[ গল্পের সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক এবং নিছক মজা করার উদ্দেশ্যে! ]
“কাল ছবির হাটে, ৪ টায়!”
মেসেজটা দেখে শান্তি পেলাম আমি। অবশেষে দেখা হচ্ছে আমাদের, অবশেষে। ছয় মাসের পরিচয়, ছয় মাস শুধু ছয়টা মাস নয়, ছয় মাসের প্রতিটা বিনিদ্র রাত কেটেছে অসংখ্য শব্দের ছোঁড়াছুঁড়িতে। জমেছে প্রায় ৫০,০০০ ক্ষুদেবার্তা মুখবইয়ের এই নীল সাদা জগতে। এই শব্দগুলো শুধু শব্দ নয়, এক একটা হৃদয়ের কণা ঝরে পড়েছে কিবোর্ড থেকে পিসির স্ক্রিণে।
হ্যা, লাবণ্যর সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে। ওর ব্যাপার জানি না, আমি ওর প্রেমে পড়েছি তখনই, যখনো আমার সাথে ওর কোন কথাই হয়নি। লাবণ্য জনপ্রিয় অনলাইন লেখিকা। ব্লগ-ফেবু দুজায়গাতেই তুমুল জনপ্রিয়। লাবণ্য ব্লগে পোস্ট দিলে কমেন্টের পর কমেন্ট পড়তে থাকে, প্লাসের জোয়ারে ভেসে যায়, ফেবুতে শেয়ারের পর শেয়ার। হবে নাই বা কেন বলুন, লাবণ্য সত্যিই অসাধারণ লিখে। থ্রিলার আর আবেগ মিশে একাকার করে দেয় পাঠকের অনুভূতিকে। যখন রম্য লিখে, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার যোগাড় হয়। সব জনরাতেই লাবণ্য সফল, অসম্ভবরকমের সফল।
তবে আমি ওর প্রথম যে লেখাটা পড়েছিলাম, সেটা ছিল রোমান্টিক ধাচের। পড়ার পর আমি যেন কোন এক ঘোরে আটকে গিয়েছিলাম। গল্পের মূল চরিত্রের নাম ওর নিজের নামেই, লাবণ্যপ্রভা। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল ‘শেষের কবিতা’ থেকে যেন তুলে আনা হয়েছে লাবণ্যকে। নিজেকে আমার আর রণিত ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, শেষের কবিতার অমিত রায় হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
তারপর শুধু অপেক্ষা আর সপ্ন দেখা। অনেক চেষ্টা, ছল-চাতুরীর পর ঢুকে গেলাম লাবণ্যর ফেবু ফ্রেন্ড লিস্টে। তারপর চ্যাটের কথা দীর্ঘ হতে থাকলো ‘রাজকন্যা ওড়না’ আর ‘লাবণ্য প্রভা’র মাঝে।
চমকে উঠবেন না। হ্যা, আমার ফেবু প্রোফাইল নেম ‘রাজকন্যা ওড়না’ ! এটা আমার অরজিনাল নাম না, লাবণ্য জানে ব্যাপারটা। লাবণ্য জানে আমার নাম ‘অরণি’ !!
কী ? আবারো চমকে উঠলেন তো! আসলে আমার নাম রনিত, রনিত হাসান। একবারে পিতৃপ্রদত্ত নাম, একটা কুড়ি হাজারের গরু জবেহ করে আকিকা দিয়ে আমার বাবা এ নাম রেখেছিলেন। ‘রনিত হাসান’ নামে আমার একটা ফেবু আইডিও ছিল। গল্পটা পড়ার পর সেই আইডি থেকেই প্রথমে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম লাবণ্যকে, সাথে বিশাল একটা মেসেজ। লাবণ্য কখনো মেসেজটা দেখেনি, এখনো না। হয়তো আদার্স বক্সে পড়ে আছে মেসেজটা।
তারপর আর কোন উপায় না দেখে একটা ফেইক আইডি খুললাম, রাজকন্যা ওড়না নামে। ছেলেদের রিকোয়েস্ট ইগনোর করতেই পারে একটা মেয়ে, প্রাইভেসির ব্যাপার আছে তার। একটা মেয়ের রিকোয়েস্ট আ্যাকসেপ্ট করা সেদিক থেকে অনেক রিস্কলেস, সেইফ। করেছিল ও লাবণ্য আ্যাকসেপ্ট। প্রথমে অবশ্য সন্দেহ করেছিল, ‘ওড়না আবার কেমন নাম? ’ পরে বুদ্ধি করে বলেছিলাম, ‘অরণিকে দুষ্টমি করে ওড়না করেছি‘ ’
মেনে নিয়েছিল লাবণ্য। ওকে এখনো বলা হয়নি, আমি একটা ছেলে, আমার নাম রনিত। ও এখনো আমাকে অরনি বলেই চেনে। লাবণ্য একবার প্রোআইল পিক দেই না কেন জিজ্ঞেস করেছিল, প্রাইভেসির দোহাই দিয়ে বেঁচে গেছি। লাবণ্যর ছবিও আমি দেখিনি। ওরও প্রোফাইল পিক দেয়া নেই, না থাকাই স্বাভাবিক।
সেলিব্রেটিদের শত্রুর অভাব নেই। কে কখন কী করে ফেলে, বুঝি আমি।
কাল লাবণ্যর সাথে দেখা করবো। জানি না, লাবণ্যর কী প্রতিক্রিয়া হবে সত্যিটা জানতে পেরে। হয়তো ঘৃণায় থু থু ছেটাবে আমার মুখে। হয়তো ছবির হাটে এক গাদা মানুষের সামনে অপমানিত হতেই যাচ্ছি কাল। তবু যেতেই হবে আমায়, যে মিথ্যার বীজ বপন করেছি আমি, তা এখন এক শক্ত-পোক্ত চারাগাছ হয়ে গেছে, মহীরুহ হয়ে উঠবার আগেই করাত ধরতে হবে। সেই করাতে কেঁটে ফেলতে হবে আমার আর লাবণ্যর মাঝে গড়ে ওঠা মিথ্যের দেয়াল। হতে পারে, সেই করাত গিয়ে চড়তে পারে আমার দেখা সপ্নের গলায়, এক নিমিষে ধূলিস্বাত করে দিতে পারে আমার ভালোবাসার ভবিষ্যতকে। যে কারো কাছে মনে হতেই পারে আমি কাজটা ঠিক করিনি, প্রতারণা দিয়ে কোন সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হয় কী করে ? কিন্তু আর কী ই বা করার ছিল আমার এছাড়া ? ‘আমি নিজ হাতে বিষ করেছি পান! ’
সব মিথ্যে হতে পারে যা বলেছি, যা করেছি হয়তো পৃথিবীর ঘৃণ্যতম কাজ, তবু বিশ্বাস করুন, আমার ভালোবাসাটুকুতে কোন মিথ্যে নেই, নিরেট সত্য, নিখাদ খাটি!
আমি ঘুমোতে পারছিলাম না কালকের চিন্তায়। উঠে পড়লাম। বসলাম গিয়ে আবার পিসির সামনে। ফেবু অপেন করেই দেখলাম লাবণ্যর একটা মেসেজ এসেছে। ও না অফলাইন হয়ে গেল, আবার মেসেজ পাঠালো কখন ? ওরে বাবা, এ যে বিশাল মেসেজ,
“অরণি, তুমি এখন ঘুমাচ্ছ, আমি জানি, তোমার পাশে তোমার কিউট বার্বি ডলটাকে নিয়ে। তবু তোমায় লিখছি, লিখতেই হচ্ছে।
তোমায় আমি কত গল্প বলেছি। গল্পের ভাবনা মাথায় এলেই তোমার সাথে শেয়ার করেছি। আজ তোমাকে একটা ছেলের গল্প শোনাবো। এই গল্প আর কখনো লেখা হবে না, কখনো পাবলিশ হবে না।
ছেলেটা খুব আপন আমার। ওর কষ্টগুলো তুমি কতটা বুঝবে জানি না, আমি বুঝি। কষ্টগুলো আমাকে অনুভব করতে হয়েছে। ছেলেটা গল্প লিখতো। খারাপ লিখতো না, আমার মতই বেশ ভালো লিখতো। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কেউ পড়তো না ওর গল্প। আমি ছাইপাশ নয় লাইনের একটা স্ট্যাটাস লিখলেই তাতে ১৫০০ লাইক এমনিতেই পড়ে যায়। আর ওর ১৫ ঘন্টা ধরে লেখা নয় পর্বের চমত্কার গল্পে লাইক পড়তো মোটে ৯টা, ১৫টা। ছেলেটার কোন ব্যাক ছিল না, না কোন পেইজ, না কোন সেলিব্রেটি বড়ভাই। এত খাটাখাটনি করে লেখা গল্প কেউ পড়তো না। ছেলেটা ভালোবাসার গল্প লিখতো না, সত্যিকারের গল্প সাধারণ-সস্তা পাঠকের কাছেও গ্রহনযোগ্য ছিল না। ছেলেটা হতাশ হয়ে পড়লো ক্রমেই। আরো হতাশা ঘিরে ধরতো কোন মেয়ের “বন্দুরা আমার মন খারাপ, আম্মু বকেছে, তুমাদের কী খবর ?” লিখে স্ট্যাটাস দিলেও সেখানে অসংখ্য লাইক আর তৈলাক্ত কমেন্টে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া ওয়াল দেখে।
ছেলেটা শেষে একটা ফেইক আইডি সাইন আপ করলো। ফিমেইল আইডি। সেলিব্রেটি বড়ভাইরা ঠিক এগিয়ে এলো, ছোটভাইদের প্রমোট করার চেয়ে ছোটবোনদের প্রমোট করায় অনেক বেশি আত্মিক শান্তি পাওয়া যায় বোধহয়। ছেলেটার ফেইক আইডি জনপ্রিয় হয়ে গেল কয়েক সপ্তাহেই। যে গল্প আগে লিখে মাত্র ১৫ লাইকে সন্তুষ্ট থাকতে হতো, সেই গল্পে এখন তিন-চার হাজার লাইক অনায়েসে পড়ে। তাহলে কত মানুষ তার গল্প পড়ে, ভাবো একবার ?
সেই ফেইক আইডি দিয়েই ছেলেটা একটা মেয়ের সাথে কথা বলে। মেয়েটা হয়তো ভালো বন্ধু কিংবা বড়বোন ভেবেই কথা বলে। কিন্তু ছেলেটা কথা বলতে বলতেই প্রেমে পড়ে যায় মেয়েটার। সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলে তাকে। ছেলেটার খুব ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে দেখবার। কিন্তু কি ভাববে মেয়েটা, যখন সত্য জানবে, ছেলেটা ফেইক আইডির প্রতারণা করেছে মেয়েটার সাথে।
আচ্ছা অরণি, তুমি কী ছেলেটাকে চিনতে পারছো ? বুঝতে পারছো তার অনুভূতিগুলোকে ? তার ভালোবাসা কী তার অন্যায়, প্রতারণার অপরাধকে ঢেকে দিতে পারে না ?
তুমি হয়তো এরপর আমার মুখোশ খুলে দেবে, সবাইকে জানিয়ে দেবে আমি একটা ফ্রড, প্রতারক, ফেইক, ছাইয়া, মাল্টি। অনলাইনে আমার জনপ্রিয়তা খসে যাবে হয়তো কালই।
কিচ্ছু এসে যায় না, বিশ্বাস কর, কিচ্ছু এসে যায় না আমার তাতে। অবশ্য আমি কোন মুখে তোমায় আবার বিশ্বাস করতে বলি, আমি তো প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক!
তবু যদি পারো বিশ্বাস কর আরেকবার, তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি আমি। সব ভুলে যদি পারো, তবে এসো কাল বিকেলে, হাতটা ধরো আমার, পৃথিবীটা বদলে দেবো।
।
উত্সর্গঃ প্রিয় গল্প লেখক ব্লগার লেজকাটা বান্দর, টুইস্ট মাস্টার সালেহ তিয়াস ভাই অথবা সাময়িক রাজকন্যা ওড়না আপা!!
অনুমতি না নিয়েই লেখা এবং উত্সর্গ করে ফেলার জন্য স্যরি ভাইয়া।