জুনিয়ররা আছে, ভাইয়া-আপুরা আছে, হাসবে সবাই।' মুখে বলে বটে মেয়েটি, তবু মনে মনে পুলকিত হয়। মেডিক্যালে ঢোকার পর প্রথম কাকে কবে দেখেছে, তা তো সে মনে রাখেনি। তখন সে আর দশটি ছেলের মতোই একজন ছিল মেয়েটির কাছে। অথচ ছেলেটি...? সে-ই প্রথম থেকেই..? অথচ তাদের পরিচয় হয়েছে ফার্ষ্ট ইয়ারের চার মাস যাওয়ার পর। আর অ্যাফেয়ার তো বছরও পেরোয়নি। অ্যাফেয়ারও যে খুব ঘটা করে, প্রপোজাল দিয়ে হয়েছে তা-ও না। একসাথে ক্লাস, ক্লাব করতে করতে কিভাবে যেন দুজনের মাঝে আলাদা বন্ধন গড়ে ওঠে। বোঝে দুজনেই। দুজনেই একদিন আলোচনা করে দুজনের এই 'বোঝা' নিয়ে। প্র্যাকটিক্যাল টাইপের আলোচনা। যেটুকু বাধা ছিল, সেটুকুও সেদিন ঘুচে যায়।
'আচ্ছা, ওদেরকেও ডাকি।' বলে মেয়েটির সম্মতির অপেক্ষা না করেই উঁচু গলায় বলে ছেলেটি - 'ছাদে যারা কেক খেতে আগ্রহী, তারা তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসেন।'
ওরা দুজনেই ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। ছাদেও তাদের আড্ডা নিয়মিতই। অন্য যারা বসে আছে আশে-পাশে, পরিষ্কারভাবে দেখা না গেলেও তারা সবাই ওদের পরিচিতই। ছেলেটির কথা শুনে দুপাশ থেকে দুজন ডাকও দেয় তাদের নাম ধরে। জুনিয়র চারটা জুটি চলেও আসে। ঘিরে দাঁড়ায় ওদেরকে - 'কি ব্যাপার ভাইয়া, কি দিবস?'
ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁত-বের-করা হাসি দেয় ছেলেটি। উত্তর না দিয়ে মোমবাতি জ্বালায়। মোমবাতির আলোয় পরিবেশটা অদ্ভূত সুন্দর মনে হয় মেয়েটির কাছে। ছেলেটি পকেট থেকে বের করে একটা আংটি। মোমবাতির আলোয় ডান হাতে উঁচু করে ধরে যাতে সবাই দেখতে পায়। তারপর বাম হাতে মেয়েটির ডান হাতটা ধরে ছেলেটি। মেয়েটি খুব লজ্জা পায়। এত ছেলেমেয়ের সামনে কি শুরু করেছে ছেলেটি? আবার ভালোও লাগে তার, খুব ভালো লাগে।
ছেলেটি আংটিটি মেয়েটির হাতের কাছে এনে চোখে চোখ রেখে বলে - 'উইল ইউ ম্যারি মি?'
খুব ভালো লাগে মেয়েটির। নিজেকে রাজকন্যা মনে হয় তার। মনে হয়, কোন রাজপুত্র হঠাৎ তার কাছে এসে বলছে কথাগুলো, স্বপ্ন দেখাচ্ছে রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার। অদ্ভূত ভাল লাগায় হঠাৎ তার দুচোখ যেন ঝাপসা হয়ে আসে। সে কিছু বলার আগেই জড়ো হয়ে থাকা আটটি ছেলে-মেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে - 'ইয়েস'।
মেয়েটির দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা জল।