আমরা নতুন বাড়ি যেখানে বানিয়েছি, দুই বছর আগে এটি জঙ্গল ছিল। জঙ্গল সাফ করে নতুন কমিউনিটি বানানো হয়েছে। প্রতিটা কমিউনিটিই এভাবেই বানানো হয়ে থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই এখানে একসময়ে বন্যপ্রাণীর বাস ছিল, এখন নেই। একারনেই নতুন কমিউনিটিতে প্রথম কয়েক বছরে দেখা যায় এখানে বব ক্যাট (বন বিড়াল), কায়োটি (ছোট জাতের নেকড়ে), বা হরিণ ঘুরে বেড়ায়। এছাড়া নানান জাতের পাখি, খরগোশ বা কাঠবিড়ালির বিচরণতো রেগুলার ঘটনা।
এই প্রাণীগুলি সুন্দর, দেখতে ভাল লাগে, আমাদের ক্ষতিও করেনা। উল্টো আমরা কেউ কেউ এদের জন্য খাবার রেখে দেই, যাতে বেশি বেশি করে আসে।
এখন বলি উৎপাতের কথা।
ইঁদুর একটি বিরাট যন্ত্রণার নাম। এরা বাড়ির ভিতর (বিশেষ করে গ্যারাজে) চলে আসে। আমার বাড়ির গ্যারাজেও গত দুই রাত আগে আমি একটা ইঁদুর দেখেছি। পৃথিবীতে এই একটা প্রাণী আমি ভয়াবহ ভয় পাই। শৈশবে ইন্ডিয়াতে প্ল্যাগ রোগের ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। তখন থেকেই এর ব্যাপারে আমার মাথায় ফোবিয়া কাজ করে। আমি ইঁদুর মারার ট্র্যাপ দিয়ে গ্যারাজ ভরে রেখেছি। ফাজিলটা বোধয় ইঁদুর সমাজের বিরাট কোহলি। ট্র্যাপ থেকে খাবার খেয়ে যাচ্ছে গত দুইদিন ধরে, ধরা পড়ছে না, মরছেও না। উল্টা ফাঁদ পাততে গিয়ে নিজের আঙ্গুল ইনজুরড করে ফেলেছি। ইন শা আল্লাহ, আজকে এর বিনাশে আমি সফল হবো। দোয়া রাখবেন।
ইঁদুর ছাড়াও বিছা (scorpion) একটি যন্ত্রনা। ওষুধ ছিটাতে হয়। সাপ একটি সমস্যা। বিশেষ করে যাদের সুইমিং পুল থাকে, প্রায়ই দেখা যায় তাঁদের পুলে সাপ সাঁতার কাটছে। কার্বলিক এসিড ছিটাতে হয়। আর আছে মাকড়শা। ছোটছোট স্পাইডারম্যানের যন্ত্রনায় বাসায় টেকা দায়। সব জায়গায় জাল বিছিয়ে বসে থাকে। যদিও সেই জালে ভিলেন (পোকা, মাছি) ধরে খেয়ে আমাদের উপকারই করে।
নিরীহ এই প্রাণীটিকে অনেকেই ভয় পান। আমাদের প্রতিবেশিনী এতটাই ভীত যে সে ভয়ে আছে কোনদিন মাকড়শা মারতে গিয়ে সে না তাঁর পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
এটাই পয়েন্ট। মাকড়শা মারতে বাড়ি পুড়াবেন কেন? একবার পড়েছিলাম আমাদের অঞ্চলে (ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ) কৃষকরা অর্ধ শিক্ষা পেয়ে পেস্টসাইড ব্যবহার করে উপকারী পোকাও মেরে ফেলে। এছাড়া শস্যকে বিষাক্ত করার কথা বাদই দিলাম। উপমহাদেশে ক্যানসার রোগ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারন খাদ্যে বিষক্রিয়া।
সহজভাবে বুঝাতে গেলে ধরুন কারোর শরীরে টিউমার ধরা পড়েছে। আপনি কী তাঁর শরীর থেকে টিউমার সরাবেন নাকি তাঁকে মেরে ফেলবেন? না, টিউমারের চিকিৎসা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ভিকারুন্নেসার ঘটনার আপডেট জানতে প্রতিদিন পেপার পড়ছি। আজকে দেখলাম ক্লাস টিচারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ! বাহ্! নকল করলো ছাত্রী, টিসি দেয়ার হুমকি দিল প্রিন্সিপাল, অপমান করলো অন্যজনে, গ্রেফতার হলো শ্রেণী শিক্ষিকা!
তারপর অন্যরাও গ্রেফতার হবে। প্রিন্সিপাল এবং যারা যারা মেয়েটির অভিভাবকের সাথে কথা বলেছেন, সবাই। সবাই "আত্মহত্যায় প্ররোচনা" করেছেন।
আচ্ছা, একটা কথা, তাঁদের জায়গায় আপনি হলে কী করতেন? আপনার স্কুলে কোন মেয়ে "নকল" করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে, এবং স্কুলের নিয়মে লেখা আছে নকল করলে বহিষ্কার করা হবে। ক্যানভাসে লেখা এপ্রুভ না হলে কেউ কেউ তেড়েফুঁড়ে আসেন এডমিনদের দিকে। সব এডমিনদের ষড়যন্ত্র, তাঁরা এই করে ঐ করে। কিন্তু এডমিনরা কেবল এইটা দেখে যে আপনি কী গ্রূপের নিয়ম মেনে চলেছেন, কী চলেননি। নিয়ম মানলে এপ্রুভ, না মানলে নাই। এখন তাঁরা এই ক্ষোভে, লজ্জায় আত্মহত্যা করে ফেললে আমাদের দোষ? তেমনি, টিচাররাও নিয়মের বাইরে কিছু করেন নি। রিমান্ডে নেয়ার মতন অপরাধতো অবশ্যই নয়।
ইস্যু বানানো হচ্ছে বাবা মায়ের অপমানের। হ্যা, এইটা একটা বিগ ডিল। এইটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। বাংলাদেশে এই কাজটা না করলে বরং অবিশ্বাস করতাম। তবে আমি কথাবার্তার অপমানের কথা বলছি। মেয়ের বাবাকে "ময়লা চেয়ারে" বসতে দেয়া হলো, মাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল - ইত্যাদি ব্যাপারকে শুধু শুধুই "অপমান" হিসেবে টেনে আনা হচ্ছে। স্কুলের অফিসে কখনই রাজ সিংহাসন, বা ইটালিয়ান লেদার সোফা পাতা থাকেনা। যেই আসে, সে ঐ "ময়লা" চেয়ারেই বসে। এমন না যে তাঁর জন্য অর্ডার দিয়ে ময়লা চেয়ার আনানো হয়েছে। আমাদের মিডিয়াও বেশিই বাড়াবাড়ি করে।
ঘটনার আরেকটু ডিটেইল পড়তে গেলে জানা যায় মেয়ে স্কুল থেকে আগেই বাড়ি ফিরে আসে। মা একটু পরে বাড়ি ফেরত যান। বাবা দ্বারে দ্বারে মেয়ের জন্য দয়া ভিক্ষা করেন। এবং এক পর্যায়ে মেয়ের মায়ের ফোন কল পেয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন মেয়ে নেই।
তাহলে কী কিছুদিনের মধ্যে মাকেও এরেস্ট করা হবে? বাংলাদেশী সামাজিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে ধরে নিতে পারি বাড়ি ফিরে এসে মা নিশ্চই মেয়েকে আদর করে বুঝাননি যে সব ঠিক হয়ে যাবে। দুই চারটা কথা অবশ্যই শুনিয়েছেন। তাহলে মাও মেয়েকে দড়িতে ঝুলে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন। তাই মাকেও গ্রেফতার করা হবে। তারপর সব আসামিকে পুলিশি ডলা দেয়া হবে। এই হচ্ছে আমাদের দেশীয় সমাধান। যুগ যুগ ধরে এইতো ঘটে আসছে। মাঝে যে মূল সমস্যা, "পরীক্ষায় নকল" - সেটার বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা নেয়া হবেনা। ভিকারুননিসার মতন স্কুলে রোল নম্বর বারো যে মেয়েটির, সে কেন পরীক্ষায় নকল করবে এটি একটি প্রশ্ন। যদি নকল নাও করে, তারপরেও কেন সে স্কুলে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে মোবাইল ফোন নিয়ে যাবে? আমাদের স্কুল কলেজে পরীক্ষাগুলোও এমনভাবে ডিজাইন করা উচিৎ যাতে বই খুলে পরীক্ষা দিলেও "নকল" করতে কেউ না পারে। "ওপেন বুক এক্সাম" বা "চিট শিট" অ্যামেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই সাধারণ ঘটনা। "ওপেন বুক" মানে যে বই খুলে লেখা এইটা নিশ্চই সবাই জানেন। "চিট শিট" মানে হচ্ছে একটি পেজে আমি যা খুশি লিখে নিয়ে যেতে পারবো। পরীক্ষায় সেটা দেখে লিখতেও পারবো। কিন্তু পরীক্ষাই এমনভাবে করা হয় যে আমার মাথায় যদি কিছু না ঢুকে থাকে, তাহলে সেই চিট শিটই না, আস্ত বই নিয়ে বসলেও পাশ করতে পারবো না।
আরেকটা পরীক্ষা পদ্ধতি আছে বেশ জনপ্রিয়। সেটা হচ্ছে ক্লাসে পড়বেন, সাথে একটি গ্রূপ প্রজেক্ট শুরু করবেন। পড়াশোনা এগুবে, প্রজেক্টও এগুবে। প্রজেক্ট করতে করতে আপনার মনে প্রশ্ন আসবে, গ্রূপের বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষককে জিজ্ঞেস করবেন, তাঁরা উত্তর দিবেন। ক্লাসের শেষ দিন যেখানে বার্ষিক পরীক্ষা হবে, সেদিন আপনি আপনার গ্রূপ প্রজেক্ট জমা দিবেন। পেজেন্ট করবেন। শিক্ষক প্রশ্ন করবেন, আপনারা উত্তর দিবেন। সেটার উপর আপনার পাশ ফেইল। খুবই সহজ, কার্যকর এবং মজার পদ্ধতি। বাংলাদেশে ক্লাস সিক্সে থাকতে ভূগোল পড়ার সময়ে ভাবতাম দক্ষিণ অ্যামেরিকার কোন দেশে কোন ধরনের খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়, সেটা জেনে আমার কিই লাভটা হবে? সত্যি সত্যিই আমার আগ্রহ থাকতো না এইভাবে পড়ালেখা করতে। একারনেই পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট কখনই করিনি স্কুলে। অথচ আমিতো জানি আমার মাথা খুব একটা খারাপ না। মন দিয়ে যা পড়ি, তার গভীরে চলে যেতে পারি।
এখন আমি যদি ভূগোলের কোন প্রজেক্ট করতাম, তাহলে নিজ উদ্যোগেই প্রেজেন্ট করতাম এই হচ্ছে দক্ষিণ অ্যামেরিকা মহাদেশ, যেখানে অমুক অমুক দেশে তমুক তমুক খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়, আবার তমুক তমুক দেশে অমুক অমুক পদার্থ পাওয়া যায়। এই ঐ কাজে লাগে এসব খনিজ।
একাউন্টিংয়ের ছাত্রদের বুঝতে আরও সুবিধা হবে। আমরা বড় বড় কোম্পানির আস্ত আস্ত ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট তৈরী করতাম ক্লাসে বসে। তারপরে চলতো সেসবের রেশিও বিশ্লেষণ। কত মজা! কার ভাল লাগে থিওরি না বুঝেই মুখস্ত করে যেতে?
মুখস্ত বিদ্যা আর নকল করার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? দুইক্ষেত্রেইতো ছাত্রছাত্রীর বিন্দুমাত্র লাভ হচ্ছেনা। আমি সারাবছর মুখস্ত করে গেলাম "ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল।" এদিকে পরীক্ষায় এলো "পরীক্ষা শেষ হইবার পূর্বে ঘন্টা বাজিয়া গেল।" আমার যদি বেসিক বুঝতে অসুবিধা না হয়, তাহলে আমি লিখতে পারবো। যদি মুখস্ত বিদ্যা হয়, তাহলে আমি লাইব্রেরিতে বসে পরীক্ষা দিলেও ধরা খাব। ঠিক না?
কেউ বলবেন, এমন পরীক্ষাপদ্ধতি আমাদের দেশে চালু করা সম্ভব না।
ভাই, আমরা গ্রেড সিস্টেমে পরীক্ষা দেয়া প্রথম ব্যাচ। টেস্ট পরীক্ষা যখন পাশ করি, তখনও জানি ডিভিশন পদ্ধতিতে পরীক্ষা হবে। শেষের দিকে এসে শুনি গ্রেডিং সিস্টেমে পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে বুঝিও নাই ভাল করেছি নাকি খারাপ। হিসাব করে আত্মীয়স্বজনকে বুঝাতে হয়েছে কয়টা লেটার নিয়ে পাশ করেছি। সরকার কিছু ইমপ্লিমেন্ট করতে চাইলেই করতে পারেন, বাংলাদেশে কেউ কিছু করতে পারবেনা।
এরপরেও অনেকেই আন্দোলন করবেন, এইধরণের প্রশ্নপত্র, পরীক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে চিল্লাফাল্লা করবেন। কিন্তু আশা করি এইটা বুঝতে কারোরই সমস্যা হবেনা যে এর মাধ্যমে আমরা তোতাপাখি বানানোর শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে মানুষ বানানোর শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রবেশ করবো।
পরীক্ষার রেজাল্ট হয়তো অনেকের খারাপ হবে। দেশজুড়ে লাখে লাখে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া যাবেনা। কিন্তু যে ষাট-সত্তুর নম্বর পাবে, সেটাও নিজের মেধা এবং বুদ্ধিতেই পাবে। মুখস্ত বিদ্যার জোড়ে নয়।
আন্দোলনরত মেয়েদের কারোর হাতে প্লেকার্ড দেখলাম। লেখা আছে, "নকল করা যদি হয় অপরাধ, তবে আমরাও শাস্তি চাই।" সিরিয়াসলি? মেয়েদের নাহয় বয়স কম, বুদ্ধি বৃদ্ধি ঘটেনি, তাই বলে অভিভাবকরাও সাপোর্ট করে যাচ্ছেন? ইমোশনাল হওয়া এক ব্যাপার, আর মাথা নষ্ট হওয়া আরেক ব্যাপার। আজকে একটা মেয়ে নকল করায় অপরাধ এবং অপমানবোধে আত্মহত্যা করেছে - তাই নকল করা হালাল হয়ে গেল? কালকে রেপও তাহলে হালাল হয়ে যাবে? খুনও তাই?
একদিকে শিক্ষক গ্রেফতার, অন্যদিকে নকলের হালালিকরণ। আমরা মাকড়শার আতঙ্কে বাড়ি পুড়িয়ে দিতে ওস্তাদ!
গুড জব! কীপ ইট আপ!