ব্লগীয় আড্ডার মিথ কভূঃ আর নয়, আর নয়, হে প্রভু
বিয়ের জন্য কন্যা দেখতে গিয়ে মুরুব্বী গোছের এক আত্মীয়, কন্যার মাত্রাজ্ঞান যাচাই করছিলেন।
—বলতো মা আস্ত একটা খাসি পাক করতে গেলে কতটুকু লবণ দিতে হবে?
বাইরের ড্রইংরুমে কন্যা বসে আছেন, পাত্রপক্ষের প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি। ড্রইংরুম রাস্তার পাশেই, ঘটনাস্থল মফস্বল এলাকার ছোটখাট এক আধা শহর। বলাবাহুল্য এটা সেই শহর, যেখানে মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত আব্রুর ধারনা নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না, প্রাইভেসী বলতে সেখানে বড় জোর সবাই বুঝে- বোরখা পড়ে চলা ফেরা, (কারও বোরখার পর্দা সরিয়ে তার চেহারার দিকে কেউ তাকিয়েছে, এমন প্রাইভেসী লঙ্ঘনের ঘটনা অত্র এলাকায় কখনো ঘটেনি)। বাতাসে উড়ছে জানালার পর্দা, তার ফাঁক দিয়েই আশেপাশের কৌতুহলী প্রতিবেশীদের উকিঝুঁকি, এর মধ্যে আছে এক আধা-পাগল লোক, আদতে যার কান্ডজ্ঞান এলাকার গড় মানুষের চেয়ে অনেক বেশি।
লবণের মাত্রাজ্ঞান নিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকা কন্যাকে বাঁচাতে তিনিই এগিয়ে এলেন- জানালার পর্দা সরিয়ে লোহার গ্রীলের মধ্যে মুখ গুজে একগাল হেসে তিনি বললেন—তা ভাই সাবেরা, এট্টু ভুল হয়্যা গেল যে, খাসিটার সাইজ কিমুন, তা তো ক’লেন না, সাইজ কি আমার মুতো, না আপ্নের......?
খুবই মোটাদাগের ছ্যাবলামার্কা একটা গল্প হয়ে গেছে, সন্দেহ নাই...সামহোয়্যারের সব রুচিবান ব্লগারদের বিরক্তির ভ্রু কুচঁকানো আমি বেশ অনুভব করতে পারছি...... কিন্তু কি করবো, মানুষের মাত্রাজ্ঞান থাকাটা যে কত জরুরী সেটাই মাথার মধ্যে ঘুরছিল, অন্ততঃ গত দুইদিন ধরে, মার্ক সাহেবের ব্লগে আমার প্রথম পোষ্টটা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই। বহুদিন আগে শোনা এই গল্পটা তাই মনে পড়লো।
গতকাল সন্ধ্যা থেকেই আমি যার পর নাই, মুষড়ে পড়েছি। এতক্ষনে আপনারাও নিশ্চয়ই জেনে গেছেন—মার্ক সাহেবের ব্লগে প্রথম দিনটা আমার জন্য মনে রাখার মতো কিছুই ঘটে নাই। পাঠকরা মোটেও ব্যাপক মাত্রায় সাড়া দেন নাই। যারা মন্তব্য করেছেন তাদের কথার সুরেও ছিল বিভ্রান্তি তৈরীর অভিযোগ এবং স্পষ্টই বিরক্তি। মার্ক যথার্থই যাকে বলে ভদ্রলোক, প্রথম দুইদিনে মাত্র গোটা ছয়েক মন্তব্য পড়ার পরও আমাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, প্রাথমিক টিউনিংটা হতে একটু সময় লাগেই, একটা সিরিজ চলছিল, তার মাঝে এসে সেই সিরিজের হাল ধরলে, একটু সময় তো দিতেই হবে—ধরনের সান্ত্বনা বাক্য দিয়ে। পরবর্তীকালে বিপুল ভাবে জনপ্রিয় এমন অনেক কিছুর শুরটা এমন ভাবেই হয়েছে কিন্ত... কাজেই এখনই হতাশ হতে আমি অন্ততঃ রাজী না, মার্ক চেষ্টা করছিলেন আমাকে চাঙ্গা রাখতে......
মার্কের কাছে আমার প্রস্তাব ছিল খুব খোলাখুলি, সিরিজটা আসলে দাড়াচ্ছে না, আমি নিজকে প্রত্যাহার করে নিতে চাই। যাতে মার্ক তার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে নতুন ভাবে উদ্যোগ নিতে পারে।
আমি বললাম, মার্ক—তুমি আমি যা ভাবছি, ঘটনা সেভাবে ঘটছে না, একদম শুরুর কথা চিন্তা করো, যেখানে দাড়িয়ে তুমি আমি এই সিরিজ চালানোর সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলাম। তুমি একটা সিরিজ শুরু করেছিলা—যে কোন কারনেই হোক-তুমি চাইলা আমি বা আমার মতো কেউ সিরিজটা আগায়ে নিয়া যাক। মার্ক, লেটস বি অনেষ্ট, পাঠক রেসপনস্ প্রথম থেকেই একটা জরুরী বিষয় ছিল কিন্ত এখানে, তোমার ব্লগটা তুমি পপুলার করতে চেয়েছো, তাই না? এটাই কিন্ত ছিল তোমার বটম লাইন... ফলে কতজন ব্লগার তোমার সাইট ভিজিট করছে এটা আমাকে হিসাবে নিতেই হবে... আমি তোমাকে লুজার হিসাবে দেখতে চাই না।
মাথার এলোমেলো চুলে হাত বোলায় মার্ক, চুল গুলোকে ঠেলে দেয় মাথার পিছন দিকে......
—কুশুম, আমার বউ যখন ইউনিভারসিটির ছাত্রী, থাকত হলে, বুঝছো... । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, মার্ক বলতে থাকে, তার গলায় কি একটু বিষন্নতার ছাপ?
—প্রায়ই ছুটি ছাটা পেলে, কুশুম চলে আসতো নাসিরাবাদে আমার ছোট ফুফুর বাসায়। আমরা একসাথে খাওয়া দাওয়া করতাম, অনেক কথা বলতাম, তারপর সন্ধ্যা হওয়ার আগেই কুশুমকে পৌছে দিতাম হলের গেটে। একদিনের কথা বলি, কথা বলতে বলতে সেদিন এত সময় চলে গেছে...... ঘড়ির দিকে কেউ খেয়াল করি নাই, যখন ঘোর কাটলো, সর্বনাশ- হলের গেট প্রায় বন্ধ হওয়ার সময়...... এখন রওনা হলেও গেট বন্ধ হওয়ার আগে কিছুতেই পৌছনো যাবে না, এখন কি করা যায়......, কুশুম প্রায় কেঁদে ফেলে, আর কি। সিদ্ধান্ত হলো কুশুম রাতে ফুফুর বাসায় থেকে যাবে... আমার ফুফাতো বোনদের সাথে দিব্যি থাকতে পারবে।
পরদিন বিকালে ফুফু আমাকে ডেকে একটা কথা বলেছিলেন— শোন, সুযোগ থাকলেই সব সু্যোগ নিতে হয় না, নেওয়া উচিত নয়, বুঝেছো? কতটা নেওয়া উচিত, আর কতটা নয়, তার পরিমাপ জানাটা জীবনের জন্য খুব দরকারী। এটাকে বলে পরিমিত বোধ- মাত্রাজ্ঞান, আ সেন্স অব প্রোপরশন... জীবনটা হলো এই মাত্রাবোধের ভারসাম্য, কখনোই কম নয়, কিছুতেই বেশী নয়।
ফুফুর এই কথাটা খুব মনে ধরেছিলো আমার। সব শুনে আমার একটুও রাগ হয় নাই ফুফুর ওপর, বরং মনে হয়েছিল এত মুল্যবান কথা সারা জীবনে এর আগে আমাকে কেউ বলে নাই......
এই জন্যই কি মার্ক আমাকে তার মানসপুত্র ভাবে? প্রথম দিনের দেখায় মার্ক আমাকে এমনটাই বলেছিলো। আমার লিখা পড়ে তার নাকি মনে হয়েছিল, তার ভাবনা গুলাকেই আমি খাতায় লিখে রেখেছি...... কিন্ত এই মুহুর্তে আমার সবকিছু অলৌকিক লাগছিল, সকাল থেকেই আমি যে মাত্রাজ্ঞানের কথা ভাবছিলাম, এই মাত্র মার্ক তো আমাকে সেটাই শুনালো!!! কিভাবে আমাদের দুজনের চিন্তার এত মিল- সত্যিই, কিভাবে? কত প্রজন্মের ব্যবধান আমাদের চিন্তা আর বেড়ে ওঠায়, অথচ মানূষটাকে সবসময় আমার এত কাছের, এমন আত্মার অংশ মনে হয় কেন? সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই জন ব্যক্তির চিন্তার গতিপথ কিভাবে বার বার, একই রেখায় এসে মিলে?
আমার চোখের কোণ ভিজে আসছিল—এই মানুষটাকেই আমি কিনা গত সন্ধ্যা থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছি... তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পরিকল্পনা করছি?
যাবতীয় মোহশুন্য হয়ে আমার তৃতীয় পর্বের (গত পর্ব- আমার নাম বুনায়েল শাফাত...)লিখাটা পড়ে আমারও একই ফিলিংস হচ্ছিল, পুরো লিখাটায় ঠিক সংযম দেখানো যায় নাই। অনেক খানেই মাত্রাজ্ঞান বজায় ছিল না। ফুফু যেটাকে বলছিলেন আ সেন্স অব প্রোপরশন... লিখার অনেক খানেই সেটার অভাব প্রকট ভাবে চোখে পড়ছিলো। প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের লিখা দেখার উত্তেজনা যদি কারন হিসাবে থাকে, তবে আমার জন্য সেটা আরও বেশি দুঃসংবাদ, আমার ম্যচুরিটি হতে আর কয় দশক লাগবে?
ছেলেমানুষী কখনো কখনো উপভোগ্য বটে, কিন্ত ভুলে যাওয়া ঠিক না বাংলা অভিধানে বালখিল্যতা বলেও একটা শব্দ আছে......
সবচেয়ে বালখিল্যতা হয়েছে লোকালটকের প্রসঙ্গ আনাতে, আস্থাহীনতায় ভোগা কোন ব্লগার যেন লুকালের গায়ে ভর দিয়ে উঠে দাড়াতে চাচ্ছে, খুবই অবিবেচক আইডিয়া, সন্দেহ নাই। মার্ক হয়তো ঠিকই বলেছে—লোকালটকের পরিচয় আবিস্কারের বিষয়টাই একটা ক্লিশে তে পরিনত হয়েছে... মানুষকে তা আগের মতো টানে না। আর তাছাড়া স্টাবলিশমেন্টের পক্ষে প্রায় খোলাখুলি অবস্থান বদলে নেওয়ার কারনে সাধারন ব্লগারদের সেই আগ্রহের জায়গাটাই নড়ে গেছে...
অথচ কেউ কি বিশ্বাস করবে স্টান্ট দেখানোর কোন উদ্দেশ্যই আমার ছিল না, এমন কি কারও গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর বিষয়ও এটা নয়? ব্যক্তিগত ভাবে পল্লব মোহাইমেন আমার কাছে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত, আমার প্রিয় বন্ধুর অনেক কাছের মানুষ। আমরা নিজেও একত্রে বহু সময় কাটিয়েছি। বিভিন্ন সময়ে ব্লগীয় আড্ডায় উঠে আসা দাবী—পল্লব মোহাইমেনই লোকালটক—এটা আমি নিজেও অনেকবার শুনেছি। আমাদের জমাটি আড্ডায় এটা নিয়ে আমি পল্লবকে অনেক খোচাখুচি করেছি, তাকে রাগানোর চেষ্টা করেছি—যদিও আমার কাছে কখনই মনে হয় নাই, পল্লব লোকালটক হতে পারে...
মার্ক নিজেও পল্লবকে অনেকদিন ধরে চিনে, বস্তুত মার্ক আমাকে খুজেই পেয়েছে পল্লবের মাধ্যমে, তো আমার এই ধারনাকে মার্ক নিজেও সমর্থন করে। আমরা দুজনেই একমত পল্লবের টেম্পারমেন্ট এ ধরনের ব্লগীয় রহস্যময় চরিত্র নির্মাণের সাথে যায় না।
তাহলে যা ছিল নিছকই একটা ব্লগীয় আড্ডার মিথ, তাকে উপশিরোনামে আমার লিখা প্রথম পর্বেই এত গুরুত্ব দিয়ে কেন নিয়ে আনলাম?
ফুফু যেভাবে বলেনঃ সুযোগ থাকলেই সব সু্যোগ নিতে হয় না, নেওয়া উচিত নয়, বুঝেছো? কতটা নেওয়া উচিত, আর কতটা নয়, তার পরিমাপ জানাটা জীবনের জন্য খুব দরকারী। এটাকে বলে পরিমিত বোধ- মাত্রাজ্ঞান, আ সেন্স অব প্রোপরশন... জীবনটা হলো এই মাত্রাবোধের ভারসাম্য, কখনোই কম নয়, কিছুতেই বেশী নয়।
আমি এবং মার্ক দুজনেই একমত-- এটা ছিল আমার পরিমিত বোধের অভাব...
একজন সাধারন ব্লগারের (অ)সাধারন আত্মকাহিনীর চতুর্থ পর্ব
চতুর্থ পর্ব কাটলো আত্মসমালোচনা আর সাফাই গাইতে গাইতে। কিছু শিক্ষাও হলো নিঃসন্দেহে। আগামী পর্ব থেকে আবার শুরু হবে আমাদের নিয়মিত এই আত্মজৈবনিক রচনা। সবাইকে সাথে থাকার দাওয়াত দিচ্ছি।
ধারাবাহিক এই কাহিনী পাঠ করিয়া বিপুল ভাবে আমোদিত হউন...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪২