মুম্বাই শহরে অবিবাহিতা মেয়েদের উপর একটা জরিপ করা হয়েছিল।
"আপনি নিজের বিয়েতে কেমন অনুষ্ঠান করতে চান?"
প্রায় ৯০% এরও বেশি মেয়ের জবাব ছিল মোটামুটি একটাই, "বলিউড স্টাইল।"
এবং বলিউড ওয়েডিং মানে কী?
এমন আয়োজন যা সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠে যেতে বাধ্য করে। ক্রেন দিয়ে টেনেও যেটাকে কোটরে নামানো যায়না। দারুন ঝলমলে লাইটিং থাকবে, খাওয়া খাদ্যের থাকবে বিরাট আয়োজন। অতিথিদের ভিড়ে থাকবে সেলিব্রেটিদের উপস্থিতি, এবং তাঁরা আবার গানের তালে তালে নেচে আসরও মাতিয়ে তুলবেন।
শাহরুখ খান একটা বিয়েতে শুধু দাওয়াত নিতে কত টাকা নেন জানেন? ১৫ হাজার ডলার। মানে হচ্ছে, আপনার কাছে ১৫ হাজার ডলার থাকলে শাহরুখ খান এসে আপনার বিয়েতে একপ্লেট বিরিয়ানি খেয়ে যাবেন। বিগ ডিল!
আর শাহরুখকে নাচানাচি করাতে কত লাগবে? আট কোটি টাকা!
তিনি এমনই সুপার স্টার যাকে পয়সা দিলে যার তার বিয়েতে এসে নেচে যান। স্যরি শাহরুখ ফ্যানস, শুনিতে মন্দ ঠেকিলেও ইহাই ধ্রুব সত্য। এবং তিনি এই ফাজলামি করার সুযোগ পাচ্ছেন কারন দেশটা ভর্তি এই সমস্ত ফাজিলেই। গত বছর তিনি শুধু বিয়ে খেয়েই নাকি আশি কোটি টাকা কামিয়েছেন।
বলিউডের কথা বললাম কারন স্যাটেলাইটের যুগে আজকাল হলিউডে যা ঘটে সেটাও আমাদের দেশে ঘটতে সময় লাগে না, বলিউডতো সেখানে হোম গ্রাউন্ড হয়ে গেছে। আমি লিখে দিতে পারি, আমাদের দেশেও যদি এমন একটা জরিপ চালানো হয়, দেখা যাবে একই ফল আসছে। আর যদি না আসে, তাহলে ধরে নিতে হবে আমাদের দেশের মেয়েরা মিথ্যা কথা বলে।
কথা হচ্ছে, কারও যদি ইচ্ছা থাকে এবং বাপের পকেটেও টাকা থাকে, সে বলিউড স্টাইলে করুক, হলিউড স্টাইলে করুক কিংবা তামিল স্টাইলে বিয়ে করুক, আমার বাপের কী? আসলেই আমার কিছু যায় আসেনা। বরং আমার কোন বন্ধুর বিয়েতে আমি যদি গিয়ে দেখি শাহরুখ খান আমার পাশে বসে মাংসের রেজালার বাটি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন, আমি হয়তো তাঁর সাথে তখনই সেল্ফি তুলে ফেলবো।
আমি আগেও বলেছি, কারও যদি টাকা খরচের সামর্থ্য থাকে, সেটা খরচ করার অধিকারও তাঁরই।
"সাকিব কেন হেলিকপ্টারে চড়ে বউ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গেল" - ধরনের ফাজিলদের কাতারে আমি পরিনা।
তবে এইসব বিয়ের সামাজিক ইফেক্ট নিয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই, যেটা আসলেই আমাদের সমাজে গুরুতর ইমপ্যাক্ট ফেলে। যদি কারও দ্বিমত থাকে, তাহলে অবশ্যই মন্তব্য করতে পারেন।
ভারতে একটা আইন আছে, শিশু জন্মের আগে আপনি তার লিঙ্গ জানতে পারবেন না। একটা শিশু নয়মাস মাতৃগর্ভে লালিত হয়। তাঁর বাবা মায়ের অনেক আয়োজন করতে হয়। ওর জন্মের সময়ে ওর যেন যথেষ্ট পরিমান কাপড় থাকে, খেলনা থাকে, একটা নাম থাকে - ইত্যাদি। সেজন্য যত আগেভাগে অনাগত শিশুর লিঙ্গ জানা যায়, তত ভাল। প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়।
কিন্তু ভারতে এখনও সেটা "সারপ্রাইজ" হিসেবেই থাকে। কেন? কারন কিছুদিন আগেও ভারতে কন্যা শিশুদের ভ্রুনাবস্থাতেই হত্যা করা হতো। ব্যপারটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আপনার চুল বড় হয়ে গেলে সেলুনে গিয়ে যেভাবে চুল কেটে আসেন, একদম সেরকমই ক্যাজুয়াল।
এবং কাজটা শিক্ষিত সমাজেই বেশি হতো। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা, বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সব পেশাজীবীই এই জঘন্য অপরাধ নির্দ্বিধায় পালন করতেন। অ্যামেরিকা থেকে পিএইচডি করে গেছে দুই ছেলে মেয়ে, প্রেম ও পরে পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছে সেই দম্পতির - প্রথমবার যখন মেয়েটি প্রেগন্যান্ট হলো, তাঁর শ্বাশুড়ি নির্লিপ্ত গলায় শুনিয়ে দিল, "আগার বেটা হুয়া, তো ঠিক হ্যায়। হামে বেটি নেহি চাহিয়ে।"
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে দেয়া যে মেয়ে হলে অ্যাবর্ট করে ফেলতে হবে। এবং মেয়েটিও শ্বাশুরীর কথার কোন প্রতিবাদ করলো না। আগেই বলেছি, মেয়ে এবং তাঁর স্বামী দুইজনই পিএইচডি! শ্বাশুড়িও সেখানকার কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
সামাজিক প্রথা বলে কথা!
ফলফল, এখন ভারতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কম। ভারতের একটি বিরাট সংখ্যক পুরুষ সালমান খান হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং কোন কোন অঞ্চলে আরও ইন্টারেস্টিং কিছু প্রথার জন্ম হচ্ছে। যেমন একটি মেয়েকে এক ভাই বিয়ে করে আনেন। দুই তিনমাস সংসার করার পর তালাক দিয়ে আরেক ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেন। এবং দুই তিনমাস পর সেই ভাইটিও তালাক দিয়ে তৃতীয় ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেন। এবং তারপর আবার তালাক দিয়ে প্রথম ভাইয়ের সাথে মেয়েটির বিয়ে হয়। আশেপাশের দশ গ্রামে বিবাহযোগ্যা মেয়ে নাই, কী করবে? তার চেয়ে ঘরের বউ কি ঘরেই রেখে দেয়া ভাল না?
যাই হোক, আগের বিষয়ে ফেরত আসি। কেন মেয়েদের ভ্রুনাবস্থায় হত্যা করা হচ্ছে? কারন মেয়েদের সংসারের "বোঝা" ভাবা হচ্ছে। ওরাতো প্রকাশ্যেই বলে, "বেটিতো পারায়া ধন হতি হ্যায়।"
মেয়েরা অন্যের আমানত হয়ে থাকে।
এবং তাদের অবচেতন মন একটি আতংক চেপে রাখার চেষ্টা করে, যা প্রায়ই বেরিয়ে আসে, সেটি হলো - একদিন এই মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। যেই মেয়ের স্বপ্ন হচ্ছে "বলিউড ওয়েডিং।" এবং যার খরচ সম্পূর্ণটাই বাপের পকেট থেকেই যাবে। বাপের সামর্থ্য থাকুক, কী না থাকুক। সেই সাথে যোগ করুন যৌতুকের খরচ। ভারতে এখন পাঁচ ছয়শ কোটি টাকাতেও একেকটি বিয়ে হয়। বিশ্বাস না হয়, গুগল সার্চ করুন, "Big fat Indian wedding."
একটি সাধারণ লোক সারাজীবন কাজ করে ষাট বছর বয়সে রিটায়ার করেন। এখনকার চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতির কারনে তিনি আরও বিশ পচিশ বছর বেঁচে থাকেন। তাঁর স্ত্রী তাঁর চেয়ে বয়সে যদি দশ বছর ছোট হন, এবং "মেয়েরা পুরুষের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে" থিওরিটি এখানে অ্যাপ্লাই করি, তাহলে দাঁড়ায় যে তাঁর স্ত্রী আরও দশ থেকে পনের বছর বেশি বাঁচবেন। মানে রিটায়ারের সময়ে ভদ্রলোককে নিজের ও নিজের স্ত্রীর জন্য মোটামুটি তিরিশ পয়ত্রিশ বা চল্লিশ বছরের জন্য টাকা জমিয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু এই বিপুল পরিমান টাকার প্রায় পুরোটাই তাঁর কেবল একটি কন্যার বিয়েতেই খরচ হয়ে যেতে বাধ্য। মেয়ের বিয়ে দিয়ে বাপ মাকে সর্বস্ব হারিয়ে ফুটপাথে নেমে আসার উদাহরণ ভারতে ভুরিভুরি আছে। "বলিউড ওয়েডিং" বলে কথা! কাজেই এই আতংক তাদের এমনই অন্ধ করে দেয় যে নিজের সন্তানের হত্যাকান্ডও তাদের কাছে অপরাধ বলে মনে হয়না। "চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!"
হৃদয়ের লেনদেনেও এই ভাবনা ইফেক্ট ফেলছে। মেয়েরা সবসময়েই বলে, "আমার স্বপ্নের রাজকুমার!"
কেউ কখনই বলেনা, "আমার স্বপ্নের একাউন্টেন্ট। কিংবা আমার স্বপ্নের টিচার!"
রাজকুমারের (ধনী বাপের সন্তান) সামর্থ্য আছে ড্রিম ওয়েডিং উপহার দেয়ার, দামী ব্র্যান্ডেড শাড়ি, ভরি ভরি গহনা উপহার দেয়ার। একাউন্টেন্ট বা শিক্ষকের নেই। ফ্যাক্ট অফ লাইফ।
কাজেই, দেখা যায় স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চুটিয়ে প্রেম করা হাই স্কুল স্যুইট হার্ট কাপলের ব্রেকাপের পর প্রথম সুযোগেই মেয়েটি ধনী কোন যুবকের গলায় ঝুলে পরে। এবং ধুমধাম করে বলিউড ওয়েডিংয়ের বছর দুয়েকের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কেন?
"কারন ও আমার কাছে শুধু শরীরটাই চায়, মন না।"
আপা, ব্যবসায়ীকে বিয়ে করলে আপনার প্রথমেই বোঝা উচিৎ, তাঁর কাছে টাইম ইজ মানি। সারাদিন টাকার পেছনে ছুটে ছুটে অমানুষিকভাবে ক্লান্ত লোকটির হাতে আপনার সাথে রোমান্টিক কথা বলে নষ্ট করার মতন ফালতু সময় নেই। তিনি সেটাই চাইবেন যেজন্য আপনাকে বিয়ে করেছেন। হৃদয়বান স্বামী চাইলে আপনার উচিৎ ছিল ৯টা-৫টা অফিস করা সাধারণ কোন চাকরিজীবিকে বিয়ে করা। "গরিব স্বামী টাকার অভাব ভালবাসা দিয়ে পুষিয়ে দেয়" - হুমায়ূন স্যারের উক্তি।
ডিসক্লেইমার দিয়ে দেই। সব ব্যবসায়ীই যে "মন নয় বরং দেহ তত্বে বিশ্বাসী" এমন নয়। অনেক ব্যবসায়ীকেই দেখেছি হ্যাপী কাপল। আবার অনেক চাকরিজিবিকেও অসুখী হতে দেখেছি। যার যার প্রায়োরিটি। মানুষে মানুষে নির্ভর করে।
সেদিন আমাদের রেডিও অনুষ্ঠান এক কাপ চায়ে এই বিষয় নিয়েই আলোচনা উঠেছিল। চলচ্চিত্রকার ফরহাদ ভাই ফোনে জানালেন, তিনি এমন এক মেয়েকে চিনেন যার জেদ ছিল চীন মৈত্রী সম্মেলনে তাঁর বিয়ে হবে। বাপের পকেট থেকে ১৫ লক্ষ টাকা বের হয়ে গেল। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আপামনির ডিভোর্স হয়ে গেল। এখন আপাতো বাড়িতে বসে আছেন। আর তাঁর বাপ? পথে।
কথা হচ্ছে, বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা - এটি কোন হেলাফেলার বিষয় না। এবং শোঅফের বিষয়তো অবশ্যই না। আপনার বিয়েতে বলিউডের বাদশাহ আসলো, না পাশের বাড়ির আবুল মিস্ত্রী - তাতে কিছুই যায় আসেনা, ট্রাস্ট মি। উল্টা এক শ্রেনীর আত্মীয় অবশ্যই আসবেন যারা এত আয়োজনের মধ্যেও নানা খুঁত খুঁজে বের করে সমালোচনা করবে। আপনার বিয়েতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী, বিয়েতে আপনাকে রেমন্ডের স্যুট দিল, নাকি মুনলাইট টেইলর্সের ফরিদ আলী দর্জির হাতে বানানো স্যুট - It shouldn't matter. অনুষ্ঠানের আয়োজন বাদ দিয়ে তাঁর মন দেখার চেষ্টা করুন। তাঁর বা তাঁর বাপের পকেট থেকে চোখ সরলেই তাঁর মন আপনি দেখতে পাবেন।
এবং আপনার সামর্থ্যে যদি থাকে, তাহলেই কেবল বিয়ের আয়োজন করুন। সামর্থ্যে না থাকলে করবেন না। পাড়া প্রতিবেশী কী বলবে সেটা নিয়ে ভাবছেন? বললাম না, এইরকম ফাজিল আপনি সবসময়েই পাবেন। বরং প্রকৃত বন্ধু তারাই যারা আপনার বিয়েতে বিরানি খেল নাকি শুধু খেজুর, সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আপনার সুখেই তাঁরা সুখী হয়।
সংসার জীবনে ডিভোর্স অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি দুর্ঘটনা। অথচ আজকে দেশ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে ডিভোর্সের ঘটনায়। এবং প্রধান কারণ অ্যাডজাস্টমেন্ট না হওয়া। হবে কিভাবে? ভুল ভিত্তিতে আপনি ইমারত গড়ার চেষ্টা নিয়েছিলেন। ধুতুরার বিজ বপন করে তাতে যতই সার আর পানি দিন না কেন, তা থেকে কখনই গোলাপ ফুটার নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:৫৮