তর্ক করা বা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিতর্কিত হওয়া অপছন্দ করি। কিছু সাম্প্রতিক পোস্ট ও মন্তব্যের অবস্থা দেখে কিছু কথা..
'আমেরিকায় বসে যেসব সেকুলার মুসলিম আমেরিকার চামচামি করছেন', তাদের উদ্দেশ্য করে কিছু উপদেশ বানী পড়েছি, আমি যেহেতু আমেরিকায় বসে আছি এবং একজন মুসলিম তবে চামচামি করছি কিনা তা বুঝতে পারছিনা, কারন চামচামি বলতে কি বুঝানো হয়েছে নিশ্চিত নই! শুধু আমেরিকা কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমরা যারা প্রবাসী তাদের অধিকাংশকেই সেই দেশের সরকার হাতে পায়ে ধরে আনেননি, আগ্রহ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মক্ষেত্রে আবেদন করে, নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ভিসা নিয়ে, আরো কিছু পয়সা খরচ করে টিকেট কেটে আসতে হয়েছে। আর বড় একটি অংশ ডিভি অথবা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশের বহুপ্রতিক্ষিত ইমিগ্রেশনটি পেয়ে এসেছেন। যেসব দেশে আমরা এতো সখ করে এসেছি, সে যেটুকু সময়ের জন্যই হোক, সেসব দেশে বসে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ অথবা বিতৃষ্না ছড়াবো এমন শিক্ষা পরিবার,আমার দেশ, আমার ধর্ম আমাকে দেয়নি।
যারা একটি দেশের মাটিতে বসে সেই দেশের বিরোধিতা করে তাদের কি নামে ডাকা হয় সবাই জানেন!
আমরা যারা প্রবাসী তারা যার যার সাধ্যমতো নিজেদের উপার্জিত ভীন দেশের অর্থ নিজের দেশে পৌঁছে দিচ্ছি। সেই হিসেবে বলা যায় আমরা অন্যদেশের খেয়ে নিজের দেশের চামচামি করছি।
এখন প্রসংগ আমেরিকা... এই দেশের কিছু সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনমুখী ভূমিকা অবশ্যই নিন্দনীয়, তবে বাংলা ব্লগে বসে সেই নিন্দা প্রকাশ করা কতোটুকু যৌক্তিক! তাদের কাছে কি এই বানী পৌঁছাবে? দ্বিতীয়ত এরশাদ, খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা সরকারের চরম দুর্নিতীর জন্য অন্যদেশের মানুষ যদি আমাদের সবাইকে ঘৃণা করে কেমন হবে? আমেরিকানদের ঘৃণা করতে হবে কেন?
আজ যিনি অথবা যারা আমেরিকায় বসে চামচামির কথা বলছেন, আমেরিকার যুদ্ধের বিরোধিতায় তারা কি ভূমিকা রেখেছেন জানিনা, তবে আমেরিকার অগুনিত মানুষকে দেখেছি নিজের খেয়ে, নিজের পয়সা খরচ করে, ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় আর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন, হেনস্থা হয়েছেন, নিপিড়িত হয়েছেন, জেলে গেছেন, সম্পূর্ণ অজানা অচেনা ভীন্নধর্মী কিছু মানুষের জন্য। সেই মিছিলে বাংলাদেশী দুরের কথা, আরব অন্চল বা ইরাকের কজন ছিলেন জানিনা কারন অধিকাংশই আমেরিকান, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান।
নিক বার্গ নামের হতভাগ্য যুবককে যখন পাশবিক ভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়, সেই দুর্ভাগা মানুষটির পিতা এক বারের জন্য মুসলিম বা ইরাকি অথবা তালেবানদের দায়ী করেননি। হতভাগ্য সেই পিতা বার বার শুধু বলেছেন," আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য যুদ্ধ দায়ী, আমার দেশের সরকার দায়ী"। সেই ভদ্রলোক কিন্তু কোন মুসলিম নন, খ্রীস্টানও নন, তিনি একজন ধর্মপ্রান ইহূদী। ছেলেকে হারানোর পরও ছুটে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, যুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম, মিছিলে বা সভায় অংশ নিতে। সেই খবর পৌঁছে গেছে, এই দেশের সরকারের কাছে।
এই দেশে দেখেছি, এক জন শিশু বা নারী নির্যাতিত হলে কিভাবে সমগ্র এলাকার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন অপরাধী কে ধরিয়ে দিতে, আজানা অচেনা মানুষের জন্য অসংখ্য মানুষ পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে দিনের পর দিনের দিন কাজ করে যায় সুবিচারের জন্য। আমাদের দেশে প্রতিদিন কজন মানুষ, শিশু, নারী অন্যায় ভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন? অমরা কজন এগিয়ে গিয়েছি তাঁদের সুবিচার পাইয়ে দিতে। অন্যদের কথা না হয় বাদ ই দিলাম, এই যে কিছুদিন আগে একটি বাচ্চা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বখাটেদের অত্যাচারে, তার অপরাধ ছিলো "বোরখা" পড়া। এই যে আমাদের জিহাদী ভাই আছেন, কজন এগিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটিকে সাহায্য করতে? মেয়েটির বাবা সমাজের কাছে অনেক ভাবে সাহায্য চেয়েছিলেন বলে শুনেছি। ঠিকাছে বুঝলাম আপনি ব্যক্তিগত ভাবে তখন জানতেন না, এখন বলুন, মেয়েটির পিতা মাতা কি সুবিচার পাচ্ছেন? বখাটেরা ধরা পড়েছে? খোঁজ নিয়েছেন?
৯/১১'র ঘটনার পর, ২০০৩সালে ঈদের নামাযে গিয়ে যখন খবর পেলাম সেই এলাকার এফ.বি.আই প্রধান এসেছেন, আমাদে সবার ভ্রু কুন্চিত হলো, "অনেকে বললেন শান্তিতে ঈদের নামায ও পড়তে পারবোনা!" নামায শেষে আমাদের অবাক করে সেই এফ.বি.আই. কর্মকর্তা বললেন," আমি এসেছি আমার নাম, পরিচয় ও ঠিকানা আপনাদের জানাতে। এই আমার ফোন নাম্বার, কখনও, কোথাও কেউ যদি আপনাদের মুসলিম হিসেবে উপেক্ষা অথবা কটাক্ষ করে, আমাকে জানাবেন, কথা দিচ্ছি আপনারা সুবিচার পাবেন।" আমাদের দেশে যখন কিছু দিন আগে আহমেদিয়ারা নির্যাতিত হয়েছেন, কেউ তাঁদের দিয়েছেন এমন আশ্বাস?
ইসলাম আমার কাছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম, এই ধর্মে নারী পেয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার, এই ব্যপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। তবে আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ, আমার দেশ শ্রেষ্ঠ তা প্রমান করতে আমাকে আরেকজনের ধর্ম, আরেকজনের দেশের গলা কাটতে হবে এই মনোভাবে আমি বিশ্বাসী নই। আমরা যে শ্রেয়তর তা নিজের অবস্থানে বসেই আরেক জনকে আঘাত না করে প্রমান করা যায়। ইসলামে নারীর অধিকারের প্রশংসায় অন্য ধর্ম বা জাতি কে আঘাত না করেই অধিকারগুলো সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের কোন কোন হুজুর(সবাই নন) খুব কৌশলে ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যান, মোহরানার ব্যাপার উল্লেখ হয়না, স্ত্রীর উপার্জনে যে স্বামীর কোন দাবী নেই সেই কথাগুলো উল্লেখ নেই, অনুল্লেখ থেকে যায় তালাকে নারীর অধিকার।
আমি মনে করিনা, ভীনধর্মি মানুষদের দিকে তরবারী নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাদের ইসলামে আকৃষ্ট করা সম্ভব, তাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করেই প্রমান করা যায় ইসলামের সৌন্দর্য্য। মনে রাখতে হবে আমি মুসলিম হিসেবে আমার ধর্ম যেমন ভালোবাসি, একজন হিন্দু, খ্রীস্টান, ইহুদী নিজের ধর্মকেও তেমন ভালোবাসেন। রেড্ডিং নামের এক জন ভদ্রমহিলা যখন জীবনের ৫৫টি বছর একটি ধর্ম পালনকরে, ১৯ বছর সেই ধর্ম অন্যদের শিক্ষা দিয়ে ইসলাম ধর্মে খুঁজে পেলেন ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের শ্রেয়তর পথ, অবাক হলাম দেখে যে কিছু মুসলিম ব্যাপারটি ভালো চোখে দেখলেন না, কারন তিনি নিজেকে একই সময় খ্রীস্টান বলেও মানলেন! যিনি ২০ বছর একটি ধর্মের জাযকের কাজ করেছেন, তাঁর তো কিছুটা সময় প্রয়োজন আগের ধর্মটিকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে, তিনি যদি দুটোই মেনে চলেন, আমাদের কারো কিছু বলার অধিকার নেই। চার্চের বিশপ ব্যাপারটি অনুধাবন করে মুসলিম রেড্ডিং কে মেনে নিলেন জাযক হিসেবে, তিনি যদি মারমুখি হয়ে রেড্ডিং কে বরখাস্ত করতেন, হয়তো রেড্ডিং পরদিনই খ্রীস্টধর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতেন। আমার মনে হয়েছে, নম্রতা আর সহনশিলতা দিয়ে বিশপ খ্রীস্ট ধর্মের ভালো দিকটি তুলে ধরলেন রেড্ডিং এর সামনে যা খ্রীস্ট ধর্ম ত্যাগে রেড্ডিং কে আরেকটু ভাবিয়ে তুললো।। আগামীকাল যদি শোনা যায়, বায়তুলমোকাররম মসজিদের ইমাম সাহেব গত ১৫ মাস ধরে ইসলাম এবং খ্রীস্ট দুটো ধর্মই পালন করে এসেছেন, মারমুখি হয়ে কারা ছুটে যাবেন? "ধর্ম গেলো" রব কারা তুলবেন? মুসলিম না খ্রীস্টানরা? আমাদের মানসিকতা বড়ই অদ্ভুত!!!
সেকুলার না রক্ষনশীল জানিনা, আমি একজন মুসলিম। আমি অর্থসহ কুরান পড়েছি, আমার কখনও মনে হয়নি আমার ধর্ম আমাকে কোন ভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘৃণা করতে বলেছে! মানুষের মৃত্যুর পরও যে তিনটি কর্মের সুফল তার কাছে পৌঁছে, তার একটি হলো সদকায়ে জারিয়াহ। আল্লাহর পথে আর্থিক বা বৈষয়িক দান ছাড়াও গাছ বা বৃক্ষরোপন সদকায়ে জারিয়ার অর্ন্তভুক্ত। কারন, মৃত্যুর পরও সেই গাছের ফল, ফুল থেকে মানুষ, পশুপাখি, পোকামাকড় উপকৃত হবে। পশু পাখি, পোকামাকড়ের না হয় ধর্ম নেই, মানুষের আছে, কোথাওতো উল্লখ দেখিনি যে, সেই ফল/ফুল শুধুমাত্র মুমিনদের কাজে এলেই সদকায়ে জারিয়া হয়!!!! এই থেকে কি প্রমান হয়না আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিকে কতো ভালোবাসেন? তাহলে আমি কিভাবে ইসলামের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষদের হেয় করবো? অন্য দেশের, অন্য ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করবো? মুসলিম হিসেবে যেহেতু আল্লাহ এক বলে বিশ্বাস করি, মানুষ সে যেই ধর্মেরই হোক আল্লাহ্ র সৃষ্টি বলে মানতে হবে। ব্যাখ্যা সহ কুরান পড়ে জেনেছি হযরত মুহম্মদ (সঃ) অমুসলিমদের সাথে অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র ব্যবহার করতেন, অন্য ধর্মের মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করলে সেকুলার হতে হয়!!!!!
পক্ষ গ্রহনের প্রশ্নও উঠেছে! মজার ব্যাপার হলো, এই যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ দেশটি, এদের এই দোর্দন্ডপতাপের কারন যে অর্থনৈতিক অবস্থা তা বলা যায় অন্য একটি দেশের বিশাল লগ্নির উপর দাঁড়িয়ে। সেই একটি মাত্র দেশ যদি তাদের ট্রিলিয়ন ডলার লগ্নি ফিরিয়ে নেন, প্রায় ধ্বসে পড়বে আমেরিকা নামের এই প্রতাপশালী দেশটির মেরুদন্ড! যিনি এই পক্ষগ্রহনের প্রশ্ন এনেছেন, তাঁকে বলছি, বলুনতো সেই দেশটির নাম কি?
সম্ভব হলে এসব দেশে এসে দেখুন, যে সব আরব দেশের মানুষদের জন্য প্রান কাঁদছে, আপনার দেশের মানুষদের প্রতি, অন্যান্য মুসলিম দরিদ্র দেশের মানুষের প্রতি তাদের আচরন আর আমেরিকান, কানাডিয়ান আর ব্রিটিশদের আচরন। দাসপ্রথা এসব দেশ থেকে উঠে গেছে, তবে আরব অন্চলের কিছু মানুষ মনে হয় বেশ যত্ন করে সেই মনোভাব পুষে রেখেছেন! আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ যেহেতু সেসব দেশে মজুরের কাজে যান, সেসব দেশের মানুষ অনেকেই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মানুষদের প্রতি হীন মনোভাব পোষন করে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে কিছু ভালো ভদ্র আরবকে দেখার, দুজন ভালো বান্ধবী আছেন ঐ আন্চলের, তারা এমন নন তবে অধিকাংশ আরবের মাঝে বৈষম্য মনোভাব আছে।
ধর্ম, বর্ণ বা জাতি দেখে নয়, মানুষ দেখে মানুষকে সমর্থন দিবো। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার জন্য যেমন সাদ্দাম কে সমর্থন করিনা, সেই অপরাধের নাম ভাঙ্গিয়ে আরো হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, একটি দেশ অন্যায় ভাবে দখল ও নির্যাতন তেমন সমর্থন করিনা। একটি অন্যায় এর বিরোধিতা করতে আরেকটি অন্যায়কে সমর্থন করতে হবে কেন??
শুধুমাত্র যিনি/যারা আমেরিকা বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে আমেরিকা প্রবাসীদের চামচা বলছেন, তাদের বলছি.......
কোন তর্ক বা দোষারোপ উদ্দেশ্য নয়।
যদি এই উক্তি কোন হীনমন্যতা থেকে না হয়ে থাকে তাহলে নিজের কাছে তা প্রমান করুন। দেখুন আপনি কোনভাবে এই আমেরিকার অতিভারী পকেটটিকে আরো ভরে দিচ্ছেন কিনা। মানলাম আপনি আমেরিকান কসমেটিকস, ঔষধ, খাবার, বই বা অন্যান্য পণ্য ব্যবহার করেননা।ভেবে দেখুন, আপনি Yahoo, Google, Internet explorer, Microsoft, Intel, Dell কোন ভাবে ব্যবহার করছেন না তো? Windows media player অথবা Real player? Hotmail, Gmail বা Yahoo mail এ আপনার Account নেইতো? কারন, এসব যত ব্যবহার করছেন, এসব লিংক বা এ্যাকাউন্টে যতোবার ক্লিক করছেন ততবার কিছু বাড়তি পয়সা চলে যাচ্ছে আমেরিকা নামের এই সাম্রাজ্যবাদী দেশটির পকেটে, যা ট্যাক্সের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে সেই দেশের যুদ্ধবাজ সরকারের হাতে, কে জানে আপনার দেয়া পয়সা দিয়েই হয়তো ইরাকের শিশুর বুকে গেঁথে দেয়া বুলেটটি কেনা হয়েছে। আর, তাই যদি হয়, আমেরিকায় বসে আমি আর এই দেশের বাইরে বসে আপনি.. সবাই একই ভাবে এদের চামচামি করছি।
বি:দ্র: কোন আক্রমন, পাল্টা আক্রমন বা ঝগড়ার জন্য এই পোস্ট নয়।
আমাদের সময়