বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তাপ ছড়ানোর প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাশাপাশি রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিতের কথাও কেউ কেউ বলছেন। সম্প্রতি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অতি দ্রুততার সাথে জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে শুধুমাত্র বিরোধীদল-এর মতামত উপেক্ষিত-গ্রহণ করা হয়নি এমন নয়; এ লক্ষ্যে গঠিত কমিটিতে যারা সদলবলে-আনুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ সহকারে মতামত প্রদান করেছিলেন- তাদের পরামর্শও গৃহীত হয়নি। এই সংশোধনী দ্বারা সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আইন সন্নিবেশন করেছেন। যা নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকার বহাল রাখা হলেও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা সম্বলিত ধারাটি বাদ দেয়া হয়েছে। সন্নিবেশিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। সবমিলিয়ে সংবিধান সংশোধনের নামে একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এই গুরুত্বপূর্ণ দলিল-সংবিধানের।
ধর্মকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের চূড়ান্ত পারঙ্গমতা বর্তমান সংবিধান সংশোধন। একদিকে কোর্টের দোহাই দিয়ে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে, অপরদিকে কোর্টের বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার রায় সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ সহ পঞ্চদশ সংশোধনীর নামে যে ককটেল সংবিধান জনগণ পেয়েছে- তা দেখে দেশের মানুষ বিস্মিত হলেও এর দ্বারা সরকার দেশের মানুষকে বোকা বানানোর যে অপপ্রয়াস চালিয়েছেন তা বলাবাহুল্য।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে ধর্মকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের আরেকটি নমুনার কথা পাঠকদের স্মরণ না করিয়ে দিয়ে পারছি না। ইয়াজ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাতিল হওয়া জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে খেলাফত মজলিসের সাথে আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। শর্তগুলো ছিলো আওয়ামীলীগের আদর্শবিরোধী। কিন্ত্র এতে তারা একমত পোষণ করেছিল নিছক ক্ষমতার রাজনীতি স্বার্থে।
বর্তমান পঞ্চদশ সংবিধান সংমোধন নিয়ে মহাজোট-এর শরীক এবং অন্যান্য বাম-প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ ক্ষুব্ধ। তারা শেখ হাসিনার ভোটের রাজনীতি এবং ধর্ম নিয়ে এই রাজনীতির মারপ্যাচ মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষত সংক্ষুব্ধ ওয়ার্কাস পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, ন্যাপ, সাম্যবাদী দল, গণফোরাম ইত্যাদি সংগঠন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের শক্তির ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন বিধায় তাদের কর্মসূচীসমূহ বাস্তবায়ন এবং আদায়ে পুরোপুরি যে আওয়ামীলীগ নির্ভর এটা সর্বজন স্বীকৃত।
এমতাবস্থায় পঞ্চদশ সংশোধন দ্বারা আওয়ামীলীগ ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করেছে- যা ইতোপূর্বে জিয়া-এরশাদ কেউই করেন নি- তা দেখে স্বাভাবিকভাবে ঐ দলসমূহ নিজেদের ক্ষুব্ধতা এবং আওয়ামীলীগ দ্বারা নিজেদের স্বার্থ-দলীয় কর্মসূচী বাস্তবায়িত না হওয়ার ব্যর্থতায় নতুন করে হিসেব-নিকেষ শুরু করছেন। এই হিসেব-নিকেষে দু’বছরের মহাজোট সরকারের সময়ে পাওয়া-না পাওয়ার বেদনার সংযোগও যে রয়েছে তা বরাবাহুল্য।
পর্যবেক্ষক মহল নতুন মেরুকরণে আভাষের কথা বললেও সকলেই এ ব্যাপারে অবগত যে মেরুকরণে তাদের দৌড় কতটুকু। কারণ এ সকল রাজনৈতিক দলেকে ঘুরেফিরে আওয়ামী ছাতার নীচে ফিরে আসতেই হয়। এটা আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও ভাল করেই বুঝেন যেমন তেমনি তিনি ভোটের রাজনীতি এবং রাজপথের আন্দোলনও ভাল করে বুঝেন। এর প্রমান বিগত আড়াই বছরের ক্ষমতাকালীন সময়ে ইসলামী দলের হাতে যাতে কোন কর্মসূচী না যায় সে ব্যাপারে তার বিচক্ষণ সচতেনতা।
২.
তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে শেখ হাসিনার বর্তমান অবস্থান স্ববিরোধী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে এই স্ববিরোধীতার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষত যে আদালতের দোহাই দেওয়া হচ্ছে; সেই আদালতই তো বলেছিল এ পদ্ধতি আরো দুই টার্ম রাখ যেতে পারে।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনেক কিছুই করে নেয়া যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা যে সম্ভব নয় তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে স্পষ্ট। প্রধান বিরোধীদলের সাথে কোন পরামর্শ না করে তত্ত্বাবধায় সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়াটা যে সুবিবেচনাপ্রসূত হয় নি তা বর্তমান মহাজোট সরকারের সাথে সম্পর্ক-যোগাযোগ রাখেন- এমন প্রায় সকলেরই অভিমত।
৩.
দীর্ঘদিন যাবত ক্ষমতার স্বাদ না পাওয়ার বেদনা থেকে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের প্রবণতা আমরা দেখেছি, দেখেছি রাজনীতিতে স্বৈর-সামরিক সরকারর ধর্মকে ব্যবহার-এর প্রবণতাও। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও বর্তমান মহাজোট সরকারের ধর্মকে হাতিয়ার বানানোর কৌশল দেখলাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন বিগত ৪০ বছরে যারা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ইসলামী আইন প্রবর্তনের কথা বলেছেন তারা কী করেছেন। বিশেষত আমি বলতে চাই এ দীর্ঘ সময়ে তারা ৯০ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী সংগঠন হিসেবে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচিতি-অবস্থান-শক্তির পরিচয় কী দিতে পেরেছেন। যদি না দিতে পারেন এর কারণ কী? কিংবা বিএনপির সাথে জোট করে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের অর্জনটা কী?
এখানে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দেশের মানুষের কাছে খুবই নেতিবাচক। বিশেষত একসময় নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে- পারস্পরিক স্ট্রাটেজিক-আদর্শিক কোন সমঝোতা ছাড়া চারদলভুক্ত থাকাকে দেশের মানুষ ঐ সমস্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সমূহকেও রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম ভাবতে পারছেন না।
৪.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ মুখ্য। এই দুই দলের মধ্যে ন্যুনতম সমঝোতা জাতির প্রাণের দাবি। বিশেষ করে স্বাধীনতার ৪০ বছরে এখনো আমরা এগিয়ে যাবার পথ খুঁজছি; কিন্তু ক্রমাগত উল্টো দিকেই ধাবিত হচ্ছি।
বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুতে বিবদমান দলসমূহের গঠনমূলক আলোচনা-বিতর্ক কাংখিত হলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য জাতীয় ঐক্যে-সমঝোতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভূ-প্রাকৃতিক বিবেচনায় বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপাত্যবাদী কূটচাল বাংলাদেশের রাজনীতি পরিচালরা-নিয়ন্ত্রণে যে সক্রিয় রয়েছে তা এখন আর লুকোচুরির বিষয় নয়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল শিশুসুলভ আচরণ পরিহার করে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে- জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবেন- এটাই জাতির প্রত্যাশা।