এইচএসসি পরীক্ষা তখন মাত্রই শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বের হতে এখনও অনেক দেরী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রায় বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই বইয়ের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। এখনও চেয়ার টেবিলে বসে জানা পড়াই ঝালিয়ে নিচ্ছে। ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল কলেজ কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতেই হবে।
আমার সেই তাড়া নাই। এই বছরেরই কোন এক সময়ে অ্যামেরিকা উড়াল দিতে পারি। সেখানে গিয়েই না হয় ভাল কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া যাবে।
পরীক্ষা পরবর্তী এই ছুটিটা তাই ভালই উপভোগ করছি।
চলে এসেছি ঢাকায়, খালার বাসায়। ছেলে মেয়ে সব বিদেশে। খালু অফিস নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকেন। খালা বেচারী মোটামুটি নিঃসঙ্গই জীবন কাটান বলা চলে।
ঢাকা শহরের যত দ্রষ্টব্য স্থান আছে (নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনী চক, ইস্টার্ন প্লাজা এবং রাইফেলস স্কয়্যার) সব জায়গাতেই খালা আমাকে নিয়ে যান। আমিও স্বানন্দে যাই। সিলেট থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছি। ঢাকার ধূলাভরা রাস্তায় এমনি এমনি ঘুরতেও মজা লাগে।
ঢাকা ভ্রমণের অংশ হিসেবে আজকে আমরা বেরিয়েছি। খালার ড্রাইভার খালুর গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে রওনা হয়েছে। আমি পথঘাট চিনে চিনে মুখস্ত করার চেষ্টা করছি।
গাড়ি এসে থামলো পুরানা পল্টনের একটি তিনতলা বাড়ির সামনে। মাথা উঁচু করে ভাল করে বাড়িটি দেখে নিলাম। ডিজাইন দেখে মনে হচ্ছে সত্তুর-আশির দশকে নির্মাণ হয়েছে।
বাড়িটির জন্য মায়া লাগলো। আহারে বেচারা! আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। ঢাকার একদম সেন্টার পয়েন্টে গড়ে ওঠাটাই তার জন্য কাল হয়েছে। যে কোন সময়ে এক ডেভেলপারের চোখ পড়লেই ঢাকার আর সব পুরনো বাড়ির মত তাকেও হত্যা করে জন্ম দেয়া হবে আধুনিক কোন সুউচ্চ অট্টালিকার।
প্রায়ন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলায় উঠে এলাম।
সদর দরজা খোলা। বাইরে যেন স্যান্ডেল জুতার প্রদর্শনী চলছে। সাধারণত জুম্মার দিন মসজিদের বাইরেই এমন বিপুল পাদুকার সমাহার দেখা যায়।
খালার ইশারায় আমিও আমার স্যান্ডেল জোড়া খুলে ঘরে প্রবেশ করলাম। মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগলো। চুরি হবে নাতো? স্যান্ডেল চুরি হলে ভালই বিপদে পরবো। "পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র লেখায়" আমি তেমন অভ্যস্ত নই।
ঘরের ভেতরে ড্রয়িং রুমের মত কামরায় পুরুষেরা বসে আছেন। খালা চলে গেলেন অন্দর মহলে। বোধয় মহিলাদের বসার জন্য সেখানে আলাদা ঘর রাখা আছে।
মনে মনে ভাবলাম, এই তাহলে রওশন জামির, তাপসকূল শিরোমনি, সুলতানুল আউলিয়া, বর্তমান জমানার মোজাদ্দেদ, হযরত মাওলানা শাহ সুফী সৈয়দ আব্দুর রহমান সুলতান শাহ জালালাবাদী নকশবন্দী মোজাদ্দেদীর (রহ) পাক দরবার শরীফ! এমন একজন মানুষের দরবারে আসতে পারায় নিজেকে কি ভাগ্যবান ভাবা উচিৎ?
আমি স্বভাবসুলভ চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখতে লাগলাম। কারো সাথে কোন কথোপকথনে গেলাম না।
উল্লেখ করার মত ঘরে কিছুই নেই। ঘরের মেঝেতে কার্পেটের উপর চাদর বিছানো। সেখানে সবাই বসে আছেন। কেউ বিরবির করে জিকির করছেন। কেউ ঝিমাচ্ছেন। কেউ উসখুস করছেন। ঘরের এককোণে আগরবাতি জ্বলতে জ্বলতে সুগন্ধি ছড়াচ্ছে।
চোখে সুরমা দেয়া একজনকে দেখলাম বিপুল উৎসাহে মানুষের গায়ে আতর মেখে দিচ্ছেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে আমার গায়েও আতর লাগিয়ে দিলেন। কড়া গন্ধে মাথা ঝিম মেরে উঠলো।
একজন খাদেম ধরনের লোক হুজুরের 'অফিস ঘরের' (আরবি অথবা উর্দূ টার্মটা ভুলে গেছি) দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন একজন করে মানুষ সেঘর থেকে বেরোচ্ছেন, লোকটা ভেতরে চলে যাচ্ছে। প্রায় সাথে সাথেই বেরিয়ে এসে কারও নাম ডাকছেন, তখন নতুন কেউ সেই ঘরে প্রবেশ করছেন।
কোন ব্যবসায়ীর অফিস হলে এদের নাম হতো কাস্টমার। কোন উকিলের দফতর হলে হতো মক্কেল। কোন ডাক্তারের চেম্বার হলে হতো রোগী। হুজুরের দরবার বলে এরা হচ্ছেন "মুরিদান!"
"এই যে ভাই! হুজুরকে বলেছেনতো যে আমি এসেছি?"
আমার পাশে বসা একজন মুরিদ খাদেমকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন।
"হুজুরের কাছে সবকিছুর খবর আছে! বারবার বলা লাগেনা।"
খাদেমের গলার স্বর মোলায়েম হলেও চেহারা দেখে বুঝলাম, পারলে সে ধমকই দিত।
"সেই কবে থেকেই প্রতিদিন আসছি। হুজুরতো দেখা করছেন না!"
"ধৈর্য্য ধরেন। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের পছন্দ করেন।"
"একসপ্তাহ হয়ে গেল, আর কত ধৈর্য্য ধরবো?"
"'ওহে আদমসন্তান, তোমাদের সব কিছুতেই জলদি!' - কথাটা শোনেননাই? কোরআন শরীফে আল্লাহপাক বলেছেন। তিনি এও বলেছেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের পাশে আছেন।' কাজেই, কামইয়াব হতে হলে অবশ্যই ধৈর্য্যশীল হতে হবে।"
লোকটা আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু বুঝলাম বেচারা তেমন আশ্বস্ত হননি।
আমি লোকটাকে দেখলাম। মধ্যবয়ষ্ক। চেহারা এবং কাপড় চোপর দেখে মনে হচ্ছে মধ্যবিত্ত। হয়তো কোন অফিসের কেরানী। অথবা টুকটাক ব্যবসা করেন। এই সমস্ত লোকেরা নানা কারনেই পীরের কাছে আসতে পারেন। হয়তো ব্যবসা ভাল যাচ্ছেনা। হয়তো বন্ধুর সাথে স্ত্রীর পরকিয়া চলছে। হয়তো সন্তান হচ্ছেনা। হুজুরের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে কোমরে ঝুলাবেন।
হুজুর যেহেতু দেখা করতে চাচ্ছেন না, তার মানে নিশ্চই তিনি ইতিমধ্যেই মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নাহলে কোন ব্যবসায়ী এভাবে কাস্টমারকে উপেক্ষা করে থাকতে পারেন?
লোকটাকে জিজ্ঞেস করবো তার কি সমস্যা? চিনিনা জানিনা হুদাই একটা লোককে এভাবে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা উচিৎ হবে?
"ভাই, আপনার সমস্যা কি?" আমার এই প্রশ্ন শুনে যদি লোকটা চিড়বিড়িয়ে উঠে বলে, "তা জেনে আপনি কি করবেন?" তখন আমি বলবো?
"ভাই, আপনার মুশকিলটা কি?"
দেখলাম আমাদের সামনে বসা ভদ্রলোকের কৌতূহল আমার চেয়েও বেশি। তিনি মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন।
"প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছেরে ভাই!"
আমি লোকটার দিকে আবার ফিরে তাকালাম।
মাথায় গজানো টাককে ঢেকে দিতে বেচারার চুল আপ্রাণ লড়াই করছে। পেটটা এমনভাবে বেরিয়ে আসছে যেন সকালে নাস্তা হিসেবে কোলবালিশ খেয়ে ফেলেছে। গালের কাঁচাপাকা দাড়ি দেখে বয়স কোনভাবেই চল্লিশের কম বলে মনে হবেনা। এরও প্রেমিকা আছে?
আমার হতাশ হবার তখন যথেষ্ট কারন আছে। কখনই প্রেম করা হয়নি। যেসব মেয়ে পাত্তা দেয়, তাদের আমার পছন্দ হয়না। যাদের আমার পছন্দ হয়, তারা আমাকে পাত্তা দেয়না। সদ্যই একটি রূপসীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। ধরেই নিয়েছি এই জীবনে আমার দ্বারা আর প্রেম করা হবেনা। অথচ এই লোক নিজের প্রেমিকার বিয়ে ঠেকাতে পীরের আস্তানায় কদম রেখেছেন! কি সৌভাগ্য!
"আহা!"
কৌতূহলী ভদ্রলোকের কন্ঠে যথেষ্ট সমবেদনা।
"হুজুরকে বলেছেন?"
"তাতো বলেছিই।"
এবারে প্রেমিক পুরুষের কন্ঠে হতাশা টের পেলাম।
"হুজুর গ্যারান্টি সহকারে ব্যবস্থা নিবেন বলেছেন। বলেছেন, একটা পান পড়া দিবেন। ওটা খাওয়ালেই কাজ হবে। কিন্তু তারপর থেকেই তিনি দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছেন।"
"তাই নাকি?"
এবারে আমি যোগ দিলাম।
"তা উনি কি আপনার কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নিয়েছেন?"
ভদ্রলোক বললেন, "আড়াই লক্ষ টাকা নিয়েছেন।"
টাকার অঙ্ক শুনে বিস্ময়ে আমার চোখ ঘরের ছাদ স্পর্শ করতে চাইল।
"কিন্তু কোন ইমপ্রুভমেন্ট দেখছিনা।"
আমি ভদ্রলোককে আবারও ভাল করে স্ক্যান করলাম। দেখে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই এই লোক প্রেমিকার জন্য আড়াই লক্ষ্য টাকা হুজুরকে দিয়ে দিতে পারেন।
যখনকার কথা বলছি তখন একপ্লেট হাজির বিরিয়ানির দাম মাত্রই ৪০ থেকে ৬০ টাকা করা হয়েছে। এককেজি গরুর মাংসের দাম ছিল নব্বই টাকা!
শেখ সাদীর বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। পোষাক দেখে কাউকে বিচার করতে নেই।
আমার মায়াও লাগলো লোকটার প্রতি। আহারে বেচারা! যদি একবার সাহস করে প্রেমিকাকে বলতে পারতো যে তাকে পাবার জন্য সে আড়াই লাখ টাকা আস্তাকুড়ে ঢেলে দিয়েছে, তাহলে অতি অবশ্যই সেই প্রেমিকা তার কাছে ফিরে আসতো! অন্তত আমি সেই প্রেমিকা হলে অবশ্যই আসতাম। এত ভালবাসা আমি কোথায় পাব?
একজনকে দেখলাম হুজুরের কামরা থেকে একটি স্টিলের জগ এবং গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে এলো।
সবাই মোটামুটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লোকটি সেই জগ থেকে গ্লাসে অল্প অল্প পানি ঢেলে দিচ্ছেন। লোকজন সেই পানি তিনবার চুমুক দিয়ে খাচ্ছেন। তারপর গ্লাস উল্টে হাতের তালুতে এক দুই ফোঁটা পানি ঢেলে মাথায়ও দিচ্ছেন।
আমার কাছে আসতে আমি না করলাম।
পানির পিপাসা যে পায়নি এমন নয়। কিন্তু যে গ্লাসে সবাই মুখ লাগিয়ে খেয়েছে, সেই গ্লাস না ধুয়ে খেতে কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগলো।
একজন বললেন, 'খান ভাই, খান। হুজুরের পড়া পানি। অনেক বরকত আছে।'
আমি বিনীত হেসে ফিরিয়ে দিলাম। আল্লাহর বরকত থাকলেই হলো, হুজুরের বরকতের আমার প্রয়োজন নেই।
"চিন্তা করবেন না ভাই।"
কৌতূহলী ভদ্রলোক প্রেমিক পুরুষকে সান্তনা দিলেন।
"হুজুর খুবই কামেল মানুষ। অলী আল্লাহ! তিনি যখন 'কেস' হাতে নিয়েছেন, তখন ফল নিশ্চই পাবেন। আমাকে দেখেন। আমি এখন যা, সবইতো হুজুরেরই দয়া।"
আমি নিশ্চিত হবার চেষ্টা করলাম লোকটা কি "দয়া" বলেছেন, নাকি "দোয়া" বলেছেন? আমি কিন্তু 'দয়া' শুনেছি। হুজুর দয়া করবার কে? হুজুরের কোন কোম্পানিতে তিনি চাকরি করেন?
অবাক হবার কিছু নেই। সেদিন খালা আরেক পীরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই পীরের বসার ঘর দেখি একটি গুদাম ঘরের মতো। বান্ডেলে বান্ডেলে কাপড় সাজিয়ে রাখা। পরে শুনি হুজুরের নিজস্ব টেক্সটাইল মিলস আছে।
আমি কৌতূহলী ভদ্রলোককে বললাম, "আপনার কি হয়েছিল?"
"ছেলে অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল। এক দুষ্টু মেয়ের পাল্লায় পরে উচ্ছন্নে গিয়েছিল। হুজুর এমন দোয়া দিলেন, মেয়েটি ছেলের জীবন থেকে চলে গেল!"
আরে বাহ্! একজন এসেছেন একজন মেয়ে চলে যাচ্ছে, তাকে ঠেকাতে। আরেকজন এসেছেন একজন মেয়ে চলে গেছে এই খুশিতে!
আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। মনে মনে বললাম, "আড়াই লাখ টাকা দিয়েছো বাবু, ওটার চিন্তা কর। প্রেমিকাতো গেছেই, এখন টাকাও যাচ্ছে।"
একজন পুরুষকে দেখলাম জম্বির মত বসে বিরবির করে জিকির করছেন। আমাকে তাঁর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে কৌতুহলী ভদ্রলোক বললেন, "কিছুদিন ধরে তাঁর ছেলে নিখোঁজ। বাবার কাছে এসেছেন খোঁজ পেতে।"
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহারে! একজন ছেলে বা মেয়ে হারিয়ে গেলে কেমন লাগে সেটা বুঝিবা কেবল একজন পিতা অথবা একজন মাতাই ভাল বুঝতে পারবেন।
"একাত্তুরের দিনগুলি"তে পড়েছি কিভাবে একজন ছেলেহারা মা জাহানারা ইমাম জনৈক পাগলা বাবার দরবারে ভিখিরিনির মত বসে থাকতেন। তাঁর মতই আরও অনেক অসহায় মাকে তিনি সেই পাগলা বাবার দরবারে পেয়েছিলেন। ডুবন্ত মানুষ খরকুটো আঁকড়ে ধরতে চায়! এরা যে খরকুটোরও অযোগ্য!
একাত্তুর গিয়েছে, জাহানারা ইমামরাও চলে গিয়েছেন, কিন্তু মানুষদের অসহায়ত্বের ফায়দা লুটতে এইসব পাগলা বাবারা বারবার ফিরে ফিরে আসে।
অপেক্ষা করতে লাগলাম আমার ডাক আসার জন্য।
অবশেষে খালার সাথে হুজুরের দরবারে প্রবেশ করলাম।
উত্তর মেরুর মত ঠান্ডা একটি ঘর। দেয়ালে দেখি দুই দুইটা এসি লাগানো। এইধরনের এই.সি সাধারণত কোন দামী ব্র্যান্ডের শো রুমে দেখা যায়। হুজুর নিজেকে দামী ব্র্যান্ড মনে করে থাকলে সেটা ভিন্ন কথা।
বাইরে উত্তাপে টেকা যায়না। বালতি বালতি ঘাম শরীর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। এদিকে এই ঘরকে একদম ডিপ ফ্রিজ বানিয়ে রাখা হয়েছে! এই ঘরে ঢুকতে হলে অবশ্যই সোয়েটার পরে ঢোকা উচিৎ। পাতলা গেঞ্জি পড়ে আসায় আমি রীতিমত কাঁপছি। অথচ হুজুরকে দেখলাম ফিনফিনে একটা আরবি জোব্বা পড়ে দিব্বি বসে আছেন।
এইকারনেই বুঝি তাঁকে "বহুৎ গরম পীর" বলা হয়ে থাকে।
"স্লামালিকুম হুজুর।"
খালা বেশ ভক্তি ভরেই সালাম দিলেন।
"বল তোর কি চাই, বলে ফ্যাল!"
হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খালাকে কথাটি বললেন। আমার মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। ব্যাটার চোরের মত চাহনীর জন্যই শুধু নয়। সালাম দিলে সালামের যে উত্তর দিতে হয়, এই সাধারণ নিয়ম যে মানেনা, মানুষ তাকে ‘পীর’ বলে ভক্তি করে কোন লজিকে?
তার উপরে একজন মহিলাকে তুইতুকারি করে সম্বোধন করছে! মহিলাদের যে সম্মান করতে হয়, এই ভদ্রতা জ্ঞানটাও তার নেই।
"হুজুর! আমার মেয়ের জামাইর এখনও কোন চাকরি হয়নি হুজুর!"
তখন কিছুদিন আগেই কেবল নাইন ইলেভেন ঘটেছে। বিশ্ব বানিজ্য তখন টালমাটাল অবস্থায় দাঁড়িয়ে। অ্যামেরিকায় তখন কথাবার্তা ছাড়াই সমানে ছাঁটাই হচ্ছে মানুষ। আমার দুলাভাইও সেই ছাঁটাইয়ের শিকার। তাঁদের দুইটি ছোট ছোট বাচ্চা আছে। স্বাভাবিকভাবেই খালা নিজের মেয়ের সংসার নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু তিনি পীরের কাছে যে কেন সাহায্য চাইতে এলেন!
হুজুর চোখ বন্ধ করে দ্রুত বিড়বিড় করে কিছু একটা আওড়ালেন। তারপর হঠাৎ পেছন ফিরে প্রচন্ড ধমক দিলেন, "যা!"
আমি দেখলাম পেছনে কেউ নেই। যেন অদৃশ্য জ্বীনকে তিনি গালি দিলেন। মনে মনে হাসলাম। ব্যাটা আমাকে নতুন মক্কেল মনে করে ড্রামা তৈরী করছে!
"তোর কিছু হবেনা। তোর নিয়তে সমস্যা আছে!"
খালা বেচারির মুখ শুকিয়ে গেল।
"এসব কি বলছেন হুজুর?"
"তোকে আমি বলেছিলাম আমাকে অ্যামেরিকায় তোর মেয়ের বাসায় নেয়ার ব্যবস্থা করতে। সেখানে গেলে আমি একধ্যানে আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য তদবীর করতে পারতাম। নিয়েছিস?"
খালা কি বলবে? আমি মনে মনে হেসেই কূল পাইনা। বাবারে! তদবীর করতে তাঁর অ্যামেরিকা যাওয়া লাগে? কেন, এইদেশে কি আল্লাহকে ডাকলে পাওয়া যায় না?
চেহারায় কিছু প্রকাশ করলাম না। বরং এমন ভাব ধরে রাখলাম যেন হুজুরের প্রতি ভক্তিতে আমার মাথা নত হয়ে আসছে।
হুজুর আমার চোখের সামনে হঠাৎ নিজের ডান হাতের পাঞ্জা মেলে ধরলেন। আমি হকচকিয়ে গেলাম। ঘটনা কি? হাত দেখায় কেন?
কিছু বুঝার আগেই তিনি মুঠ বন্ধ করে বাতাসে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলেন। তারপর সেই একই হাত আমার সামনে আবার মেলে ধরলেন। হাতের মুঠো থেকে একটি তরতাজা আঙ্গুর বেরিয়ে এলো। আরে বাহ্! অতি প্রাচীন ও অতি সহজ একটি ম্যাজিক ট্রিক অতি চমৎকারভাবে প্রয়োগ করলেন!
আমি বুঝলাম না আঙ্গুর নিয়ে কি করবো। খালা বললেন, "এটা নাও।"
আমি তুলে নিলাম। ম্যাজিকের আঙ্গুর। খেতে মন্দ হবার কথা না।
"বিসমিল্লাহ বলে খাও।"
যেকোন খাবারই আমি বিসমিল্লাহ বলে খাই। খালা আবারও মনে করিয়ে দিলেন।
আমি বিসমিল্লাহ বলে আঙ্গুর মুখে পুড়তে পুড়তে খালা বললেন, "নিয়্যত করে খাও।"
কি নিয়্যত করবো? নিয়্যত করেই বা খেতে হবে কেন?
"হুজুর, তাহলে কি আমার মেয়ের জামাইর চাকরি হবে না?"
"হবেনা কেন? নিশ্চই হবে। তদবীর করা লাগবে।"
"অ্যামেরিকায় না গিয়ে কি তদবীর করা যায়না হুজুর?"
"অবশ্যই যায়। সেই ক্ষেত্রে পয়সাপাতি একটু বেশি লাগবে।"
"কত লাগবে হুজুর?"
হুজুর আবার চোখ বন্ধ করে দ্রুত বিড়বিড় করে পিছনে ফিরে প্রচন্ড ধমক দিলেন। ধমকের শব্দে আমার বুক কেঁপে উঠলো। ব্যাটার গলায় ভালই জোর আছে। অতীতে কোথাও নাইটগার্ডের চাকরি করতো নাকি? এই লাইনে এরকমইতো হয়। হঠাৎ কারও উপরে আল্লাহর ‘খাস রহমত’ নাযেল হয়, তিনি হয়ে যান নকশবন্দী পীর! ফকিরনির ঘরে জন্মেও নামের আগে ‘সৈয়দ’ উপাধি যুক্ত হয়ে যায়।
আবারও হাওয়া থাকে কিছু একটা পাকড়াও করে আমার সামনে তিনি মুঠো খুললেন। এবারে টসটসে আরব খেজুর বেরোলো। আমি তার হাত থেকে খেজুর নিলাম। বিসমিল্লাহ বলে মুখে পুরে দিলাম।
"বারো লাখ টাকা।"
টাকার অঙ্ক শুনে আমার গলায় খেজুর আটকে যেতে বসেছিল। কয় কি ব্যাটা! বারো লাখ টাকা লাগবে আল্লাহর কাছে তদবীর করতে? এই টাকায় তখন ঢাকা শহরে ছোটখাট ফ্ল্যাট কিনে ফেলা যায়! কি বলতে চায়? বারো লাখ টাকা না দিলে আল্লাহ দোয়া কবুল করবেন না?
"সেতো অনেক টাকা হুজুর! একটু কমে হয়না?"
"ভাল চাকরি পেতে হলে ভাল তদবীর করাই লাগে!"
খালা এবারে আরেক জায়গায় লাফ দিলেন।
"হুজুর আমার মেয়েটার বাচ্চা হবে। একটু বলেন না, কি হবে?"
হুজুর কিছুক্ষণ চোখ বুজে কিছু শোনার ভঙ্গি করে বললেন, "ছেলে হবে!"
"কিন্তু হুজুর গতবারও আপনি বলেছিলেন তার ছেলে হবে, কিন্তু হয়েছেতো মেয়ে!"
খালা মুখ ফুটে কথা বলায় আমি খুব উৎসাহ পেলাম। যাক, ভন্ডামি ধরতে শুরু করেছেন।
"মেয়ে চঞ্চল হয়েছে, নাকি শান্ত?"
"চঞ্চল।"
"তাহলে? কোন মেয়ে বাচ্চা চঞ্চল হয়? এই মেয়ে মেয়ে হলেও আসলে সে ছেলে। আমি মানুষকে আসল পরিচয়ের কথা বলি, দুনিয়াবী পরিচয়ের না।"
ব্যাটার কাউন্টার আর্গুমেন্টের ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। নিঃসন্দেহে অতি ফালতু কথা অতি কনফিডেন্সের সাথে বলেছে! খালা আর তর্কে গেলেন না।
"হুজুর, আমার ছেলে এখন কি করছে?"
হুজুর এখন চোখ বন্ধ করলেন। তারপর দ্রুত বিড়বিড় করলেন। কিছু শুনলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, "ও এখন ঘুমাচ্ছে। ও ভাল আছে।"
"ও এখন ঘুমাবে কেন হুজুর? ওদের ওখানেতো মাত্রই বিকাল হলো। ও কি অসুস্থ?"
"আরে না। ও ঠিক আছে। একটু শুয়ে আছে আর কি।"
আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, "আপনি কি করে বলতে পারলেন?"
তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমার চেয়ে বড় আহাম্মক তিনি দুই ভূবনের কোথাও দেখেননি।
তারপর থমথমে গলায় বললেন, "আমার পোষা জ্বীন আছে। ওরাই আমার কাছে খবর পৌছে দেয়।"
মনে মনে ভাবলাম বাবারে! সব পীরেরই দেখি পোষা জ্বীন থাকে! কাঁটাবনের দোকানগুলাতে যেমন কুকুর, বিড়াল, পাখিসহ নানান প্রাণী বিক্রি হয়, সেরকম জ্বীনেদের ক্ষেত্রেও কি এমন কোন বাজার আছে যেখানে 'বোতল বন্দি' জ্বীন বিক্রি হয়? বাংলাদেশের তেরকোটি মানুষের মধ্যে কমসেকম একলক্ষ মানুষ পীর। এই একলক্ষের যদি সবারই ন্যূনতম একটি করেও জ্বীন পালার শখ থাকে তাহলে এই ব্যবসা দারুন লাভজনক হবার কথা!
জ্বীনের কথা বলায় আমার একটি গল্প মনে পড়ে গেল। কোরআন শরীফের ঘটনা। হযরত সুলায়মানের (আঃ) মৃত্যু বিষয়ক ঘটনা।
হযরত সুলায়মান (আঃ) জ্বীনদের দিয়ে ইমারত নির্মাণ করাচ্ছিলেন। জ্বীনেরা তাঁকে প্রচন্ড ভয় পেত। তিনি সামনে থাকলে তারা কাজে কখনও ফাঁকি দিত না।
এমন সময়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি মারা যাচ্ছেন। এদিকে ইমারত নির্মাণের কাজ তখনও বহু বাকি। তিনি তখন তাঁর লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়ালেন।
দাঁড়ানো অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হলো। কিন্তু লাঠিতে ভর থাকায় তিনি পড়ে গেলেন না।
জ্বীনেরা মনে করলো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তারা তাদের কাজ চালিয়েই গেল। বুঝতেও পারলো না তাদের মনিব আর বেঁচে নেই।
একটা সময়ে লাঠিতে ঘুণ ধরলো। লাঠি দূর্বল হতে হতে একটা সময়ে ভেঙ্গে গেলে সুলায়মানের (আঃ) দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তখন গিয়ে জ্বীনেরা বুঝতে পারলো যে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু ততদিনে ইমারত নির্মানের কাজ সম্পূর্ন হয়েছে।
যারা চোখের সামনে একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জীবিত না মৃত বুঝতে পারেনা, তারা কিনা গায়েবী জিনিসপত্র দেখে ফেলার ক্ষমতা রাখে? আমাদের দেশের "জ্বীনপালক হুজুর"দের এই লজিক দিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন করেনা?
সবচেয়ে বড় কারন শিক্ষার অভাব। বেশিরভাগ মানুষ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বসে থাকেন, তারপরে কোন বিপদে পড়লে এইসব পীরের কাছে আসেন। যেহেতু তাঁদের বেশিরভাগেরই ধর্মীয় শিক্ষা নেই, তখন এই সমস্ত ভন্ড পীরেরা তাঁদের আবোল তাবোল বুঝিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। অশিক্ষিত মানুষকে ঠকানো খুবই সহজ। সেটা যে লাইনেরই হোক।
আমিই একজন ডাক্তার আঙ্কেলকে চিনতাম। বেচারার একটি বাচ্চা অটেস্টিক। মেডিক্যাল লাইনে কোন সমাধান না পেয়ে তাঁকে এক পীরের দরবারে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছি। পানি পড়া, ফল পড়া, তাবিজ কত কিছুই না বিপুল উৎসাহে তিনি বাচ্চাকে খাওয়াতেন!
আরেকজন ভাইয়াকে চিনতাম যে প্রচন্ড পরিশ্রমে একটি ব্যবসা দাঁড়া করিয়েছিলেন। একবছরের মধ্যেই পরপর কয়েকটা বড়সর লসে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হবার যোগার। তখন তিনি পীরের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে দোকানে লাগালেন। এক তাবিজে কাজ হয় না, আরেক তাবিজ লাগান। তারপর আরও বড় তাবিজ! কয়েক লক্ষ টাকা পীরের পেছনে ঢালার পর একটা সময়ে দোকান পুরোপুরি বন্ধ হলো। মাঝে দিয়ে আরও কয়েক লক্ষ টাকা হুদাই লস করলেন!
তখন থেকেই এইসব পীরদের উপর ঘেন্না ধরে গেছে। যারা মানুষের অসহায়ত্বের ফায়দা তুলে ব্যবসা করে, তাদের কি ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে গ্রেপ্তার করা উচিৎ না? একজন চোর, একজন ডাকাত অথবা একজন ছিনতাইকারীর চেয়ে তারা কি কোন অংশে কম? উল্টো ধর্মের নাম ভাঙ্গানোর কারনে তাদের ডবল শাস্তি প্রাপ্য। যদি আসলেই তাদের "জ্বীনের পাওয়ার" থেকে থাকে, তবে নিজেদের জেল থেকে উদ্ধার করে দেখাক!
তাছাড়া কোরআন শরীফের সুরাহ জ্বিনে আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, "তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। কিন্তু তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেননা। তাঁর রাসূল (মনোনীত পুরুষ, যেমন নবীজি (সঃ)) ব্যতীত।"
এর মানে হচ্ছে যা দেখা যায়না, সেটা ভবিষ্যততো অবশ্যই, সেই সাথে বর্তমানেও যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে, সেটা একমাত্র তিনিই জানেন। আর কারও ক্ষমতা নেই সেসব ব্যপার জেনে ফেলার।
এছাড়াও ইসলাম ধর্মে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া আছে জ্বীনদের প্রতি, তারা যেন মানুষদের থেকে দূরে থাকে। তার মানে হচ্ছে, কোন জ্বীন যদি নিজেকে মুসলমান দাবী করে থাকে, তাহলে সে অবশ্যই মানুষ জাতি থেকে দূরে থাকবে। মানুষ ইচ্ছা করলেই তাকে পালতে পারবে না।
কাজেই যে ধর্মের উপর ভিত্তি করে হুজুরেরা জ্বীনের ‘ব্যবসা’ করে থাকেন, সেই ধর্ম একটু জানলেই এসব ভণ্ডের হাত থেকে মানুষ নিজেদের বাঁচাতে পারতো।
"ও আমার বোনের ছেলে হুজুর! ওকে একটু দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দেন!"
হুজুর তখন আবারও বাতাস থেকে কিছু একটা ধরে এনে আমার সামনে হাতের মুঠো খুললেন। ছোট একটি আপেল।
বাহ্! চমৎকার! আরামসে ফলফ্রুট পেয়ে যাচ্ছি আর খেয়ে যাচ্ছি।
"আজকে শুধু ওকেই সব দিচ্ছেন হুজুর, আমাকে কিছু দিচ্ছেন না?"
"তোরতো নিয়্যত খারাপ! ওর নিয়্যত ভাল। মন পরিষ্কার। এইজন্যই সব ওর জন্যই আসছে!"
মুখের হাসি চেপে রাখতে আমাকে রীতিমত দূর্দান্ত অভিনয় করতে হলো। বলে কি ব্যাটা! আমার নিয়্যত ভাল! মন পরিষ্কার! ব্যাটা! এতক্ষণ মনে মনে তোকে যা যা গালিগালাজ দিয়েছি, তা শুনতে পারলে তোর কানে এইডস হয়ে যেত! ভন্ডামির আর জায়গা পাওনা! ভেবেছো নতুন মক্কেলে ইনভেস্টমেন্ট? শখ কত!
খালা এবারে বললেন, "হুযুর আমার ছেলের ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছে না। একটু দেখেননা কি সমস্যা?"
হুজুর আবারও চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে চলে গেলেন। কান পেতে কিছু শুনলেন। আবারও তীব্র ধমক দিয়ে আমার কলিজা কাঁপিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, "ওর পিছনে শত্রু লাগছে। জানের ‘ক্ষাত্রা’ আছে।"
খালা ভীত গলায় বললেন, "ইয়া আল্লাহ! কি বলছেন হুজুর! কারা ওর শত্রু হুজুর?"
হুজুর রহস্য করে বললেন, "তুই ভাল করেই জানিস শত্রু কারা! এখন তারা তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করতেছে। তোর ছেলের প্রাণের ভয় আছে।"
"হুজুর উপায়?"
"গায়েবী তরিকায় বধ করতে হবে। জ্বীনেদের দিয়া তদবির করতে হবে। খরচাপাতি করতে হবে। তারপর এই শত্রুরাই তার পায়ে ধরে বসে থাকবে।"
"কত লাগবে হুজুর?"
"একটা গরু সদগাহ দিতে যত লাগে। তুই শাহীনের সাথে কথা বলে নিস। এখন যা! অনেক কথা বলছিস!"
হুজুর মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে আমাদের দিকে হাত ঝাড়া দিলেন। খালা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ব্যাগ থেকে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিলেন হুজুরের দিকে। তিনি এমনভাবে টাকাটা নিলেন যেন টাকার কোনই মূল্য নেই তার কাছে।
উপলব্ধি করলাম, ঘরে কেবল একজনই অভিনয় জানেনা।
আমরা বেরিয়ে এলাম।
খালা শাহীনের (খাদেম) সাথে কথা বলতে লাগলেন।
আমার মাথায় তখন একটা চিন্তা এলো। আমাদের নবীজি (সঃ) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন চারিদিকে ছিল তাঁর শত্রু। আবু জাহেল যে তাঁকে কতবার হত্যার চেষ্টা করেছে!
তিনি কিন্তু পারেননি আবু জাহেলকে "গায়েবী তরিকায়" বধ করতে। গায়েবী তরিকায় যদি শত্রু বিনাশ সম্ভব হতো, তাহলে বদর যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ এসব কোন যুদ্ধেই তাঁদের লড়তে হতো না। এই যে হুজুর বললেন তিনি শত্রুদের বধ করার ব্যবস্থা নিবেন (অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে) সেটা তাহলে কিসের ভিত্তিতে? হুজুর কি দাবী করছেন তার ক্ষমতা নবীজির (সঃ) চেয়েও বেশি? বাংলার মুরিদান কি এই সহজ বিষয় বুঝে না?
‘পাক দরবার শরিফ’ থেকে বেরিয়ে এলাম।
যা নিয়ে প্রাথমিক টেনশন কাজ করছিল যে জুতা না চুরি হয়ে যায়, তা ঘটেনি। জুতা ঠিক সেখানেই ছিল যেখানে রেখে গিয়েছিলাম। চোর আল্লাহর ঘর মসজিদ থেকে জুতা চুরি করতে ভয় পায়না, অথচ পীরের দরবার থেকে চুরি করতে ভয় পায়!
বাসায় ফিরতে ফিরতে ঢাকা শহর দেখতে লাগলাম। বড় বড় বিলবোর্ডে দারুন সুন্দরী সুন্দরী মডেল শোভা পাচ্ছে। একটি বিজ্ঞাপন এমন, "......" ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম। মাত্র ছ থেকে আট সপ্তাহ ব্যবহারে ত্বক হবে ফর্সা, উজ্জ্বল!
আহারে! একটা মাল্টিন্যাশনাল চিৎকার করে মেয়েদের বলছে, "তুমি কালো, তাই তুমি কুৎসিত। তোমার ত্বক ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে কেউ সুন্দর বলবে না। তোমার প্রেম হবে না, বিয়ে হবে না!" - এবং কোটি কোটি বাঙ্গালি নিরবেই এই বর্ণবাদি মন্তব্য মেনে নিচ্ছেন। মেয়েরা নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে 'সুন্দর' হওয়ার জন্য এই ক্রিমই গালে ও গলায় ঘষছে।
কেউ নেই জোর গলায় বলে, "আমি যেমন আছি, তেমনই সুন্দর। আমার ত্বক যদি কালো হয়ে থাকে, তবে সেটাই আমার অলংকার। বাংলাদেশের মেয়েদের গায়ের রং কালোই হবার কথা। কেউ যদি আমাকে ভালবাসতে চায়, তাহলে আমি যেমন আছি, সেভাবেই বাসতে হবে। আর কেউ যদি ফর্সা মেয়ে চায়, তাহলে সে নিজের রাস্তা মাপতে পারে।"
মেয়েদের আসল সৈন্দর্য্য তাঁর পার্সোনালিটিতে, তাঁর ব্যক্তিত্বে।
ছোটবেলায় আমার একজন টিচার ছিলেন, বিরাট সেলিব্রেটি বলে তাঁর নাম এখানে বলছি না, তিনি যখন কথা বলতেন আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ক্লাস টু-থ্রীতে পড়ি, তখনই ভাবতাম, আহারে, টিচার যদি বয়সে আমার সমান বা ছোট হতো!
টিচারের গায়ের ত্বক ছিল শ্যামলা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাঁর প্রেমে ফেলতে গায়ের ত্বকের কোনই ভূমিকা ছিল না।
আচ্ছা, অ্যামেরিকাতেওতো প্রচুর কালো মানুষ আছে। সেখানেও কি এই ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম পাওয়া যাবে? মনে হয়না। তাঁদের আত্মসম্মান বোধ সাংঘাতিক। এমন বিজ্ঞাপন ওদেশে চালালে একদম বাঁশ দিয়ে দেবে।
একটা "সৌন্দর্য বর্ধন" সাবানেরও বিজ্ঞাপন দেখলাম। এই সাবান ব্যবহারে নাকি রূপের সৌন্দর্য্য বাড়ে!
যতদূর জানি কারও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে সাবান, শ্যাম্পুর কোন ভূমিকা থাকতে পারেনা। মানুষের চেহারার সৌন্দর্য্য তাঁর মুখের হাড্ডি, মাংস ও চামড়ার গঠনের উপর নির্ভর করে। আমার যদি নাক হয় পিনাকিওর মত লম্বা, এবং চোখ হয় গরুর মত বিশাল, তাহলে আমি যতই মুখে সাবান ঘষি না কেন, আমার "সৌন্দর্য্য" কখনও বৃদ্ধি পাবেনা।
বুঝলাম, হুজুর একাই "গায়েবী তরিকাতে" সমস্যার সমাধান করে থাকেননা। আধুনিক মাল্টিন্যাশনালসও একই পন্থা অবলম্বন করে। এ যেন হুজুরেরই তাবিজের ‘রিমিক্সড’ বিজ্ঞাপন।
খালাকে বললাম, "তোমার এই হুজুরকে খুব বেশি ভরসা করোনা, এই লোকটাকে আমার ভন্ড মনে হচ্ছে।"
খালা জিভ কামড়ে হায় হায় করে উঠলেন, "সর্বনাশ! ছিঃ ছিঃ! তুমি এইসব কি বলছো! এখুনি তওবা কর! হুজুরের নামে এইসব চিন্তা মাথাতেও আনতে নেই। তওবা কর!"
আমি খালাকে শান্ত করতেই নিজের দুই গালে হাত দিয়ে হালকা চাপর দিলাম।
খালা তাতেও সন্তুষ্ট হলেন না। মোবাইল ফোন বের করলেন।
"হ্যালো, জি আমি সালেহা চৌধুরী বলছি। ….হুজুরকে একটু বলে দিবেন যে আমার বোনের ছেলেটাকে মাফ করে দিতে। ও বাচ্চা মানুষ, ভুল করে এমনটা ভেবে ফেলেছে। ….জ্বী? ….হুজুর বুঝে যাবেন। হুজুরকে শুধু কথাটা বলে দিবেন। আমি আবার ফোন করবো।"
খালা ফোন রেখে দিতে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
তিনি বললেন, "এর আগেও একটা ছেলে হুজুরের দরবার শরীফ থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর নামে এইরকম চিন্তা করেছিল। সেই ছেলেটা ঐদিনই এক্সিডেন্টে মারা যায়।"
"তাই নাকি? তুমি চিনতে ছেলেটাকে?"
খালা চোখ বড় বড় করে বললেন, "আমি দুই একবার দেখেছি হুজুরের দরবারে। যেদিন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল, সেদিনও দেখা হয়েছিল। আমরা সবাই খুব মন খারাপ করেছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম ছেলেটা মনে মনে হুজুরকে গালি দিয়েছিল। নাউজুবিল্লাহ!"
খালা খুবই আবেগ দিয়ে নাউজুবিল্লাহ বললেন।
"এরপরই একটা বাসের ধাক্কায় সে রিকশা থেকে পড়ে গেল।"
"সে যে মনে মনে হুজুরকে গালি দিয়েছিল, এই কথা তুমি জানলে কি করে?"
"আমি জানবো কিভাবে? হুজুর জেনেছেন। তিনি মনের কথা বুঝতে পারেন। এই জন্যই বলছি, কখনই তাঁর নামে এইরকম আজে বাজে চিন্তা মাথায় আনবে না। আবারও তওবা কর। বল আস্তাগফিরুল্লাহ।"
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
যেই দেশে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে, সেই দেশের পীর ফকিরেরা টেক্সটাইল মিলসের মালিক হবেন, ডাবল এসির কামরায় অফিস করবেন, এইতো স্বাভাবিক।
সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পরে গেল, “মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে টাকা খরচ করে ঠকতে ভালবাসে।”