হজরত শাহপরান (রহঃ) মাজারে মারামারি হয়েছে।
দেশব্যাপী মাজার বিরোধী কর্মকান্ড চলছে, মাজার ভাঙা হচ্ছে। কিছু কথা বলা যাক।
আমার জন্ম চিটাগং এবং বেড়ে ওঠা সিলেট। দুইটা অঞ্চলই মাজার কেন্দ্রিক নগরী। একটা বারো আউলিয়া নিয়ে গর্ব করে তো আরেকটায় শুয়ে আছেন ৩৬০ আউলিয়া। আছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আলেম মামা ভাগ্না জুটি শাহজালাল (রহঃ) এবং শাহপরাণ (রহঃ)। উনাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশ অঞ্চলটা ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণে পড়ার পরেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। নাহলে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে নজর ফেরান, একটাও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
তাই মুসলিম হিসেবে উনাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
এখন এই কৃতজ্ঞতার মাত্রা কতখানি, সেটা নিয়েই যাবতীয় তর্ক বিতর্ক।
ইসলাম ধর্মমতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কেবলমাত্র আল্লাহ। হিন্দু ধর্মে যেমন সাধু-মুনি-ঋষিদের প্রচুর ক্ষমতা, উনাদের ভয়ে দেবতারাও ভীত, আমাদের ধর্মে এমন কিছুই নেই। উল্টো নবী রাসূলগণও নিজেদের আল্লাহর দাস বলেছেন, নিজেরাই শিক্ষা দিয়েছেন যে "একমাত্র" আল্লাহর ইবাদত করতে, কিছু চাইলে আল্লাহর কাছেই চাইতে, কারন দেবার ক্ষমতা কেবলই আল্লাহর আছে, আর কারোর নেই।
আমাদের নবীজির (সঃ) জীবনী দেখলে আমরা দেখবো তাঁর চোখের সামনে এক কন্যা ফাতেমা ছাড়া বাকি সব সন্তান ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর যদি কোন ক্ষমতা থাকতো, তবে তিনি অবশ্যই তাঁর সন্তানদের জীবিত করতেন, বা দীর্ঘায়ু করতেন। যুদ্ধে আহত হয়েছেন, রক্ত ঝরেছে, ক্ষুধার যন্ত্রনায় পেটে পাথর বেঁধেছেন। তাঁর যাবতীয় মিরাকেল বা মুজেজার ঘটনা যাই আমরা শুনি, সবই হয়েছে আল্লাহর হুকুমে। আল্লাহর হুকুম যেখানে হয়নি, সেখানে কিছু ঘটেনি।
কিন্তু আপনি বাংলাদেশের মাজারগুলোতে গেলে ভিন্নধর্মী ইসলাম দেখবেন। লোকজন মাজারে শায়িত মুর্দার কাছে প্রার্থনা করছে, মানত করছে, জিকির করছে, আজগুবি কাহিনী শেয়ার করছে, সেগুলোকে বিশ্বাস করাকে ঈমানী দায়িত্ব মনে করছে। অথচ আমরা জানি, ইসলাম ধর্ম মতে, একটি লোক যখন মারা যায়, ওর যাবতীয় ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। যে নিজেই গোসল করে কবরে শোয়ার ক্ষমতা রাখেনা, সে কবরে শুয়ে শুয়ে আপনার সমস্যার সমাধান করবে কিভাবে? বুদ্ধিশুদ্ধি কোথায় থাকে?
শাহজালাল (রহঃ) মাজারে আমার দাদি আর আব্বুর কবর। একবার কবর জিয়ারত করে ফেরার সময়ে দেখি এক বেকুব মহা আবেগে আপ্লুত হয়ে বলছে "বাবা (শাহজালালকে (রহঃ) লোকে "বাবা" সম্বোধন করে) আমার দোয়া কবুল করেছেন! তাই বৃষ্টি পাঠিয়েছেন! বাবা আমার দোয়া কবুল করেছেন!"
মাজারের খাদেমরা ভুরু কুঁচকে অতি বিরক্তির সাথে এই কার্টুনের কথা হজম করছেন। আমি জানি, উনাদের এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিনের মধ্যে কমসে কম শ' খানেকবারতো যেতেই হয়।
বাবা দোয়া কবুল করার কে? বাবা নিজেই নিজের পাপ পুন্য নিয়ে টেনশনে অস্থির! উনার নিজেরই ইয়া নফসি অবস্থা!
তারপরে আসেন ওখানকার স্থানীয় ফকির মিসকিনদের ব্যাপারে।
সারাদিন গাঞ্জার উপরই থাকে। অথচ গাঞ্জা বা যেকোন নেশাজাতীয় পণ্য ইসলামে হারাম। মাজার প্রাঙ্গনে সিলেটের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ আছে, হাজার হাজার মানুষ প্রতিওয়াক্তে নামাজ আদায় করে, মুসাফিররা সেখানে বিশ্রাম নেন বা রাত কাটান। আছে মাদ্রাসাও। এমন ধর্মীয় পরিবেশে এই গাঁজার আসর কেন বসবে? বাংলাদেশের আইনেও কি গাঁজা লিগ্যাল? তাহলে মাজার প্রাঙ্গনে এইসব বদমাইশ ধান্দাবাজ গাঁজাখোরদের কেন ধরা হয়না? আমরা স্থানীয়রা জানি এরাই গোটা শহরের গাঞ্জা ডিলার, পুলিশ জানেনা? পুলিশ কিছু করে না, কারন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। অথবা পুলিশ নিজেই ভীত, "বাবার দরবারে বাবার আশেককে গ্রেফতার করলে যদি রক্তবমি হয়ে মরি?"
বাড়িয়ে বলছি না, বাস্তবেই এমন বহু লোক আছে। একবার আমার এক বন্ধুর ডায়রিয়া হলো। হারামজাদা রাস্তার বাসি খাবারের উপর দোষ না চাপিয়ে আহ্লাদী স্বরে বললো "বাবার দরবারে একটা ফকিরকে ভিক্ষা দেই নাই, তাই হয়তো তিনি নারাজ হয়েছেন!"
শাহজালাল (রহঃ) মাজার প্রাঙ্গনে আছে একটি প্রাচীন কুয়া। কেচ্ছা রটিত আছে যে "এই কুয়ার সাথে জমজম কূপের ডিরেক্ট কানেকশন আছে। একবার এক ছেলে এই কুয়ায় ডুবেছিল, ওর লাশ জমজম কূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।"
"তোর পরিচিত ছিল সেই ছেলে?"
"না। তবে এই কথা সবাই জানে।"
যে "জানে" ওর কোন আইডিয়াই নাই জমজম কূপ কোথায়, সিলেট কোথায়, দুই কূপের মধ্যে কোন কানেকশন সম্ভব কিনা, ইসলাম ধর্ম কি ইত্যাদি কোন ব্যাপারেই।
ইসলাম ধর্মমতে ওরসও হারাম। অথচ দেশের এমন কোন মাজার আছে কিনা আমার জানা নেই যেখানে ওরস হয়না। গান বাজনা চলে, মাদকসেবন চলে, আরও নানান অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটে যার সাথে ইসলামধর্মের দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনই যোগাযোগ নেই।
মাজার ব্যবসা বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসা। খোঁজ নেন, বিলিওন টাকার নিচে কোন হিসাব পাবেন না। শবে বরাত, শবে মেরাজ, বার্ষিক ওরস ইত্যাদি সময়ে এই ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠে।
ভাল বলতে একটাই ঘটনা ঘটে, তা হচ্ছে গরিব মানুষের জন্য সিন্নি বিতরণ। সেটাও জনতার টাকায়, এবং তাও একশো টাকা দিলে হয়তো পাঁচ টাকা ব্যয় হবে। এছাড়া এইসব মাজারের কোনই ভূমিকা নেই।
শাহপরান মাজারে যে সংঘর্ষ হয়েছে সেটাও মাজার কর্তৃপক্ষের সাথে গাঞ্জাখোর পাগল-ফকিরদের দলের। মাজার কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র/আলেমরা ওরসের সময়ে গান-মাদক ইত্যাদি কর্মকান্ড করতে নিষেধ করেছিল, এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ফকিররা ওদের উপর হামলা চালায়। মাজার প্রাঙ্গনে মাদক নিষেধ করলে কাদের ক্ষতি হবে সেটা বুঝতে একটু বুদ্ধি খাটানোই যথেষ্ট।
এছাড়া এইটা একটা ফ্যাক্ট যে ভারতে এমন বহু ঘটনা আছে যে খুনের আসামি, চোর, ডাকাত ইত্যাদি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে সাধু সন্ন্যাসীর বেশ ধরে শ্মশান ঘাট বা মন্দিরে আত্মগোপন করে থাকে। তেমনই আমাদের দেশেও মাজারে এইসব ভন্ড ফকিরদের উপর অভিযান চালালে বহু ফেরারি আসামি ধরা খাবে বলে আমার বিশ্বাস। দেহব্যবসা থেকে আরও বহুকিছু চলে এইসব ভণ্ডামির আড়ালে।
আমি শুধু শাহ্জালাল, শাহপরান মাজারের ঘটনা বললাম। যাদের জেনুইন আলেম হিসেবে গোটা বিশ্ব মানে। ঢাকা বা অন্যান্য বহু অঞ্চলে অগা মগা বগাও মরার পরে মাজার ব্যবসা চালু করে বসে আছে। মূর্খ, অশিক্ষিত ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে খেলে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে। আপনি টাউট দেখতে চাইলে একবার যেকোন মাজারে যান, হাজারে হাজারে টাউট বাটপারের ছড়াছড়ি।
এইসব বন্ধ হওয়া উচিত। পুলিশ বা প্রশাসন এইগুলো ধরতে ভয় পায়, কারন লোকে ওদেরকে "নাস্তিক" ট্যাগ দিয়ে মারধর করতে পারে। আলেমদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে আলেমরা ট্যাগ খাবে "ওয়াহাবি/সালাফি-সৌদির দালাল" ইত্যাদি হিসেবে। এই যেমন একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে নিজের পড়াশোনা করা বিদ্যার উপর ভিত্তি করে আমি যে মাজার বিরোধী কথা বললাম, এখন লোকে আমার নামেও নানান ট্যাগ দেয়া শুরু করবে। অথচ না আমার সৌদির সাথে কোন কানেকশন আছে, না ওয়াহাবীদের ব্যাপারে কোন আগ্রহ আছে। আমি যে আলেমকে বেশি মান্য করি, উনি ইমাম আহমেদ ইব্ন হান্বালের শিষ্য - মানে "হান্বালী।"
এইটাই আমাদের সমস্যা, আমাদের কেউ হানাফী, কেউ মালেকী, কেউবা শাফে'ঈ বা হান্বালী - কেউই "মুসলিম" নয়!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৩৯