"ইহা আল্লাহর ঘর মসজিদের রাস্তা। এই রাস্তায় মহিলাদের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।"
একটি সাইনবোর্ডে লেখা। বাংলায়। বোর্ডের ছবিটি ফেসবুকে আপলোড হলে পরে একদল খুবই মজা নিল। ইসলাম যে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে এত গলাবাজি করে, সেই ইসলামই মসজিদে মহিলাদের প্রবেশ অনেক আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন মসজিদের রাস্তাতেই চলাফেরা নিষেধ করলো। হিপোক্রেসী আর কাকে বলে!
আবার আরেকদল একদমই প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কারন, আসলেইতো - মহিলাদের মসজিদে প্রবেশের অধিকার কে দিয়েছে? মুমিন মহিলারা থাকবেন ঘরে, বছর বছর বাচ্চা পয়দা করবেন, স্বামীর দেখাশোনা করবেন। নামাজ পড়বেন। কাজের ফাঁকে সময় সুযোগ পেলে কুরআন শরিফ পড়বে - এইতো যথেষ্ট! ওদের মসজিদে যাওয়ার দরকার কী?
এখন একটা সহজ প্রশ্ন। ধরুন, আপনি আপনার মা বোনকে নিয়ে কোন আত্মীয়ের বাসায় গেছেন। রাস্তায় মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে। আপনি খুবই ইসলামী ঘরানার যুবক। টুপ করে মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়ে ফেললেন। আপনার মা বোনের কী হবে? তাঁদেরও কী বেহেস্তে যেতে ইচ্ছা করে না? তাঁরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী করবে?
আপনি দাঁত কেলিয়ে বলবেন, "আগেই বলেছিলাম, মেয়ে মানুষের বাইরে যাবারই বা দরকার কী? ঘরে থাকলেই এই বিপত্তিতে পরতে হতো না। আলেমরা নিষেধ করেছেন - ওদের মসজিদে যাবার অধিকার কে দিয়েছে?"
কথা হচ্ছে, আমি এমন এক আলেমকে চিনি, যাঁর ইমামতিতে ফজরের নামাজ পড়তে মহিলারা অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে দল বেঁধে আসতেন। রাস্তায় আবর্জনা পেরিয়ে আসতে হতো, তাঁদের জামার তলভাগে আবর্জনা লেগে যেত। তাঁরা একবার আলেম সাহেবকে বলেও ফেললেন, "হুজুর, আমরা কী তবে বাসায় নামাজ পড়বো?"
আলেম কী জবাব দিলেন?
"তোমাদের জামায় যে ময়লা লাগে, হেঁটে আসতে আসতে মাটিতে সেটা মুছেও যায়। তোমরা অবশ্যই নামাজে আসবে।"
কত্ত বড় কথা! মহিলাদের মসজিদে আসতে বলেন! আমাদের উপমহাদেশের আলেমদের চেয়ে বেশি জানেন? কে এই আলেম?
আলেমের নাম মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)। চৌদ্দশ বছর আগের একজন সুপার স্মার্ট এবং অতি আধুনিক ব্যক্তি - যার বর্তমান ফলোয়াররা এই আধুনিক যুগে প্রাগৈতিহাসিক মেন্টালিটি ধারন করে বলে তাঁকেও সবাই ভুল বুঝে।
বিখ্যাত এই "আলেমের" আরেকটি বাণী (যাহাকে "হাদিস" বলে) বর্ণনা করি।
"পুরুষদের জন্য নামাজের শ্রেষ্ঠ সারী হচ্ছে প্রথম সারী।"
এই হাদিসটি সবাই জানি। কিন্তু হাদীসটির শেষাংশ আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়না।
"এবং নারীদের জন্য শ্রেষ্ঠ সারী হচ্ছে শেষের সারী।"
লক্ষ্য করুন, হাদিসটি কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ছেলে মেয়েদের যদি আলাদা-আলাদা ঘরে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কিন্তু "শেষের সারী" শর্ত খাটে না। মানে নবীজির (সঃ) সময়ে ছেলেমেয়েরা এক সাথে এক ঘরে নামাজ পড়তেন। ছেলেরা সামনের সারিতে দাঁড়াতেন। মেয়েরা পেছনের সারিতে।
চিন্তা করেন, আমাদের দেশে এই দৃশ্য কল্পনাই করা যাবেনা! কোন মহিলা মসজিদে প্রবেশ করলে হুজুররা প্রথমেই আস্তাগফিরুল্লাহ বলে পাপ কাটানোর জন্য নফল ইবাদত শুরু করে দিবেন। জামাতে নামাজ পড়ার কথাতো বহু দূর!
এখন কেউ কেউ বলবেন, আমরা পুরুষ, আমরা আমাদের চিনি। পেছনের সারিতে মেয়ে মানুষ নামাজ পরছে, আর আমরা উঁকি ঝুকি দিব না - সেটা কখনই হবেনা। কাজেই ঈমান তাজা রাখতে হলে অবশ্যই মেয়েদের বাড়িতেই রাখতে হবে।
লিসেন ব্রো - সাহাবীরাও "পুরুষ" ছিলেন। তাঁরা কেউই অতিমানব ছিলেন না। এক যুবক সাহাবী জামাতে নামাজ পড়ার সময়ে সিজদা দেয়ার সময়ে উঁকি দিয়ে মেয়েদের দেখছিলেন। এবং তিনি ধরাও পরে ছিলেন। নবীজির (সঃ) সমাধান কী ছিল জানেন? না, তিনি আমাদের আলেমদের মতন মেয়েদের মসজিদে আসা নিষেধ করেন নি। পুরুষ নারীর মাঝখানে পর্দাও দেননি। তিনি শুধু সেই যুবক সাহাবীকে প্রথম সারিতে নিয়ে গেলেন। স্কুলে কিছু দুর্বল অমনোযোগী ছাত্রদের টিচাররা ফার্স্ট বেঞ্চে বসার "শাস্তি" দেন না? তিনিও সেটাই করলেন। প্রবলেম সল্ভ্ড!
ঘটনা এখানেই শেষ না।
আমরা সবাই জানি সাহাবীদের অনেকেই গরিব ছিলেন। এতই গরিব যে প্যান্ট/পাজামা কেনারও পয়সা তাঁদের ছিল না। তাঁরা কেবল একটি কাপড় পেঁচিয়ে (লুঙ্গির মতন) লজ্জাস্থান ঢাকতেন, এবং উর্ধাঙ্গেও কিছু থাকতো না। এখন এই পোশাকে সিজদা দিতে একটা বিরাট কলিজা থাকা লাগে। তাঁদের সেই কলিজা ছিল। সমস্যা দেখা দিল, সিজদাহ শেষে ওঠার সময়ে প্রতিবার সেই সাহাবীদের পেছনের সারির মহিলাদের একটি দুর্ঘটনার সাক্ষী হতে হতো। তাঁরা নবীজির (সঃ) কাছে সমস্যার কথা খুলে বললে নবীজি (সঃ) এইবারও তাঁদের অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিলেন না। বরং তিনি বললেন, তোমরা একটু বেশি সময় সিজদায় থেক। আবারও "অতি জটিল" সমস্যার অতি সহজ সমাধান।
মসজিদে নববী ছিল আমাদের নবীজির (সঃ) অফিস। এখান থেকেই তিনি দ্বীন প্রচার করতেন। মহিলারা দল বেঁধে তাঁর কাছে এসে নানান বিষয়ে জানতে চাইতেন। একবার উমার (রাঃ) মসজিদে এসে দেখেন নবীজি (সঃ) একদল "মহিলাকে" দ্বীনের শিক্ষা দিচ্ছিলেন এবং তাঁকে দেখেই তিনি হেসে দিলেন। উমার (রাঃ) জানতে চাইলেন, "হে আল্লাহর দূত, আপনি হঠাৎ হাসছেন যে?"
তিনি জানালেন যে মহিলারা খুব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করছিল, এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই গলা চড়ে গিয়েছিল। অথচ উমারকে (রাঃ) দেখে সবাই সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল।
এখানে পয়েন্ট হচ্ছে মহিলারা নবীজিকে কতটা আপন ভাবলে এইরকম গলা চড়িয়ে কথা বলেন! তারমানে তাঁদের সাথে কতখানি ভাল ব্যবহার করলে তাঁরা তাঁকে এতটা আপন ভাবেন!
তারচেয়ে বড় কথা, ঘটনা মসজিদে নববীতে ঘটেছিল। পৃথিবীতে এরচেয়ে মর্যাদার স্থান কেবল মক্কার কাবা শরিফ - আর কিছু নেই।
আর আমরা আমাদের পাড়ার জামে মসজিদকে কিনা পবিত্র রাখার জন্য নারী প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করি! তাহলে কী বলতে চাইছেন, আমাদের উপমহাদেশের মসজিদগুলি মসজিদে নববী, বা হারাম শরিফ থেকেও পবিত্র? সেসব স্থানেতো মহিলাদের অবাধ প্রবেশাধিকার আছে!
জামাতে নামাজ পড়লে পুরুষের জন্য ২৫- ২৭ গুণ বেশি সোয়াবের প্রতিশ্রুতি দেয়া আছে। মহিলাদের ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই।
আমাদের প্রমান আছে, নবীজির (সঃ) সাথে মহিলারা জামাতে নামাজ আদায় করেছেন। মহিলা সাহাবীরা তলোয়ার হাতে সক্রিয় জিহাদে অংশ নিয়েছেন। প্রমান আছে, জিহাদে আহত সাহাবীদের মহিলারা সেবাদান করে সুস্থ করে তুলেছেন। প্রমান আছে উমারের (রাঃ) খিলাফতে মদিনার বাজারের (বর্তমান NYSE) প্রধান নিয়ন্ত্রণ ছিলেন (বর্তমান SEC) একজন নারী সাহাবী।
এবং আমাদেরই একদল আহাম্মক কুরআন ঘেটে ফতোয়া জারি করে "এক পুরুষের সাক্ষ্য, দুই নারীর সমান।" মানে একনারী এক পুরুষের অর্ধেক।
এবং এই ফতয়া শুনে আরেকদল দাঁত কেলিয়ে বলে, "ইসলাম নাকি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।"
দ্বিতীয় দল নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। প্রথম দলকেই আহাম্মক বলছি, কারন এরা চিন্তা ভাবনা না করেই ফতোয়াবাজি করে। প্রথম কথা হচ্ছে, কুরআনের যে আয়াতটিতে (সুরাহ বাকারাহ, আয়াত ২৮২, কুরআন শরীফের সবচেয়ে দীর্ঘতম আয়াত) এই কথা বলা হয়েছে সেটিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে "ঋণ আদান প্রদানের" (মানে বিজনেস ট্রানজেকসনে) ব্যপারে এই শর্ত মানতে হবে। আবার আরেক ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, "মার্ডার কেসের" ব্যপারেও দুই নারী সাক্ষী নিতে হবে।
কিন্তু এইসব "সর্বক্ষেত্রে" নয়।
যদি তাই হতো, হজরত আয়েশার মুখ দিয়ে যে এতগুলো হাদিস এসেছে, সেখানেতো তিনি একাই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, ভ্যারিফাই করার জন্য দ্বিতীয় নারীর প্রয়োজন হয়নি। কিভাবে কী হলো? কমন সেন্স! যেটা আমাদের মধ্যে খুবই আনকমন একটি ব্যপার।
কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে একদল লোক খুব আগ্রহী ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার ব্যপারে। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবিতে শহীদ হতেও কারও কোন আপত্তি নেই। অথচ এই তাঁরাই, দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যাকে মসজিদে আসতে নিষেধ করে গৃহবন্দী করে রাখেন। ইসলাম সম্পর্কে যে দেশের জনগনের বেসিক জ্ঞানটাও নেই, ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কী লাইসেন্স বিহীন চালকের হাতে পাঁচ টনের ট্রাক ধরিয়ে দেয়ার মতন ব্যপার হবেনা?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৬ রাত ১২:২২