আমি সাধারণত বাংলাদেশের খেলাগুলোকে রাজনীতির উর্দ্ধে রাখার প্রান্তকর চেষ্টা করি। বিশেষত যে ক্রেকেট বাংলাদেশ নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়, মিশে দিয়েছে জাতি, বর্ণ, গোত্রকে এক ঐক্যের নিশানতলে; শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তানের নিন্দা নামক সীমাবদ্ধতার মাঝে তাই একে বেঁধে রাখতে নারাজ। তাছাড়া যেসব কারনে আমরা কেউ পাকিস্তান আবার কেউ ভারতকে সমর্থনের বিরোধীতা করছি, ঠিক সেই কারণটিতো ইংল্যান্ডের বেলায় প্রযোজ্য হওয়ার কথা। তাহলে এখন কি আমরা এই দাবী তুলবো যে, ইউরোপের শিল্প বিপ্লোত্তর সকল সম্পদ এই উপমহাদেশ, বিশেষত বাংলাদেশেরই প্রাপ্য। সুতরাং এসব সম্পদ আমাদের ফেরত দেয়া হোক!
বাংলাদেশের খেলার সময় ভারত-পাকিস্তান বিষয়ক যে দেশপ্রেম আমাদের মাঝে বাসা বাঁধে, সেটিকে রাজনৈতিক সংকীর্ণতাই মনেকরি। এটি কখনোই আমাদের জাতিহ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না। দেশপ্রেম কেবল খেলায় ভারত-পাকিস্তানের বিরোধীতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি আমরা সেটিকে আমাদের দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সার্বভৌমত্ত্ব এবং আমাদের নিজস্ব পণ্যের প্রতি হয়; তবে সেটিকেই দেশপ্রেমের সত্যিকার জাগ্রত চেতনা বলতে হবে।
বর্তমানে পাকিস্তান-ভারতকে নিয়ে দেশপ্রেমকে ঠুনকো মানসিকতা ও ছেলে ভুলানো ফ্যাশন বলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না, যখন দেখি মুখে দেশপ্রেম আর কাজে দেশের সর্বনাশ করার চেষ্টায় রত হতে।
গত বৃহস্পতিবার বন্ধুরা মিলে কাপ্তাই যাওয়ার পথে ভারত-পাকিস্তানের বিষয়টি উঠে এলে আমাদের দুইজন বন্ধু এ বিষয়ে বেশ গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়ার মত বক্তব্য উপস্থাপন করল। এক পর্যায়ে তাদের একজন বলল ‘এখন থেকে যে ভারত কিংবা পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে সে আস্তা মা***দ।’ ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু না শেষ হয়নি।
আমারা সেই সকাল আটটায় রওয়ানা দেয়ার পর থেকেই আমাদের মাইক্রোটিতে একাধারে হিন্দি গান চলে আসছিল। বিরক্তির শেষ শিখরে পৌছানোর পর আমি অনুরোধ করলাম হিন্দি বাদ দিয়ে বাংলা চালাতে। কিন্তু তখন ঐ দুই বন্ধুর আরেকজন বলে উঠলো মামুন ভাই, এমন জার্নিতে চার-ছক্কা হৈহৈহৈ গান না হলে চলে না। যেহেতু বাংলায় এমন গান নাই, সেহুতু হিন্দিই বেটার দেন বেস্ট। কি আর করার! চুপ করে থেকে কান ফাটানো হিন্দি শোনা ছাড়া উপায় ছিল না। এক পর্যায়ে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের ফেবারিট ছবি কোনটি। সবাই মোটামুটি ইংলিশ কিংবা হিন্দি বললেও আমার মত অবাগা যে, বাংলাকে ভালবাসে, তার মত কাউকে পাওয়া যায়নি প্রথমে। অবশ্য পরে যখন বললাম, আমার প্রিয় চলচ্চিত্র হল, “মরনের পরে” নামক বাংলা চিনেমাটি। তখন কয়েকজন বলল, হ্যা ওটা দেখেছি। ভাল লেগেছে।
অনেকে হয়তো আমার হিন্দি বিরোধিতাকে ভারত বিদ্বেষিতাকে ভাববেন। হ্যাঁ ভাবতে পারেন, সমস্যা নেই। কারন এই হিন্দি সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্রতাকে কুড়ে কুড়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। পাকিস্তানি সেই হায়েনারা অস্ত দিয়ে আমাদের যেই মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে পারেনি, সেই মুখের ভাষা দিনদিন আমাদের থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সংস্কৃতি বিশেষ করে হিন্দি আজ আমাদের ৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ বিশেষ করে তরুণ-তরুনীদের মুখের স্বাভাবিক ভাষা। ওদের মুখে যন হিন্দি শুনি তখন, বুকটা ফেটে চৌচির হয় সালাম, রফিক, বরকতদের জন্য।
শেষকথা বলতে চাই, আমাদের দেশপ্রেম খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব কর্মপন্ধায় সম্পাদ করি। আমি যেমন ভারতের সংস্কৃতি পরিহার করে চলার চেষ্টা করি, তেমনি পাকিস্তানি পণ্যগুলোকে ব্যবহার না করে চলার চেষ্টা করি। তাই আসুন, খুব বেশি প্রয়োজন নয়, এমন পাকিস্তানি ও ভারতীয় পণ্য বর্জন করার চেষ্টা করি। আর এরমাধ্যমেই হবে আমাদের দেশপ্রেমের প্রকৃত চেতনা। মাঠে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গিত আর পতাকা ওড়ানোর বিরোধীতা করার মধ্যে কোন বীরত্ব আমি দেখি না