শেখ হাসিনা, উনার পুত্র এবং উনাদের চ্যালা চামচারা নিজেদের স্বভাব মতন পুরো ঘটনার জন্য বিএনপি জামাত জোটকে দোষারোপ করছেন।
একটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, ওরা কি আমাদের সবাইকে পাতা খাওয়া ছাগল মনে করে? ওরা কি আমাদের বিচারবুদ্ধিকে এতটাই তুচ্ছজ্ঞান করে যে ওরা ভাবে ওরা যাই বলবে আমরা তাই ঈমানের সাথে মেনে নিব? আওয়ামীলীগ ঠিক কোন লজিকে এই ঘটনার জন্য বিএনপি এবং জামাত শিবিরের উপর দায় চাপাচ্ছে? আমাদেরতো গোল্ডফিস মেমোরি নারে ভাই।
প্রথমত, আন্দোলনটা সাধারণ ছাত্রদের ছিল, এখানে বিএনপি জামাত শিবির কেউই যুক্ত ছিল না। এটা সরকার পতনের আন্দোলনও ছিল না। ওরা কেবল দাবি করছিল কোটা সংস্কার করতে। ৫৬% বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধার নাতির কোটা ৩০% থেকে কমিয়ে আনতে যাতে সাধারনরাও সুযোগ পায়। প্রথমদিকে তেমন পাত্তাও পাচ্ছিল না। আমিতো জানতামতো দেশে এ নিয়ে ক্ষোভ বিক্ষোভ হচ্ছে। আমরা আমাদের প্রবাসী জীবন নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত ছিলাম।
বিএনপি জামাত শিবির যুক্ত হলে ওরা শুরুই করতো "এই জালিম ভোটচোর নাস্তিক সরকারের পতন চাই!"
দুইয়ের মাঝে পার্থক্য আশা করি সবাই বুঝেন।
স্টুডেন্টদের আন্দোলন এগোতে থাকে। এমন সময়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিলেন।
স্টুডেন্টরা ক্ষুব্ধ হলো, কিন্তু ওরা সহিংতায় যায়নি। ওরা শান্তিপূর্ণভাবেই নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করলো। "আপনি আমাদের রাজাকার বলেছেন? তাহলে আপনি স্বৈরাচার।"
শুরু হলো স্লোগান "তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার!"
এ পর্যন্ত গালির বদলে পাল্টা গালি গেছে - এখনও পর্যন্ত কিছুই বিগড়েনি।
সরকার চাইলেই ওদেরকে ডেকে এনে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারে।
কিন্তু তখনই শুরু হলো ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের ফাত্রা পোলাপানের ফাত্রামি। ওরা কন্টেক্স্ট বিবেচনায় না নিয়ে, পুরো স্লোগান বিবেচনায় না নিয়ে শুধু "তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার" অংশটাকে নিজেদের লাইক শেয়ার ও ভিউ পাবার ধান্দা হিসেবে ব্যবহার করলো। ফাত্রা কিছু ফেসবুক সেলিব্রেটিও এতে যুক্ত হলো। চেতনা ব্যবসায়ী একেকটা মুখশধারী ভন্ড আলগা দেশপ্রেম দেখাতে স্ট্যাটাস দিল "তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি" এবং আমাদের এক নম্বর সরকারি চাটুকার ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিছুই না পড়ে না জেনে বলে বসলেন ঢাবির ছাত্রছাত্রীদের মুখ দেখতে চান না, কারন ওদের দেখলেই মনে হবে ওরা রাজাকার।
এখনও পর্যন্ত কিন্তু বিগড়ে নাই কিছু। জাফর ইকবাল স্যারের আওয়ামীপ্রেম সবাই জানে, আমার মতন কিছু মানুষ মোহ ভেঙেছে, কিন্তু সেটা ড্রাস্টিক পর্যায়ে যায়নি। শুধু বিভিন্ন গ্রূপ থেকে ঘোষণা এসেছে ওনার বইগুলো বয়কট করা হবে। ভাইসাব বই বিক্রি করে যা টাকা কামানোর কামিয়ে ফেলেছেন, শেষ বয়সে ওনারও এতে কিছুই যায় আসেনা।
সমস্যা এরপরেই শুরু হয়েছে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগ ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই জানোয়ারগুলি এর আগেও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের মতন যৌক্তিক ও কল্যাণকর আন্দোলনকে নষ্ট করেছিল। বুয়েট ক্যাম্পাসে আবারকে পিটিয়ে এরাই মেরেছিল। গোটা দেশে ত্রাসের রাজত্ব তৈরিতে এদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গোটা দেশের মানুষ এদের যন্ত্রনায় অতিষ্ট! এখন যদি লোকে বলে থাকে যারা ছাত্রলীগ দেখতে পারেনা, সবাই জামাত বিএনপি, তাহলে বলতেই হয় গোটা দেশে জামাত বিএনপিই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই হিসাবে শেখ হাসিনা যে ভোট চুরি করেন, সেটা ওদের এই কথাতেই প্রমাণিত হয়।
আমার পরিচিত বহু এক্স ছাত্রলীগ নেতা/কর্মীদের এখন বলতে দেখছি (কেউ কেউ আমার আত্মীয়) "এরা এসব কি করছে? আমরাতো কখনও এমন ছিলাম না।"
এদের বেশিরভাগই এরশাদ পতন আন্দোলনের সময়কার লীগার। ওদের সময়ে একটা আদর্শ ছিল, একটা ফোকাস ছিল, একটা এথিক্স ছিল। বর্তমানগুলির মতন না যে রুম থেকে পঁচিশ প্যাকেট কনডম উদ্ধার হয়।
তা এই বোধোদয় হওয়া ছাত্রলীগ নেতাদের কি বর্তমান ছাত্রলীগের ফাত্রারা "সহীহ ছাত্রলীগ নহে" ফতোয়া দিবে?
ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে হলে মানুষ হওয়াটাই যথেষ্ট।
তা আজকের এই ছাত্ররাই ২০১৮ সালে এই জানোয়ারদের হাতে মার খেয়েছিল। তখন ওরা ক্লাস ৯-১০এর বাচ্চা ছিল। এখন ওদের বয়স বেড়েছে। মোটেই বাচ্চা নেই। এখন হেলমেট মাথায় ওদের মারতে এলে ওরা ঠিকই জবাব দিতে পারে। সেটাই ঘটেছে।
কিন্তু ছাত্রলীগের গুন্ডাদের হাতে পিস্তল ছিল, রামদা ছিল, সামনে বডিগার্ড হিসেবে পুলিশ ছিল - কাজেই আবু সাইদ যা কল্পনাও করেনি, সেটাই হয়েছে - নিরস্ত্র লোকটার পেতে দেয়া বুকে কাপুরুষের দল গুলি চালিয়েছে।
'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।" - বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটা বিগত বছরগুলোতে জোর করে গেলাতে গেলাতে এখন দেখা গেছে সাধারণ ছাত্ররা আত্মস্থ করেছে, আর ছাত্রলীগ সেটা ভুলে গেছে।
লেগে গেল যুদ্ধ। যত ছাত্রের রক্ত ঝড়ে, তত বেশি ছাত্র এসে যুক্ত হয়। প্রথমে যা ছিল কেবলই পাবলিক ইউনিভার্সিটির ব্যাপার, অতি দ্রুত তাতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও যুক্ত হলো। নির্লজ্জ, কাপুরুষের মতন পুলিশ বাহিনী ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে হামলা করে - সাহায্যে এগিয়ে আসে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। রাস্তায় ঝাঁপ দেয় বাকি সব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। ওদের কারোরই কোন ঠ্যাকা ছিল না কোটা সংস্কার নিয়ে। ওদের কারোরই লক্ষ্য না সরকারি চাকরি। ওখানে ঘুষ দুর্নীতি ছাড়া আর কি আছে? আমরা নিজেদের পরিশ্রমে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করবো, বেশি বেতন পাব, সৎ জীবন যাপন করবো। আমি যখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, সেটাই ছিল আমার সব বন্ধুবান্ধবের মেন্টালিটি। এখনও এর পরিবর্তন হওয়ার কথা না।
কিন্তু....
তোমরা যখন স্টুডেন্টদের প্রতি কীট পতঙ্গের মতন আচরণ করবে, তখনতো ভাই আমরা ক্যাম্পাসে বসে "আয় তব সহচরী হাতে হাতে হাত ধরি" গাইবো না। তখনই "যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা" করতে সবাই রাজপথে নেমেছে। সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে গোটা বিশ্বের প্রতিটা কোণে অবস্থান করা বাংলাদেশী ছাত্রসমাজ ও প্রবাসীরা।
এখানেও জামাত বিএনপি ষড়যন্ত্র খোঁজা হচ্ছে কোন লজিকে বুঝলাম না। পুলিশের পেছন থেকে যেসব শূকরছানা হেলমেট মাথায় আমার ভাইয়েদের দিকে গুলি করছে, ওরা যদি বিএনপি জামাত হয়ে থাকে, তাহলেতো দেশে মিরাকেল ঘটছে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় অথচ পুলিশ কাজ করছে জামাত বিএনপির চাকর হিসেবে! এমনও সম্ভব?
তা বিএনপি জামাত কিভাবে যুক্ত আছে? প্রমান হচ্ছে মেট্রোরেলে আগুন দিয়েছে। কোথায়? মিরপুর দশে। রাস্তা থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে দাউ দাউ করে পুড়ছে মেট্রোরেল। অথচ উপর থেকে তোলা একই স্থানের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ বক্সে আগুন দেয়া হয়েছে, উপরে মেট্রোরেলের ট্র্যাক। আগুনের ঘন কালো ধোঁয়া ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে মেট্রোরেল। মানে মেট্রোরেলে আগুন দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে পুলিশ বক্সে। কেন? কারন পুলিশ জনতার বন্ধু। সরকারি নির্দেশে জনতাকে টিপে টুপে দেয় বলে জনতাও ওদেরকে একটু গা গরম করার জন্য আগুন পোহানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
গোটা ছাত্র আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্রের ভিড়ে দুইয়েকটা ছাত্রের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যাদের সাথে হয়তো জামাত/শিবির/বিএনপি লিংকড। ব্যস, অমনি সেটা জামাত বিএনপির আন্দোলন হয়ে গেছে! ওয়াও! লজিক!
এখন পর্যন্ত জীবনে একটা বেসিক প্রিন্সিপাল শিখেছি, তা হচ্ছে, নিজের দোষ স্বীকার করার মধ্য দিয়ে "sorry"র যাত্রা শুরু হয়। আপনি যদি আসলেই নিজের অপকর্মে অনুতপ্ত হতেন, তাহলে অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে নিতেন। তারপরে সেই দোষ কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন। পত্রিকাতেই আছে ছাত্রলীগের কোন শাখা ঝামেলা শুরু করেছিল। দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতেন।ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ দিতেন।
কিন্তু তার বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে আপনি করলেন কি কারফিউ দিয়ে দিলেন। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলেন। দেশের পত্রিকা ও নিউজ মিডিয়ার উপর কি বুলডোজার চালাচ্ছেন তা জানার বিন্দুমাত্র উপায় রাখেননি। লোকে এখন শেখ হাসিনার শুধু ক্ষমতাচ্যুতিই চাচ্ছে না, সাথে মৃত্যু কামনাও করছে! সবাই বিএনপি জামাত? না, সাধারণ মানুষ। ওদের পরিচিত কেউ মারা গেছে অথবা গুম হয়েছে বা ন্যূনতম আহত হয়েছে। চিৎকার করে কান্না করতে করতে আল্লাহর কাছে অভিশাপ দিচ্ছে "ইয়া আল্লাহ! এই জালিমদের তুমি শেষ করে দাও!"
চিন্তা করতে পারেন এরা কোথায় নিয়ে এসেছে দেশটাকে?
আমি বহু বছর ধরে গাজা-সিরিয়ানদের নিয়ে লেখালেখি করি। কে জানতো, একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমার দেশকেও এত দ্রুত যেতে হবে? দেশে যদি সিভিল ওয়ার শুরু হয়, তখনও কি দায়টা বিএনপি জামাতেরই হবে? নাকি ঘাউরা জেদি একটা স্বৈরাচারী সরকারের হবে?
হে আল্লাহ! আমার দেশটাকে তুমি অতি দ্রুত জালিমের কবল থেকে রক্ষা করো! আমিন!