অসম্ভব ভ্যাঁপসা একটা দিন। গুমোট হয়ে আছে চারিদিক। কথাও একটুও বাতাস নেই। গাছের পাতা গুলো যেন থম মেরে কোন কিছুর জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সারাদিন প্রচণ্ড রোদ থাকলেও বিকেলে আকাশে পোঁজ পোঁজ মেঘ জমতে শুরু করেছে। বিকেলে গুমোট ভাবটা যেন আরও বেড়ে গেল। প্রচণ্ড গরমে সকলে ধুঁকছে, ঘামছে, হাঁসফাঁস করছে। ঢাকা শহরের রাস্তার পীচ গোলে গোলে পথচারীর স্যান্ডেলে আটকে যাচ্ছে। এতো গরমে অফিস ফেরত মানুষেরা যেন পরিশ্রান্ত। বাসে উঠে দর দর করে ঘামছে। ছেলেরা রুমাল বের করে কপাল থেকে ঘাম মুছছে। মেয়েরা ওড়না দিয়ে ঘার কপাল থেকে ঘাম মুছে জানালার আরও একটু কাছে এগিয়ে যেতে চাইছে। বাসে ওঠাটাও কম ঝক্কির না। দৌরে উঠতে হচ্ছে। সীটের জন্য ঝগড়া করতে হচ্ছে। এ রোজকার ঝক্কি।
অয়ন আর নিবেদিতা রোজকার মতো বাংলামটর থেকে বাসে উঠল। অয়ন আর নিবেদিতা একটা জাপানী কোম্পানিতে এক সাথেই চাকরি করে। অয়ন দেখতে বেশ। লম্বা প্রায় ছ-ফুট মতো। গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল, চৌকো মুখ, তার সাথে মানানসই পুরুষালী ভারিক্কি গলার স্বর। নিবেদিতা হাল্কা পাতলা লম্বাটে, গায়ের রঙ চাপা হলেও দেখতে ভারি মাধুর্য আছে। নিবেদিতা খোলা মনের মেয়ে। তাঁর মাঝে গোঁড়ামি নেই। বরং অয়ন একটু চাপা স্বভাবের। অয়ন আর নিবেদিতার মাঝে একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নিবেদিতার অয়নের জন্য কখনো বন্ধুত্বের বাইরে কোন সম্পর্কের কথা মাথায় আসে ।
অয়ন আর নিবেদিতা আর সকলের মতো গরমে ঘামছে। বাংলামটর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত বাসটা পৌছতে প্রায় ১ ঘণ্টা লাগালো। বাসটাও যেন ধুঁকে ধুঁকে এগোচ্ছে। নিবেদিতা ফার্মগেটে এসে একটা সীট পেয়ে হুড়মুড় করে বসে পরল। পাছে অন্য কেউ সীটটায় ভাগ বসায়। এ নিত্য দিনের চিত্র। তার পরেও অয়ন হাসি চপতে পারলো না। সীটে বসা নিয়ে নিবেদিতা একটু বাড়াবাড়িই করে। নিদিতার সব কিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি। তাদের সেকশনের সব ইমপ্লইর কাজের থেকে নিবেদিতার কাজ বেশি পারফেক্ট হয় অবশ্য তাঁর এই বাড়াবাড়ি রকম সিরিয়াসনেসের জন্যই।
অয়ন যখনই নিবেদিতার দিকে তাকায় এক অসম্ভব মমতা আর বুক কাঁপানো শিহরণ অনুভব করে। কিন্তু কখনো বলে এটা প্রকাশ করতে পারে না। এই যেমন এখন নিবেদিতার কপালের বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা ঘামটা আর চোখের নিচে লেপটে থাকা কাজলটার জন্য নিবেদিতাকে অসম্ভব এক রূপবতী মনে হচ্ছে। জানালার পাশে উদাস ভাবে তাকিয়ে কি ভাবছে নিবেদিতা সেটাও জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু নিবেদিতার কাছে যাওয়ার সাহস অয়নের নেই। রোজ অয়ন নিবেদিতাকে তার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসে। কিন্তু কখনো খুব কাছে যায়না।
নিবেদিতার পাশে বসে থাকা যাত্রী নেমে গেলে অয়ন নিবেদিতার পাশে বসে। না নিবেদিতা একবারের জন্যেও অয়নের দিকে ফিরে না। তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। বাইরের জগৎটার মাঝে নিবেদিতা কি খুঁজে এখনো অয়ন ববুঝে উঠতে পারে না। তিন বছর অনেক সময় কাউকে চিনার জন্য, কিন্তু নিবেদিতা এখনো রহস্য। কখনো নিজের সম্পর্কে কিছু বলে না। সকল সমস্যা হেসে সমাধান করে ফেলার এক জাদুকরী ক্ষমতা আছে তাঁর। এজন্যই হয়তো অয়ন তাঁকে এতো পছন্দ করে।
- কি ম্যাডাম, কি ভাবছেন?
হঠাৎ নিবেদিতাকে চমকে দেয়ার জন্য তার খুব কাছে গিয়ে একটু জড়েই বলে অয়ন।
- আরে না, কিছু না। বাইরে মানুষেরা কি করে গরমের মকাবেলা করছে সেটাই দেখছি।
ঝকঝকে হেসে উত্তর দেয় নিবেদিতা। কিন্তু তার মাঝেও কোথাও যেন একটা কিন্তু আছে। অয়ন বুঝেও না বুঝার ভান করে।
- তাহলে এবার প্রমশন তোমার ঘরেই যাচ্ছে, কি বোলো?
- আরে না। আমার থেকেও অনেক দিসারভিং আছে। এই দেখো না, তুমিই কিন্তু আমার থেকে অনেক বেশি দিসারভিং। কতো হার্ড ওয়ার্ক করো।
- আরে না, পাগল! তুমি আমার থেকে বেশি টাইম আর ইফরড দেও। আর বস তোমার পারফমেন্সে খুব খুশি।
অয়ন স্বরযন্ত্রীর মতো মুখ করে বলে। নিবেদিতা ফিক করে হেসে দেয়। নিজের প্রশংসা সবাই শুনতে চায়। কিন্তু অয়নের মতো করে কেউ যদি বলে না হেসে আর কিছু করার থাকে না।
- কি তুমি হাসছ যে বড় ?
অয়ন আহত ভাবে নিবেদিতাকে প্রশ্ন করে।
- আরে তুমি যেভাবে বলছ যেন বস আমার পারফর্মেন্স না আমার প্রেমে পরেছে।
নিবেদিতা হাসতে থাকে।
- আমি কখনই সেভাবে বলিনি নিবেদিতা। কিন্তু যখন তুমি মনে করিয়েই দিলে তখন বলাই যায় বস তোমার প্রেমে পরলেও পরতে পারে।
অয়ন চোখ টিপে হাসতে থাকে। এরকম কথা বললে নিবেদিতা একটু চটে যায়। কিন্তু অয়নকে অবাক করে দিয়ে নিবেদিতা হেসে ওঠে।
ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি শুরু হোল। বৃষ্টিটা যেন নিবেদিতার হাসির জন্যই অপেক্ষা করছিল। এতো বৃষ্টি যে নিবেদিতা মুহূর্তে জানালার পাশে বসে ভিজে চুপসে গেলো। বাইরের মানুষগুলো ছোটাছুটি করে একটা আশ্রয় খুঁজছে। কিন্তু অয়ন নিবেদিতাকে দেখছে। কি শুভ্র, কি মায়াময়, কি অদ্ভুত! সকল স্নিগ্ধতা এখন নিবেদিতার এই শ্যামল মুখটায়।
- কি দেখছ ? হুম?
নিবেদিতার ঝটিকা প্রশ্ন। অয়ন একটুক্ষণের জন্য থমকে যায়। নিবেদিতা কি অয়নের মনের কথা বুঝতে পেরেছে? অয়নের বুক ধক করে ওঠে মুহূর্তের জন্য। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়।
- দেখছি , মানুষ কতো বোকা হলে এভাবে ভিজতে থাকে।
অয়নের ঝটপট উত্তর।
- কেন? দেখছ না জানালা গলে বৃষ্টির ছাঁট এসে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে?
- দেখছি। জানালাটা আটকে দিলে আর ভিজতে হতো না।
- অহ হ্যাঁ! তাই তো!
বাসের জানালাটা টেনে আটকে দিতে দিতে দুজনেই হাসতে থাকে। কি স্নিগ্ধ এক দৃশ্য। দুজনের সম্পর্কের মাঝে একটা স্বচ্ছ সরলতা। একটা সরল বন্ধুত্ব।