শাফি ইমাম রুমী । একাত্তরের একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ।১৯৫২ সালের ২৯শে মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন ।সকল শহীদের জননী জাহানারা ইমাম এর বড় ছেলে ছিলেন তিনি ।শহীদ হয়ে তাঁর মৃত্যুর জন্য জাহানারা ইমাম শহীদ জননী উপাধি পান ।
আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রুমী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তিনি আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সুযোগ পেলেও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার জন্য তা ত্যাগ করেছিলেন ।
একত্তরের দিন গুলি বই থেকে কিছু লাইন আমাদের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে –
“আম্মা,দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত । কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে ।আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো , কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবনা । তুমি কি তাই চাও আম্মা ?”
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ।মাত্র ২২ বছরের জীবনে তার আয়ত্তে ছিল এঙ্গেলস , মার্ক্স ,মাও সেতুং , কনফুসিয়াস , লিয়ন উরিস এবং আরো অনেক জ্ঞানধর ব্যক্তিদের চিন্তাধারা ।আর পাঁচটা তরুণের মতই জীবন যাপন করলেও রুমীর মনে ছিল নিজ দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। শুধু ৭১এই নয় এর আগে থেকেই রুমীর মনে সুপ্ত বাসনা ছিল দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা ।শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর “একাত্তরের দিন গুলি” বই থেকে জানা যায় রুমীর একটা ইচ্ছে ছিল দেশের প্রশাসন ব্যবস্থায় যোগ দেবার ।
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে রুমী তাঁর মা বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন ।অবশেষে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মাকে রাজি করিয়ে ৮ই মে রুমী দুই বন্ধু মনিরুল আলম আর ইশরাক এবং কামাল লোহানী ,প্রতাপ হাজরা একত্রে যাত্রা করেন গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ।কিন্তু ধলেশ্বরী নদী পৌছনোর পর শ্রীনগর পৌছয় তখন তারা জানতে পারে আর্মি পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে সামনে ।প্রতিকুল পরিস্থিতির কারনে অনিচ্ছা স্বত্তেও ১১ই মে রুমীকে ফিরে আসতে হয় নিজ বাড়ি ।
অতঃপর ১৪ই জুন রুমী আবার সীমান্ত অতিক্রমের প্রয়াস চালিয়ে সফল হন ।ক্যাপ্টেন হায়দারের হুকুমে মতিনগর থেকে ১০/১২ মাইল পথ হেটে মেলাঘর পৌছন ।বর্ডার ক্রস করে মেলাঘর নামক এক স্থানে তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে গেরিলা ট্রেনিং নেন । এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার ।মেলাঘর ছিল এক পাহাড়ী জঙ্গুলে জায়গা ।খাওয়া দাওয়া সহ আরো নানান সমস্যায় পরতে হত সেখানকার সকলকেই ।তবুও এর মাঝেই তারা সর্বদা নিজেদের সতেজ রাখত স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্রের গান শুনে আর নাম গোপনকৃত কবিদের বিপ্লবী কবিতা পড়ে ।দেড় মাস গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার পর ৮ই আগস্ট মেলাঘর থেকে নিজ বাড়ি ফিরে আসেন রুমী ।
রুমীদের গেরিলা দলটি ঢাকায় আসে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ওড়াবার লক্ষ্যে ।কিন্তু তা তাদের জন্য দুর্ভেদ্য ছিল কড়া নিরাপত্তার দরুন ।কিন্তু তবুও তারা নিজেদের মত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে ।একরাতে কাজী , বদী ,জুয়েল এবং রুমী সহ কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন পর্যবেক্ষণ করতে যান তখন নৌকা করে কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই পাকসেনা ভর্তি এক নৌকার কবলে পরেন বদির ব্রাশ ফায়ারে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় আর কয়েকজন নদীতে ঝাপ দেয় ।২৫শে আগস্ট কাজী ,স্বপন ,বদি ও রুমী ধাওমন্ডি এলাকার ১৮ নম্বর রোডে অপারেশন চালায় । রুমীর দল গাড়ি থেকে খানসেনাদের উপর গুলি চালায় এতে ৭/৮ জন খানসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ।কিন্তু খানসেনাদের একটি জীপ তাদের পিছু নেয় তা দেখে রুমী গাড়ির পিছনের কাঁচ ভেঙ্গে পাকসেনাদের গাড়ীতে গুলি চালায় সাথে সাথে গুলি স্বপন ও বদি ।এতে পাকসেনাদের গাড়িটি উলটে যায় ।সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ১৮ নম্বর রোডে তারা অপারেশন চালায় ।।এরপর ঐ রাতেই মিরপুর রোডে পাকসেনাদের ব্যারিকেড পেরিয়ে যাবার লক্ষ্যে তারা ব্যারিকেডের আরো দুজন খানসেনাদের গুলি করে ।গাড়ি নিয়ে গ্রীন রোডের আসার সময় রুমীরা পিছনে তাকিয়ে দেখে খান সেনাদের একটা জীপ গাড়ি তাদের পিছু নিয়েছে ।তখন রুমী গাড়ির পিছনের কাঁচ ভেঙ্গে গুলি করতে থাকে আর দুপাশ থেকে স্বপন ও বদিও গুলি করতে থাকে একসময় খানসেনাদের গাড়িটি উলটে যায় । এই অপারেশনের পর রুমী তার বন্ধুদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন ।
১৯৭১ সালের ২৯শে আগস্ট রাতের বেলায় বেশ কিছু সহযোদ্ধাসহ পাকসেনাদের হাতে ধরা পরে ।পাকিস্তান হানাদাররা কোন অজ্ঞাত উৎস থেকে তথ্য পেয়ে ২৯শে আগস্ট থেকে ৩০শে আগস্টের মধ্যে আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ , জুয়েল , চুল্লু ও বদিকে ধরে নিয়ে যান ।সেই রাতে রুমীর সাথে তার বাবা শরীফ এবং ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয । জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান ।৩০শে আগস্টের পর থেকে রুমী , আজাদ , চুল্লু দের আর কোন খবর পাওয়া যায় নি ।
ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় রুমীর জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু রুমী যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছে, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা শরীফ রাজি ছিলেন না।
একাত্তরের দিন গুলি বই থেকে আমাদের চোখে পরে –
“যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে , সেই সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমী সেটা মোটেও পছন্দ করবেনা এবং রুমী তাহলে আমাদের কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে না ।বাঁকা ও ফকির অনেকভাবে শরীফকে বুঝিয়েছেন- ছেলেটার প্রাণটা আগে । রুমীর মতো এমন অসধারণ মেধাবী ছেলের প্রাণ বাঁচলে দেশেরও মঙ্গল ।কিন্তু শরীফ তবু মত দিতে পারছে না । খুনী সরকারের কাছে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে দয়াভিক্ষা করা মানেই রুমীর আদর্শকে অপমান করা, রুমীর উঁচু মাথা হেঁট করা ।”