বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম
সাম্প্রতিক সময়ে ‘জিহাদ’ শব্দটি পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায় ‘জিহাদী বই’ স্টাইলে। জিহাদ কি এবং কেন আর জিহাদ বলতে আসলেই কি বুঝায় তা অধিকাংশ মুসলমান জানেন না। যারা জানেন তাদের অধিকাংশই আংশিক জানেন, প্রকৃত অর্থ জানেন না। এই ‘জিহাদ’ শব্দটি নিয়ে কম পানি ঘোলা করা হয়নি আর বর্তমান প্রজন্মের নিকট ‘জিহাদ’ শব্দটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তারা শুধু মনে করে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করাটাই হচ্ছে ‘জিহাদ’! অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্ম ‘জিহাদ’ শব্দটির ক্ষেত্রে একপ্রকার ঘৃণা হৃদয়ে ধারণ করে বড় হচ্ছে। আর তাদের হৃদয়ে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার পিছনে রসদ জোগাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, ইসলাম বিদ্বেষীদের লেখা যেখানে কোরআনের আয়াত এবং হাদীস সমূহকে বিকৃত অর্থ করে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। মুসলিম মাত্রই এই বিষয়ে স্বচ্ছ এবং পরিস্কার ধারণা থাকা অতিব গুরুত্বপূর্ণ। ইনশাল্লাহ, নিম্নোক্ত লেখাটির মাধ্যমে অনেকেরই জিহাদ বিষয়ক ভুল ধারণাটি ভেঙ্গে যাবে।
জিহাদের বিবরণ
“যাদের বিরুদ্ধে কাফিররা যুদ্ধের অভিযান চালায় তাদের অনুমতি দেয়া হচ্ছে জিহাদে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্যে; কারণ তারা মযলুম, তারা অত্যাচারিত- আর আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য দানে র্পণূ শক্তিমান, তারা সে সমস্ত লোক যারা তাদের স্বদেশের গৃহ থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কৃত হয়েছে; তাদের একমাত্র অপরাধ এ যে তারা বলেছিলঃ আল্লাহই আমাদের প্রভু-পররোয়ারদিগার। আল্লাহ যদি মানব সমাজের একদল লোকের দ্বারা অন্য লোকদের অপসৃত না করতেন, তাহলে মঠ, গির্জা, উপাসনালয় এবং মসজিদগুলো যাতে আল্লাহর নাম বহুলভাবে স্মরণ করা হয়ে থাকে- বিধস্ত করে ফেলা হত” (সূরা হাজ্জ ২২: ৩৯-৪০)
এ হচ্ছে অতি পরিস্কার কথা। কেবল আত্মরক্ষার জন্য এ আয়াতে জিহাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যা সংক্ষিপ্ত আকাড়ে বললে বুঝায়- কোন দল, এমন সীমানায় যেখানে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক ইসলাম প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেখানে আক্রমন চালানোর হুমকি দিলে বা আক্রমন করতে আসলে তখন ইসলামকে বিজয় রাখার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করাটাই হবে জিহাদে কুফফার বা মুনাফিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (নীচে এই দুই প্রকার জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ)। যেমনঃ রাসূল ﷺ মদীনায় থাকা অবস্থায় যে যুদ্ধগুলো করেছেন।
ইসলাম শান্তির ধর্ম, তবে কাপুরষের ধর্ম নয়, এক গালে চড় খেয়ে অন্য গাল এগিয়ে দেয়ার ধর্ম নয়। কুরআনের সাথে তলোয়ার ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। একটি সত্যের প্রতীক। অপরটি শক্তির প্রতীক। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি অপরিহার্য। মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই সত্য ও শক্তির সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। ইসলামে তথা নাবী ﷺ এর এ এক মহান শিক্ষা। এজন্যেই ইসলামে জিহাদের এত গুরুত্ব। কিন্তু তলোয়ারের জিহাদই একমাত্র জিহাদ নয়। জিহাদের আরো প্রকরণ রয়েছে। সর্বপ্রকার জিহাদ সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
জিহাদের প্রকরণ
জিহাদ চার প্রকারঃ
১। জিহাদের নফসঃ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ।
২। জিহাদে শয়তানঃ শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ।
৩। জিহাদে কুফফারঃ কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ।
৪। জিহাদে মুনাফিকীনঃ মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ।
জিহাদে নফসঃ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ-
জিহাদে নফসের আবার চারটি স্তর রয়েছেঃ
প্রথম স্তরঃ সত্য কোথায় এবং সঠিক পথ কী তা খুঁজে বের কারা জন্য হৃদয়-মনকে অনুপ্রাণিত করা, অর্থাৎ হকের পরিচয় এবং হিদায়াত লাভের জন্য জ্ঞানের অনুশীলন এবং সাধনার আশ্রয় গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। এ পথ কঠিন, এ পথ বন্ধুর। মন সহজে এ দিকে আকৃষ্ট হয় না, মনকে এ কাজে বাধ্য করার চেষ্টা করাই হচ্ছে জিহাদে নফসের প্রথম স্তর। এ স্তর অতিক্রম করতে না পারলে দ্বীনের সৌভাগ্য অর্জনেই মানুষ বঞ্চিত হয় না, পার্থিব সৌভাগ্য লাভও তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
দ্বিতীয় স্তরঃ সঠিক পথের পরিচয় লাভের পর সে পথে চলার জন্য মনকে বাধ্য করা অর্থাৎ ‘ইলমের পর ‘আমালের জন্য মনকে বাধ্য করা। এ পথও অনেকের পক্ষে কঠিন। এজন্য প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রামই হচ্ছে জিহাদে নফসের দ্বিতীয় স্তর।
তৃতীয় স্তরঃ নিজে সঠিক পথ চিনে সেই পথে চলার সঙ্গে সঙ্গে অপরকেও সে পথ চেনাতে হবে এবং সে পথে চলার আহবান জানাতের হবে। এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। যে সত্য সাধক এ কাজ সম্পাদনে অবহেলা প্রদর্শন করবে এবং এ কর্তব্য পালনে উদাসীনতা দেখাবে সে সেসব কমবখত- দূর্ভাগাদের অন্তর্ভূক্ত হবে যারা সত্যকে গোপন করে থাকে। এর নাম তালিম ও দাওয়াত- সত্য শিক্ষাদান এবং সত্যপথে আহবান। এ কাজও কঠিন, এ কাজে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এ ত্যাগ স্বীকার এবং পরিশ্রমের জন্য মনকে প্রস্তুত করা জিহাদে নফসের তৃতীয় স্তর।
চতুর্থ এবং শেষ স্তরঃ মানুষকে সত্যপথে আহবান জানাতে এবং তাদের সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে গিয়ে অনেক বিপদাপদের সম্মুখীন হতে হয়, অনেক দুঃখ-কষ্ট ও মুসীবাতে পরতে হতে হয়, বহু পরীক্ষায় নিপতিত হতে হয়। সে অবস্থায় বিপদ ও ও মুসীবাতে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। শুধু তাই নয়, দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যের তাওফীক লাভ এবং হৃদয়ের দৃঢ়তা আর সংকল্পের অটলতার জন্য আল্লাহর শুকরিয়াও জানাতে হয়। হৃদয়-মন-দেহকে এরূপ দৃঢ় করে গড়ে তোলার এবং বর্ণিত অবস্থাতেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য মানস প্রবণতা সৃষ্টি জিহাদে নফসের চতুর্থ এবং শেষ স্তর। যে ব্যক্তি জিহাদে নফসের এ চারটি স্তরই সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে সক্ষম, সেই প্রকৃত ভাগ্যবান, কারণ তখন সে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত-প্রাণ সত্যিকারের অনুসারী।
জিহাদে শয়তান
শয়তানের সাথে জিহাদের দুইটি পর্যায়। শয়তান মানুষের ঈমানের উপর সন্দেহ এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বীজ বুনে দেয়। এ ব্যাপারে তাকে মোটেই আমল না দেয়াই হচ্ছে জিহাদে শয়তানের প্রথম পর্যায়। আর দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে শয়তানের তরফ থেকে যেসব অনভিপ্রেত ইচ্ছা এবং গর্হিত বাসনা মনের ভিতর নিক্ষেপ করা হয় এবং যার প্রতি হৃদয়ের কোণে অনুরাগ সৃষ্টি হয় তা প্রতিহত ও দূরীভূত করার জন্য যুদ্ধ-জিহাদ-সাধনা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। প্রথম পর্যায়ের জিহাদে সাফল্য লাভে হৃদয়ে সৃষ্টি হয় ইয়াকীন বা প্রত্যয়। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের সাফল্যে মনে দৃঢ়মূল হয় সবর তথা অটল ধৈর্য।
এ প্রত্যয়-দৃঢ় ধৈর্যশীল ব্যক্তিগণই সমাজ ও জাতির নেতৃত্ব করার অধিকার লাভ তথা মানব সমাজতে হিদায়াতের পথে পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
“আমি তাদের মধ্য থেকে ইমাম বা নেতা বানিয়ে দিয়েছি সে সব লোককে যারা (লোকদের ) সঠিক পথে পরিচালনা করে থাকে আমারই হুকুম মুতাবেক; তারা এ যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয় তাদের ধৈর্য ও দৃঢ়তার গুণে এবং আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি অটল আস্থার কল্যাণে”। (সূরা আস-সাজদাহ ৩২:২৪)
এথেকে এ কথা পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কেবলমাত্র সবর ও ইয়াকীন- ধৈর্য ও দৃঢ়তা এবং আল্লাহর প্রতি প্রত্যয় ও নির্ভরতার কল্যাণেই অর্জিত হয়ে থাকে। ‘সবর’ বা ধৈর্য হৃদয়ের অশুভ বাসনা এবং গর্হিত কামনাকে প্রতিরোধ করে আর ‘ইয়াকীন’ বা প্রত্যয় শোবা-সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে হৃদয়-মনকে পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে তোলে।
জিহাদে মুনাফিকীন ও জিহাদে কুফফার
মুনাফিক তথা কপট শ্রেণী এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর চারটি। এর প্রথম স্তরে অন্তর দিয়ে, দ্বিতীয় স্তরে যবান দিয়ে, কথার মাধ্যমে, উপদেশ দিয়ে, নসীহত করে বা তিরস্কার করে, তৃতীয় স্তরে অর্থ ব্যয় করে এবং চতুর্থ স্তরে জান ও প্রাণ দিয়ে অর্থাৎ প্রকাশ্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে জিহাদ করতে হয়। হাদীসে বলা হয়েছে,
“যে ব্যক্তি জিহাদ না করে, কমপক্ষে জিহাদের বাসনা হৃদয়ে পোষণ না করে মৃত্যুবরণ করে তার মরণ হবে আংশিক কপটের মৃত্যু।” জিহাদ হিজরতের দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করে আর হিজরত এবং জিহাদের সমবায়ে ঈমান হয়ে উঠে বিশুদ্ধতর, পূর্ণতর।
চার পর্যায়ের জিহাদের তওফীক লাভ
উপরে বর্ণিত চার পর্যায়ের বর্ণিত জিহাদের সবগুলোকে তাওফীক শুধু সেসব ভাগ্যবানরাই অর্জন করতে পারে যারা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর অপার রহমাতের তীব্র আকাঙ্খা পোষণ করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেনঃ
“যেসব লোক ঈমান আনয়ন করেছে এবং যারা হিজরত করেছে আর আল্লাহর পথে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছে তারাই (প্রকৃত প্রস্তাবে) আল্লাহর রহমাতের আকাঙ্খা হৃদয়ে পোষণ করে আর আল্লাহ হচ্ছেন গাফুরুর রহীম-মার্জনাশীল, দয়াময়”। (সূরা বাকারা ২:২১৮)
জিহাদের অবশ্য কর্তব্যতা
জিহাদে নফস এবং জিহাদে শয়তান ফরযে আইন অর্থাৎ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ এবং শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রত্যেকের উপর ব্যক্তিগতভাবে ফরয অবশ্য পালনীয়। কোন ব্যক্তিই এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত নয়- প্রত্যেককেই এ দুই ধরণের জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে হবে, আর কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ- কোন সময় ফরযে আইন আর কোন সময় ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ প্রয়োজন মত লোক যদি এ জিহাদের সংগৃহীত হয়ে যায়- তাহলে অবশিষ্ট মুসলিমগণ অব্যাহতি লাভ করবে, তখন তাদের জন্য এ জিহাদ অবশ্য কর্তব্যরুপে বিবেচিত হবে না। কিন্তু এ অবস্থা যদি দেখা না যায়, সকলেই যদি অব্যাহতি লাভ করতে চায় তবে সে অবস্থায় সকলের উপরেই উক্ত জিহাদ অবশ্য কর্তব্য হয়ে উঠবে আর কর্তব্যে অবহেলার জন্য প্রত্যেককে দায়ী হতে হবে।
এই লেখাটি লিখতে যে বইটি থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছেঃ
আমাদের নাবী ﷺ ও তাঁর আদর্শ - আল্লামা ইমাম ইবনে কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ
(এই বইটি বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ 'যাদুল মা'আদ' এর সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ)
আল্লাহ তাআলা আমাদের 'হক' বুঝার তৌফিক দান করুন এবং হকের পথে প্রতিষ্ঠিত রাখতে সাহায্য করুন। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪১