এটি একটি পারিবারিক স্মৃতিবিজড়িত নোট।
সময়টা ১৯৯৮ সালের ৩০ অক্টোবর। আমার ছোট ভাই মো. আরিফুল ইসলাম আকাশ জন্মগ্রহণ করে। এটাই এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের সর্বশেষ সংযোজন।
তখন আমাদের পরিবারের সদস্য ছিলাম ৬ জন।
দাদা-দাদী, আব্বু-আম্মু, আকাশ ও আমি।
২০০৭ সালের ৮ এপ্রিল আমার দাদা আলহাজ্ব হবিবর রহমান সরকার পরলোকগমন করেন। এরপর ২০১০ সালের ৪ আগস্ট আমার দাদীও এহলোক ত্যাগ করেন।
সে হিসেবে বাড়িতে আমিসহ এখন ৪ জনের থাকার কথা। কিন্তু ২০০৮ সালের আগস্টে আমি যখন কলেজে ভর্তি হয়ে বাড়িছাড়া হই, তখন দাদীসহ বাড়িতে ছিলেন ৪ জন।
দাদী মারা যাবার পর বাড়িতে থাকল ৩ জন।
গতকাল, ৩০ জুন ২০১৫, আমার ছোট ভাই আকাশ রংপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে বাড়িছাড়া হল।
এজন্য এখন বাড়িতে থাকল মোটে দুই জন। আমার বাবা আর আমার মা।
অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আমি আপাতত বাড়িতেই আছি।
# আমার দাদা রাত দেড় টার দিকে মারা গিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার রাতে আব্বুকে দেড়টার পর থেকেই জোরে জোরে কাঁদতে দেখেছিলাম।
সেই রাতের ঘটনা মনে পরে আমার।
রাত দেড়টায়, ঠিক দাদা মারা যাবার সময়ই, আব্বু একটা স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন। দৌড়ে দাদার ঘরে যান এবং তার অন্তিম নড়চড় দেখতে পান।
স্বপ্নটা তো পুরো জানি না, তবে এটুকু শুনেছি, স্বপ্নের কোন এক পর্যায়ে একটা বিড়াল আব্বুর গায়ে আঁচর দিচ্ছিল। তখনই আব্বু জেগে উঠে দৌড়ে দাদার ঘরে যান এবং দাদার অন্তিম নড়চড়টি দেখতে পান।
# দৈবচক্রে, আমার দাদীও মারা যান রাত দেড়টায় বা তার সামান্য কিছুক্ষণ আগে।
সেরাতে বিদ্যুৎ না থাকায় আমার ঘুম আসছিল না, তাই আমি পাশের পিচ রাস্তায় গিয়ে বসে ছিলাম, ওখানে একটু বাতাস পাওয়া যায়।
বিদ্যুৎ আসার পর আমি বাড়িতে আসলাম। এসে দেখি আমার আরেক দাদী যিনি সেই রাতে আমার দাদীর পাশে ছিলেন, তিনি দাদীর ঘরের দরজায় এসে আমার আব্বুকে নাম ধরে ডাকছিলেন।
বাড়ির বাইরে থেকে এই ডাক শোনার পর আমি দৌড়ে আসলাম ও দাদীর ডান হাতের নিশ্চুপ ভেইন পরোখ করলাম। আব্বুকে জোরে জোরে ডাকলাম, তিনিও হতদন্ত হয়ে আসলেন এবং হাত ও পায়ের ভেইন নিশ্চুপই খেয়াল করলেন। তারপর অনেকেই আসলো, আমরাও দাদীর মৃত্যু নিশ্চিত হলাম।
সেরাতে আমি রাত সাড়ে চারটার দিকে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর ঘুম ভেঙেছিল তার আধাঘণ্টা পরেই। দেখলাম, আব্বুর অঝোরে কান্না।
# গতকাল আমার ভাইকে রংপুরে মেস এ তুলে দিয়ে এসেছি।
রংপুর যাওয়ার আগের রাতে আব্বুর মন খারাপ ছিল এবং মোটেও ঘুম হয়নি। আর আকাশকে রেখে আসার পরের রাতে অর্থাৎ চলতি রাতে আব্বু প্রায় সারারাত কান্না করেছেন, যেটা কিছুক্ষণ আগে আমি সেহেরি খেতে উঠে আম্মুর কাছেই জানতে পারলাম।
সেহেরিও খেতে পারলেন না বললেই চলে, সামান্য একটু ভাত গলধঃকরণ করলেন।
## উপরের তিনটা ঘটনায় আমাদের পরিবারের তিন জনের দুই রকম প্রস্থানের কথা লিখেছি।
এর মাঝে ২০০৮ সালে আমি যখন রাজশাহীতে কলেজে ভর্তি হই ও সেখানে চলে যাই তখনও আব্বু কেঁদেছিলেন কিনা তা অবশ্য আমি জানি না।
তবে খুব সম্ববত ঘটনা একই, কিন্তু আমার মন খারাপ হবে জন্য আমাকে বলা হয়নি, যেমনটা করা হয়েছে এখন আকাশের বেলায়।
পরিবারের কারও প্রস্থান, সে চূড়ান্ত হোক বা সাময়িক, বড়ই বেদনাদায়ক।
দাদা-দাদী মারা যাওয়ার পর আমি হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। আজ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি, এই নোট লেখার সময়ও কাঁদছি।
আমি ঢাকা-রাজশাহী যাওয়ার সময় আব্বু আমাকে ভদ্রভাবে থাকতে বলত, দেখে-বুঝে চলতে বলত, কারণ আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে আমার আপন ছিল না।
এবার ঢাকা যাওয়ার সময় আব্বু-আম্মুকে আমার বলতে হবে, দেখে-বুঝে চলতে, কারও সাথে বিরোধে না যেতে, আশেপাশে অনেকেই থাকলেও কেন জানি মনেহয় আপন কেউ নেই......
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৫ ভোর ৫:৩৯