রিক্সায় বসেই পিউলী ঝলমলে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। বাহারি রঙের বাতিতে ঝলমল করছে রাস্তার এক দিক। সে দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে সে। কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি সে মুহিবের বিয়েতে যাবে। যখন পিউলী জানতে পারে মুহিবের বিয়ে হচ্ছে সে মনে মনে ভেবে রেখেছিলো কোনদিন সে এই বিয়েতে যাবে না। মুহিবের কোন স্মৃতি সে ধরে রাখবে না। কিন্তু পরমুহূর্তে সে মুহিবকে ফোন করে। কথা বলতে চায়। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। আজ যখন সেজে গুজে মুহিবের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে চলে এলো তখন অবাক না হয়ে পারলো না।
মুহিবের সাথে দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিল পিউলীর। যখন তারা ছোট তখন তাঁদের বাবা মা একে অপরকে কথা দেয় যে পিউলী আর মুহিবের বিয়ে হবে। পিউলীর বাবা আর মুহিবের বাবা দুজনই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সেই সুবাদে মুহিব আর পিউলী একে অপরের বাড়িতে যাতায়াতও ছিল। যখন তারা দুজনই তাঁদের প্রথম যৌবনে পা রাখে তখন থেকেই পিউলী জানে মুহিবের সাথেই তার বিয়ে হবে। দুইজন পাঁচ বছর প্রেম করে। কিন্তু একদিন যখন পিউলী জানতে পারে, মুহিবের পরিবার এই বিয়েতে এক মত না তখন সে পাগলের মতো ছুটে যায় মুহিবের কাছে। তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু মুহিব তার পরিবারের অমতে বিয়ে করতে চায় না। যে পিউলীর একটু মন খারাপ দেখলে মুহিব পাগলের মতো হয়ে যেতো সেই মুহিব সেদিন পিউলীর চোখের পানি, হাজার কাকুতি মিনতি দেখেও না দেখার ভান করে ফিরিয়ে দেয়।
পিউলী চলে আসে। কিন্তু প্রতি মুহূর্ত তাঁর মন চাইতো এক বার হলেও মুহিব তার মুহিব ফিরে আসুক তার কাছে। কিন্তু মুহিব আসেনি। কিছুদিন পরে পিউলী জানতে পারে মুহিব অন্য একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। পিউলী কেঁদেছিল সেদিন। কিন্তু সেদিন থেকেই হয়তো পিউলী একটু একটু করে মরে যেতে শুরু করে। সবাই দেখছে পিউলী হাসে, অনেক কথা বলে। কিন্তু আসলে কেউ কি দেখেছে যে সে আসলে ভিতরে কতটা দগ্ধ?
একদিন ফেসবুকে মেসেজ গুলো খুলে পড়তে পড়তে দেখে মুহিবের মেসেজ। ছোট্ট একটা কথা লিখা
- ভালো আছ?
তিন বছর পর মুহিব যোগাযোগ করে পিউলীর সাথে। যে কষ্টগুলো এতো দিন নিজের কাছেও লুকিয়ে গেছে তার বহিঃপ্রকাশ হলো একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। উত্তর দেয় সে প্রতিটা মেসেজের। পিউলী কোথাও না কোথাও ধরে রেখেছিলো মুহিব তার। সেই মেসেজ দেওয়া নেওয়ার সময় তার সেই বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে। কিন্তু মুহিব একদিন রিতা আর তার ছবি পিউলীকে সেন্ড করে। তখনই পিউলির ভুল ভাঙে। সে আর দুর্বল হতে চায় না। কিছুতেই না।
- আসলে তোমাকে বলা হয়নি, আমিও একটা ছেলের সাথে ইনভল্ভড। আমরা খুব জলদি বিয়ে করছি।
পিউলী মেসেজ করে মুহিব কে। মুহিবের কাঁধ থেকে যেন বোঝা নেমে যায়। সে কনগ্রাচুলেট করে পিউলী কে। ছবি দেখতে চায় সে ছেলের। পিউলি খুব করে অপমান করে মুহিব কে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মুহিবও অপমান করে। দুই পক্ষের অপমানের সমাপ্তি হয় ফেসবুকের ব্লক অপশনে গিয়ে।
পিউলী হাসে মনে মনে। না আসলেই কিছু মানুষ কখনোই বদলায় না। কি হবে আর এসব ভেবে, মুহিব রিতার ছিল তারই থাকবে। হয়তো আবার সেই ভালো থাকার অভভিনয় করা, আবার সেই দেখানো যে পিউলীর থেকে স্ট্রং আর কেউ নয়।
- আফা কই যাইবেন?
রিক্সাওয়ালার কথায় সংবিৎ ফিরে পিউলীর। ঝলমলে বাড়িটা পেছনে ফেলে এসেছে।
- ভাই এইখানেই থামেন।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ফুটপাত ধরে হাটতে থাকে। মুহিবের গায়ে হলুদে আজ পার্লার থেকে সুন্দর সেজে এসেছে সে। হলুদ শাড়ি , খপায় লাল গোলাপ , হাত ভর্তি লাল-হলুদ চুড়ি , কপালে লাল টিপ। সন্ধ্যা মিলিয়ে এসেছে। মুহিবদের এই এলাকাটা একটু নিরব। সে রাস্তা ধরে হেটে হেটে যাচ্ছে মুহিবদের বাড়ির দিকে।
দরজার বেল বাজাতেই মুহিব দরজা খুলে দেয়। সে অবাক হয়ে দেখে হাতে ফুল আর এক গাল হাসি নিয়ে দরজার ওপাশে পিউলী দাড়িয়ে। বাসার সবাই ছাদে হলুদের আয়োজন করছে। মুহিব পাঞ্জাবী পরার জন্য ঘরে আসে। সেই সময় দরজায় বেলের শব্দ।
- আরে তুমি আসবে আমি ভাবতেই পারিনি।
- কেন? তোমার বিয়েতে তো আমাদের বাসার সবাই আমন্ত্রিত তাহলে আমি আসবো না কেন? এই শুধু একটু দেরি হয়ে গেল এই যা। পার্লার থেকে সেজে এলাম তো ।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই পিউলী মুহিবের প্রশ্নের উত্তর দেয়। ঘরে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে একবার।
- বাসার সবাই কথায়?
- ছাদে। আমিও যাচ্ছি। শুধু পাঞ্জাবী পরতে নিচে এসেছিলাম।
- ও আচ্ছা। আমি তাহলে ছাদেই যাই।
পিউলী হেঁটে ছাদে যেতে থাকে। মুহিব অবাক হয়ে দেখে পিউলী এতো স্বাভাবিক ভাবে কি করে কথা বলছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পিউলী বার বার মনে হচ্ছিলো এই হয়তো মুহিব ডাকবে । এই হয়তো বলবে “তুমি আমার সব। চল আমরা দূরে কোথাও চলে যাই” । পিউলী বার বার মনে মনে বলে
- মুহিব প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার। আমি আগেও যেমন তোমার ছিলাম এখনো আছি। তোমাকে কখনো বলিনি, কিন্তু আমি তোমার অপেক্ষা আজো করে।
কিন্তু এই কথা কখনো মুহিব জানতে পারেনি। মুহিব রিতাকেই বিয়ে করে। বিয়ের পর মুহিব বেশ কয়েকবার পিউলীর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবার পিউলী তাকে চরমভাবে অপমান করে। এর পর মুহিব আর পিউলীর কোন খোঁজ রাখেনি। রাখলে হয়তো বুঝতে পারতো যে পিউলী সারা জীবন শুধু মুহিবের অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছে। এবং ধীরে ধীরে সে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে। কিন্তু বাইরে থেকে কাউকে বুঝতে দেয়নি।