জীবনের সব স্বপ্নগুলো কি নীল আকাশে হারিয়ে যায়?
সাদা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নকে কি স্পর্শ করা যায়না!
.
আমাদের অনেক স্বপ্ন, বিশেষ করে পেশাগত স্বপ্ন অনেকের কাছেই "ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা"র মতো! ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে দেখা স্বপ্ন সত্য তবে তা অসম্ভব কিছু নয়।
বিভিন্ন প্রতিকুলতা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শেষ অবধি নিজের স্বপ্নপূরন করেছেন এমন প্রচুর উদাহরন আছে। আমার পরিচিত অনেকে আছেন যাঁরা প্রযুক্তিবিদ হবার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, পরিস্থিতির কারনে কেউ টেক্সটাইল ইন্জিনীয়রিং, কেউ এমবিএ, আবার কেউ গনিত অথবা পদার্থ বিদ্যায় পড়াশুনা করেছেন। তবে স্বপ্নটিকে হারাতে দেননি বলেই, আজ মাইক্রোসফ্ট,গুগল, সিঙ্গুলার, ভেরাইজন, টিমোবাইলের মতো বিশ্ববিখ্যাত সব কোম্পানির ডাকসাইটে প্রযুক্তিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন!
সম্প্রতি এক ভারতীয় বন্ধুর কাছ থেকে একটি মেইল এসেছে, মেইলটি তাঁর বন্ধু পাঠিয়েছেন ভারত থেকে। একজন অসাধারন মানবের সাক্ষাৎকার সম্বলিত এই মন ছুঁয়ে যাওয়া এই মেইলটির অংশ বিশেষ নিজের মতো অনুবাদ করে পোস্ট করছি....
*******************************
একজন নরেশের কথা...
নরেশ কারুতুরা, মাদ্রাজ আইআইটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে পাশ করে গুগলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে যোগদান করেছে। ভারতে শতশত ছাত্র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে মাইক্রোসফ্ট, গুগল সহ বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত যোগদান করছে, সুতরাং এটা তেমন আহামরি কোন খবর নয়।
২১ বছর বয়সী এই তরুণ যে কারণে "বিশেষ একজন: হয়ে উঠেছেন তাহলো, সম্পূর্ণ বাবা মার সন্তান নরেশের কোমরের কাছ থেকে দুটো পা নেই!
গোদাবরী নদীর তীরে অন্ধ্রপ্রদেশের তিপাররু নামের ছোট্ট একটি গ্রামে কেটেছে নরেশের দূরন্ত শৈশব। ট্রাক ড্রাইভার বাবা আর গৃহবধু মা সম্পূর্ণ অক্ষর জ্ঞানহীন হলেও নরেশ এবং তার বোনকে বরাবর লেখাপড়ায় উৎসাহিত করেছেন এবং এর গুরুত্ব তাঁদের মনে গেঁথে দিয়েছেন। ছেলেবেলায় নরেশের বাবা নরেশকে পাঠ্যবই থেকে প্রশ্ন করতেন এবং নরেশ তার জবাব দিতেন, তিনি তখনো জানতেন না তাঁর বাবা লিখতে পড়তে জানেননা, শুধুমাত্র ছেলেকে পড়াশুনায় উৎসাহ দেবার জন্য তিনি এই কাজটি করতেন- আজকের এই অবস্থানে এসেও নরেশকে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি বিস্মীত করে! শৈশবে দূরন্ত নরেশের বন্ধুদের সাথে ছুটোছুটি আর খেলে বেড়ানো, হৈচৈ দুষ্টামিতে অতীষ্ট বাড়ির বড়রা দুপুরে বিশ্রাম করতে পারতেননা। কেউ বকতে গেলেই দৌড়ে মাঠে চলে যাওয়া, বন্যার পানিতে গ্রাম ভেসে গেলে মহিশের পিঠে বসে চাচার সাথে ঘুরে বেড়ানো, কাটাভরা গাছে উঠে ফল পেরে খাওয়া- এসব নরেশের অন্যতম প্রিয় স্মৃতি।
১৯৯৩ সালের ১১ জানুয়ারি, মা ও বোনের সাথে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে বাবার বন্ধু ট্রাক ড্রাইভারের ট্রাকে করে তাঁরা বাড়ি ফিরছিলেন। ট্রাকটিতে মানুষের ভীড় থাকায় ড্রাইভার নরেশকে নিজের কাছে দরজা ঘেঁষে বসায়, আর তাই হয়ে যায় নরেশের জীবনের কাল। নরেশ দুষ্টুমি করে দরজার লকটি পুরোপুরি বন্ধ না করে বসায় একসময় দরজা দিয়ে ছিটকে পরে বাইরে, ট্রাকের রডে তাঁর পা কেটে যায়। পায়ে সামান্য কাটা ক্ষত ছাড়া তেমন কোন ব্যাথা অনুভব করেননা তিনি।। একটি নামকরা বেসরকারী হাসপাতালের সামনে দুর্ঘটনাটি ঘটলেও সে হাসপাতাল নরেশের চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানায় "দুর্ঘটনা" বলে। সে পথে যাওয়া এক পুলিশ কন্সটেবল তাঁদের পৌঁছে দেন এক সরকারি হাসপাতালে।
নরেশের নাড়ি পেঁচিয়ে যাওয়ায় তার পেটে একটি আস্ত্রপোচার হয় সেখানে, পায়ের ক্ষতটিও ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়, সেখানে সাতদিন কাটে নরেশের। পরবর্তীতে চিকিৎসকরা যখন নরেশের পায়ে হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া পচন লক্ষ্য করেন, তাঁরা তাকে জেলা হাসপাতালে নেবার পরামর্শ দেন। সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই কোমরের নীচ থেকে নরেশের পা দুটিকে অস্ত্রপোচারের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়! জ্ঞান ফেরার পর নরেশ তাঁর মা'র কাছে প্রশ্ন করে,, "মা আমার পা দুটো কোথায়?" এমন প্রশ্নের জবাবে মা শুধুই কেঁদে যেতেন!
পা হারাবার পর নরেশের জীবনে খুব বড় কোন পরিবর্তন হয়নি কারন তিনি নিজেকে কখনো করুণার পাত্র মনে করেননি। বরং, বাড়িতে যে বাড়তি ভালোবাসা ও মনোযোগ পেয়েছেন তাই তিনি উপভোগ করেন। সবার আদর এবং ভালোবেসে দেয়া প্রচুর ফল ও বিস্কিট পেয়েই নরেশ মহাআনন্দিত :-)
ঈশ্বরে বিশ্বাসী নরেশ মনে করেন তাঁর জীবন ঈশ্বর বরাবর পরিকল্পনা করে চলেছেন। দুর্ঘটনায় পা দুটো না হারালে তাঁর বাবা হয়তো কখনো তিপাররু গ্রাম ছেড়ে তানুকু নামের শহরে বসবাস শুরু করতেননা। তানুকুতে একটি মিশনারী স্কুলে দু'ভাইবোন কে ভর্তি করে দেয়া হয়। নরেশের বোন সিরিশা তাঁর চেয়ে দু বছরের বড় হলেও ছোট ভাইকে দেখাশোনার জন্য তাঁকে নরেশের ক্লাসেই ভর্তি করা হয়। এতে সিরিশা এতো টুকু আপত্তি করেননি বরং প্রতি মুহুর্তে বুকে করে আগলে রাখতেন ভাইকে।এমন মমতাময়ী স্নেহশিল বোনের জন্য স্কুলের সবাই নরেশকে মহা ভাগ্যবান মনে করতো।
নরেশের জীবন আর দশজন ছেলের মতো স্বাভাবিক ছিলো, তিনি নিজেকে কখনো করুণা করেননি বলেই আর সবাই তাঁকে অন্যদের মতোই মনে করতো। একজন সুখি প্রাণোচ্ছল প্রতিযোগি মনোভাবাপন্ন নরেশের লক্ষ্য ছিলো শীর্ষ অবস্থান, ফলে অন্যরাও তাঁকে একজন প্রতিযোগিই মনে করতেন।
স্কুলের একজন সিনিয়র ছাত্র চৌধুরীকে দেখে নরেশ আইআইটির প্রস্তুতি নেবার উদ্দেশে "গৌতম জুনিয়র কলেজে" ভর্তি হবার পণ করেন। প্রাদেশিক পরীক্ষায় প্রধম স্থান অধিকার করায়, এবং স্কুলের অংকের শিক্ষকের সুপারিশে গৌতম কলেজ তাঁকে অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে গ্রহন করে। কলেজের বেতন ছিলো বছরে ৫০,০০০ রুপী যা ছিলো নরেশের বাবা মা'র সাধ্যাতীত।
বাড়ি ছেড়ে প্রথমবারের জন্য হোস্টেলে গিয়ে নরেশ জীবনের একটি বড় পরিবর্তন অনুভব করেন, বাড়িতে তাঁর প্রতি সকলের সর্বদা নজর ও যত্নের অভাবটি হোস্টেলে অনুভব করেন! নরেশের বাবা মা তাঁকে সব সময় সব বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন, তাঁর স্বপ্নগুলো হারিয়ে যেতে দেননি। এমনকি নরেশ কখনো খারাপ রেজাল্ট করলেও তার মাঝে তাঁরা ভালো কিছু খুঁজে বের করেছেন, আর ভালো রেজাল্ট করলে উচ্ছসিত প্রশংসায় মেতে উঠতেন।।
আইআইটি মাদ্রাজে পড়ার সুযোগ পেয়ে, সেখানে মেধাবী সব ছাত্র ছাত্রীদের সংস্পর্শে এসে নরেশ নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতেন। একজন ছাত্র এবং মানুষ হিসেবে সেখানেই তিনি তাঁর ব্যক্তি সত্ত্বা গড়ে তুলেন।
ইন্টার্ণশিপের জন্য আরো চারজন ছাত্র সহ নরেশ বোস্টনে গিয়েছিলেন, আর সেকারনে তিনি তাঁর শিক্ষক সতীর্থদের প্রতি কৃতজ্ঞ। মেধাবী ছাত্র নরেশ ইচ্ছে করেই উচ্চ শিক্ষা(পিএইচডি) গ্রহনে আগ্রহী না হয়ে জীবিকা অজর্নের প্রতি মনযোগী হোন, কারন তিনি তাঁর বাবা মাকে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল দেখতে চাইছিলেন।
বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানী মরগ্যান স্ট্যানলি নরেশকে চাকরির অফার দিলেও তিনি গুগলেরটি গ্রহন করেন।
পাড়াগাঁয়ের হতদরিদ্র অবস্থান থেকে আজকের এই অবস্থানে আসার পিছনে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মানুষের অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা আর সহযোগিতা এবং অবদান স্বীকার করেন তিনি। বন্ধুদের সাথে ট্রেনে করে যাবার পথে, এক সম্পূর্ণ অচেনা সহযাত্রী যখন জানতে পারেন নরেশ আইআইটিতে পড়ছেন, তিনি তখন তাঁর হোস্টেলের খরচটি দিতে শুরু করেন।
ক্লাস থ্রীতে পড়ার সময় হাঁটাচলার জন্য হাসপাতালে কৃত্রিম জয়পুর পা সংযোজন করা হলেও প্রচন্ড গতিতে ছুটতে চাওয়া নরেশ এই পা'য়ে তেমন স্বচ্ছন্দ বোধ করেননি। এই হাসপাতালে ভালো দিন হলো, শুধু চিকিৎসা দিয়েই তারা দায়িত্ব শেষ করেনা, পরবর্তীতে যখন খোঁজ করে নরেশ আরকোন সহযোগিতা চান কিনা! নরেশ যখন জানান, তিনি আইআইটিতে ভর্তি হয়েছেন, তাঁর আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই মুহুর্ত থেকে হাসপাতালটি তাঁর পড়াশুনার সকল ব্যয়ভার গ্রহন করে! আইআইটির জন্য কোন খরচ দিতে না হওয়ায় নরেশের বাবা মা তাঁদের মেয়েকে নার্সিং পড়ানোর সুযোগ পান।
শুধু তাই নয়, প্রধমবর্ষ শেষে ছুটিতে বাড়ি যাবার পর আইআইটি নরেশের জন্য দু দুটো সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করে তাঁকে না জানিয়ে। ছুটি শেষের আগে তাঁকে খবর পাঠানো হয়, তাঁর চলাফেরার সুবিধার জন্য নরেশের ডিপার্টমেন্টে লিফ্ট ও র্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তিনি যদি একটু আগে আগে এসে জানান যে সুবিধাগুলো যথাযথ হলো কিনা তাহলে ভালো হয়। সেখানে ফিরে যাবার পর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যন্ত্রচালিত হুইলচেয়ার কেনার জন্য ৫৫,০০০ রুপী দেয়া হয়, কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই চেয়ারটি তাঁকে কিনে দেয়নি, যাতে তা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তিতে পরিনত না হয়।
সত্যিকারের নিষ্ঠা, অধ্যাবসায় ও উদ্যোগ নিয়ে কেউ কিছু করতে চাইলে অনেকেই সাহায্যে এগিয়ে আসে বলে নরেশ বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে, এই পৃথিবীতে মন্দ লোকের চেয়ে ভালো মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।নিজের জীবনীর পাঠক পাঠিকাদের প্রতি তিনি বলেন, "I want all those who read this to feel that if Naresh can achieve something in life, you can too."
*************************************************
আমরা যেন আমাদের স্বপ্নগুলো হারিয়ে যেতে না দেই। শত প্রতিকুলতা আর প্রতিবন্ধকতার মাঝে স্বপ্নগুলো ছুয়ে বাঁচতে চেষ্টা করি যেন একদিন তা হাতের মুঠোয় চলে আসে...!