রাত তখন ৩ টা বেজে ২০। নতুন নতুন ঘড়ি দেখা শিখেছি। ঘুম থেকে জাগলাম শোঁ শোঁ একটা আওয়াজে। তখন আমি কতোটুকু হবো, এই ৫ কি ৬ বছর। পাশে তাকিয়ে দেখলাম আব্বা নেই। আমি একা শুয়ে আছি বিছানায়। রাতেও আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি। হঠাৎ কথায় গেলো বুঝে পেলাম না। শোঁশোঁ আওয়াজটার জন্য একটু একটু ভয় হচ্ছিলো। শব্দ টা কথা থেকে আসছে খুঁজতে থাকলাম। বেশীক্ষণ খুঁজতে হোলনা। দেখি বাক্সের উপর টিভি থেকে সেই শব্দ আসছে। টিভি চলছে কিন্তু কোন দৃশ্য নেই। অতো রাতে থাকারও কথা না। সে সময় বিটিভি র সম্প্রচার রাত ১১টার মাঝে বন্ধ হয়ে যেত। আমার ভয় করতে শুরু করলো। টিভি চলছে মানে আজকে আব্বা আর ফিরবে না। আমি বিছানা থেকে নামলাম। নেমে দরজার কাছে গিয়ে খুলতে চেষ্টা করলাম। না দরজা বাহির থেকে শিকল টানা আমি ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে দিলাম। এক সময় ভাইয়ারা আমাকে সেই ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেলো তাঁদের ঘরে। আমি তখনো কাঁদছি একটু একটু।
বাইরে মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমাদের মাটির বাড়ির বারান্দার খোঁড়ের চালের একটা অংশ বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। আমরা তিন ভাই বোন একটা অন্ধকার ঘরে লণ্ঠন ধরিয়ে বসে গল্প করছি। কারণ কেন জানি আমাদের তিনজনেরই ঘুম আসছিল না। এক অশুভ কিছুর অপেক্ষায় আমরা তখন। আম্মা নেই তিন মাস হয়ে গেছে। আব্বার সাথে রাগা রাগি করে খালার বাসায় । আব্বাও কথায় কে জানে। আমরা খুব অসহায়ের মতো বসে আছি। আমি আর ছোট ভাইয়া একটু একটু ভয় পাচ্ছি দেখে বড় ভাইয়া আমাদের এই ভয় দূর করার জন্য একটা বুদ্ধি বের করলো। আমার এক নানীর গাছ থেকে লিচু চুরি করবে। আর নোনা খালের ওপাড়ের বাগান থেকে আম চুরি করা হবে।
যে কথা সেই কাজ। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো ছোট ভাইয়া আর পাড়ার এক ছেলে মাথায় গামছা দিয়ে সেই ভরা বৃষ্টিতে আম আর লিচু চুরি করে নিয়ে এলো। আমরা চারজন তখন সেই আম আর লিচু ভাগাভাগি করে খেলাম।
একটা উত্তেজনার মাঝে থাকলে মনে হয় ঘুম হয় বেশি। অন্যদের কথা জানি না। কিন্তু আমি তাঁর কিছুক্ষনের মাঝে ঘুমিয়ে পরলাম। যখন ঘুম থেকে জাগি তখনো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আব্বা তখনো ফিরেনি। আমরা তার পর তিনদিন আব্বার অপেক্ষা করলাম। কোন খোঁজ নেই। তৃতীয় দিন বড়ভাইয়া খবর আনল আব্বা বিয়ে করেছে এবং সেখানেই আছে।
আমরা আম্মা ফিরে আসার জন্য যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম তা এক নিমিশেই যেন উবে গেলো। আমরা তিন ভাইবোন আবার সেই লণ্ঠনের পাশে বসে রইলাম খানিক। পরে হঠাৎ বড়ভাইয়া আমাকে বলল আমি যেন আব্বার কাছে গিয়ে বলি আমাদের কাছে এসে থাকতে। আমাকে বলতে বলার কারণ হোল এক আমি সবার ছোট তাঁর উপর এক মাত্র মেয়ে।
আব্বা এলো বাসায়। চতুর্থ দিন সন্ধায়। আমি পা টিপে টিপে আব্বার কাছে গেলাম। গিয়ে আব্বার পাশে বসে বললাম “আব্বা তুমি আর একটা বিয়ে করো না। আমরা আম্মা কে নিয়ে আসবো আর সব্বাই এক সাথে থাকব।”
এতোটুকু বলতেই কেমন জানি খুব কান্না পাচ্ছিলো। কিন্তু কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো না। আব্বা সেদিন আমার কথা শুনেনি। আগেই বিয়ে করেছিল। আব্বার চোখে সে দিন প্রথম এবং সে দিন ই শেষ আমাদের জন্য অশ্রু ছিল। কিন্তু তাঁর পরের দিন থেকে আব্বা আমাদের ফেলে চলে যায় সেখানে যেখানে তাঁর দ্বিতীয় বউ ছিল।
আমরা তিন ভাইবোন আবার একা একা থাকি বাসায়। কি খাই না খাই, কি করি কেউ খোঁজ নেয়েনি। অবশ্য তখন নিজেকে স্বাধীন মনে হতো। শুধু যখন ছেড়া স্যান্ডেলের ফিতা তাঁর দিয়ে বাঁধতে হতো, দুই বেলা মুড়ি খেয়ে পেট ভরতে হতো তখন খুব খারাপ লাগতো। যখন সেই বয়সে আমি ভাইদের জন্য রান্না করতাম আর ভাইয়ারা পড়াশুনা প্রায় বাদ দিয়ে উপার্জন এর পথ খুঁজতে শুরু করলো তখনো কষ্ট হতো।
এখন সব অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আর কিছুই কষ্ট দেয় না। ভাইয়ারা তাঁদের সংসার নিয়ে বেস্ত। আমি আমার পরাশুনা, এম্বিশন নিয়ে। আমরা এখন আম্মার সাথে থাকি। আব্বা আছে আব্বার মতো। আমরা মাঝে মাঝে কথা বলি। কিন্তু খুব দূরের একজনের মতো হয় কথা। আমি গত তিন-চার বছর হয়ে গেলো আব্বার সাথে দেখা করিনি। ইচ্ছাও করে না। জানি না কেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:২০