প্রথমেই আপনাকে একটা প্রশ্ন করি? আপনি বাংলাদেশের এমন একটা জায়গার নাম বলেন, যেখানে সাত রাস্তা এক হয়েছে? কিংবা শুধুমাত্র একটা মোড়কে ঘিরেই পুরো শহর ঘুরপাক খেতে থাকে। সম্ভবত আপনি পাবেন না। সাতমাথা তার শতরু্প নিয়ে সবসময়ই অন্যকোন মোড় থেকে স্বাতন্ত্র্য।
সকালের সাতমাথা এক যেন ব্যস্ত শহরের প্রতিচ্ছবি, এক পাশ দিয়ে বি আর টি সি বাসের হাকডাক, আর অন্য পাশে বগুড়া ঢাকা খুলনা। আবার স্কুল ছাত্র ছাত্রীদের সাথে রিকশাওয়ালার মান অভিমান। তবে সকালের মহাযজ্ঞ চলে ফলের দোকান গুলিতে। সারাদেশ থেকে আসা ফলমুল নিয়ে বিশাল এক হাট বসে তখন হকার্স মার্কেট থেকে বি আর টি সি মার্কেট পর্যন্ত। বিশেষ করে লিচ্র, আম এর সময়ে। লিচুর দিনগুলি থাকে কম-কিন্তু সেই দিনগুলিতে যেন রাস্তার পাশে লিচুর পাতায়, আর ফলে যেন আস্ত বাগান বসে যায়।
তবে সাতমাথার ব্যস্ততা, লোকসমাগম এর পুর্ন প্রতিচ্ছবি আপনি পাবেন-বিকেল বেলায়। সাতমাথার মুল বিল্ডিং হল সপ্তপদী মার্কে্ট। তার সামনে বিকেল বেলা বসে ছোলার নানা রকম মিশাল এর দোকান। ডান দিকে কয়েকটা ফলের দোকান ও আছে, তবে সন্ধ্যা বাড়লে ফলের দোকান ও বাড়ে। তবে সেখান থেকে আমার মতে না কেনাই ভালো। আলো আধারে ফল ভালো পাওয়া যায় না। বামের দিকে এক শন পাপড়ী বিক্রেতা বিগত ৮ বছর ধরে বসছেন। কথা হয়েছিল এক ছোলা বিক্রেতার সাথে-শ্যমলা এই মামা তার পিতাকেও এখানে ব্যবসা করতে দেখেছেন। তবে ব্যস্ততার খাতিরে, আর হাতে কোন সাংবাদিক মার্কা ক্যামেরা না থাকায়, তার সাথে বেশি কথা বলা যায় নি, উনিই দাম দেন নি আর কি।
রাস্তা পার হলে তিন সারির দোকান পড়বে চোখে। প্রথম ধাপ পেপার পত্রিকার দোকান। বলা যায় রীতিমত রাস্তার উপর তাদের দোকান। তাদের সামনের সারি ডিম সেদ্ধ ওয়ালাদের। তার সামনের সারি রিকশাওয়ালাদের। একটু সামনে এগোন। তবে মোড়েই থাকুন। এবার বামে কতগুলো পার্টি অফিস চোখে পড়বে আপনাদের। বিশেষ করে জাসদ অফিস। এই অফিসের সামনে সবসময় অনেক লোকের ভিড় দেখে ভিমড়ি খাবার কিছু নেই। এরা কেউ জাসদ করেনা-করে কেউ কেউ। তবে এরা সবাই চা খেতে ভালোবাসে। এখানের চায়ের দোকানের ভক্ত অনেক। লেবু চা, মরিচ চা, মাল্টা চা, নরমাল চা এর ভিড়ে আপনি এখানে দুধ চাই পাবেন না। তারপরের সারি হল ভাপা বিক্রেতাদের, লেয়ার লেয়ারে ভাপা বানাতে এর বিশেষভাবে পটু। সাথে পাবেন, ভুটির চাপ, লটপটি, হাড্ডির হালিম ইত্যাদি।
তারপরের সারি-মুড়ি মামাদের। একেকজনের একেক রকমের মুড়ি মাখানো ভালো না লেগে পারেনা। আর তারপরের সারি অপেক্ষারত প্রেমিকদের। বগুড়া জিলা স্কুলের প্রেমিক পুরুষদের প্রায়শই এখানে কাকুতি মিনতি করতে দেখা যায়। সুবিধাবশত পাশেই পাবেন ফুলের একরাশ দোকান-তবে সেটা সাতমাথায় না।
তারপরে সাতমাথার ডানকোনায় পাবেন-শিক কাবাব, আর একটু এগিয়ে চটপটির দোকান। সাতমাথার সাতকোনা। তাই আরো দুই কোনা বাদ আছে। একদিকে পাবেন-আপনার স্বপ্নের সব রঙের মত সব সাইকেল। বাইসাইকেল খুজতে আপনাকে এখানে আসতেই হবে। আর আরেক কোনে দইয়ের দোকান। কোন দই ভালো আর কোনটা খারাপ সেই বিতর্কে না গেয়ে বরং এটা বলে সাবধান করে দেই- যে স্পেশাল নামে যে এখন দইয়ের দাম বাড়ানোর নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে-সেই স্পেশাল দইয়ের সাথে নরমাল দইয়ের স্পেশালিটি আমি কয়েকটি দোকানে খুজে পাইনি-দামের ক্ষেত্রটা ছাড়া।
এই সাতমাথার বিকেলে আপনি এককোনে বসেই পুরো জীবনের প্রতিচ্ছবি খুজে পাবেন। একপ্রান্তে হয়তো মা ছেলেকে বকা দিচ্ছে, আরেক প্রান্তে প্রেমিকা প্রেমিকার অভিমান ভাংছে, আরেক প্রান্তে হয়তো বাবার হাত ধরে ছেলে ডিম খাচ্ছে।
অনেকে বলেন সাতমাথায় নাকি সাতটা রাস্তা নেই। অনেকে পান ৬ টা, কেউ আবার ৮ টা। সবার মাথার ভুত তাড়াতে সেখানে ৭ বীরশ্রেষ্ঠের মুর্তি বসিয়ে নামকে সার্থক করে দেয়া হয়েছে। নেও বাবা নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাও-তাও সাতমাথা নিয়ে ঝগড়া ঝাটি করো না।
রাতে সাতমাথার আরেক রঙ্গিলা রুপ। সব দোকানকে হটিয়ে দিয়ে একপাশ দখল করে- দুরগামী বাসগুলো, আরে বাকি সব টঙ্গের চায়ের দোকান। সেই দোকান গুলোর লাল চা বেশ ভালোই লেগেছে আমার। বিশেষ করে শীতের রাত্রে-রাত ১,২ টায় চা খেতে এককথায় অপুর্ব লেগেছে আমার। সাথে পাবেন কেক, ডিম নানা কিছু।
বলতে পারেন এত ভনিতার কী দরকার ছিল। ৬ বছর তো থাকলাম বগুড়ায়। সাতমাথায় আসলে বগুড়াকে যে ধরনের হাতের মুঠোয় মনে হয়, অন্য কোথাও আমার তা মনে হয়নি। মিটিং বলেন সমাবেশ বলেন এই সাতমাথাতে আপনাকে আসতেই হবে। প্রেমিকাকে নিয়ে চুপি চুপি বেড়ুবেন, আপনার গোয়েন্দা বন্ধুরা আপনাকে সাতমাথাতেই পাকড়াও করবে। মাঝরাস্তায় বড় টিভি দেখতে গিয়ে থমকে পড়তে পারেন, আবার বাংলাদেশের খেলা দেখে সারা রাস্তা জুড়ে আনন্দ করতে পারেন। তো, সেই কথাই থাকলো। সাতমাথা বেচে থাকুক।