somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এদেশের সাংবাদিকতার উজ্জল নক্ষত্র

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঃ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, বাংলায় গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত, নির্ভীক সাংবাদিক ও আধুনিক বাংলা সংবাদপত্রের রূপকার। প্রবাদ প্রতিম এই সাংবাদিক নিজের স¤পাদনায় দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার সাংবাদিকতাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং হতাশা-বেদনাকে সহজ-সরল অথচ বলিষ্ঠ ভাষায় তুলে ধরার যাদুকরী ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনকল্যাণে নিজেকে সঁপে দিয়ে আমৃত্যু তিনি নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি, রঙ্গমঞ্চ, ও রাজনৈতিক মঞ্চ ইত্যাদি নামের কলামে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে তিনি বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণকে উজ্জীবিত করে তোলেন। নীতির প্রশ্নে আমৃত্যু আপোষহীন ও প্রতিষ্ঠানতূল্য এই মানুষ মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও ছিলেন অবিচল। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তাঁর সেই সংগ্রামী জীবনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

জন্ম ঃ
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলা জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মুসলেম উদ্দিন মিয়া।

শৈশবকালঃ
শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। কিন্তু পরিবারের সকলের ¯েœহে তিনি সেই অভাব কখনোই অনুভব করেননি। কচা নদীর তীরের গ্রাম ভেন্ডারিয়া। নদীর সাথে সরাসরি যোগ সাগরের। সেই নদী আর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতোই অসম সাহস নিয়ে বেড়ে ওঠেন মানিক মিয়া।



শিক্ষাজীবন ঃ
নিজ গ্রামের পূর্ব ভান্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ভর্তি হন ভেন্ডারিয়া হাই স্কুলে। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তখন থেকেই তিনি ছিলেন সহচর-সহপাঠীদের কাছে ক্ষুদে নেতা। ‘উঠন্ত মূল পত্তনেই চেনা যায়’-এই প্রবাদ বাক্যটি যেন মানিক মিয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সত্য। ভান্ডারিয়া স্কুলে মানিক মিয়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর চলে যান পিরোজপুর সরকারী হাই স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশন সহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন ঃ
পড়াশোনা শেষ করে তিনি পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে চাকরি জীবন শুরু করেন মানিক মিয়া। সেখানে চাকুরীকালীন সময়ে জনৈক মুন্সেফ একদিন তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করেন। তিনি এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে চাকুরি ছেড়ে দেন। এ চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগ দান করেন তদানীন্তন বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে বরিশাল জেলার সংযোগ অফিসার হিসেবে। কিছুদিন পর সে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন।

সাংবাদিক জীবন ঃ
আওয়ামী মুসলিম লীগের দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে একটি প্রচারপত্রের প্রয়োজন ছিলো এবং সেই চিন্তা থেকেই মানিক মিয়ার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমেদের সম্পাদনায় বের হয় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে 'দৈনিক ইত্তেহাদ'-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন তিনি।
১৯৪৯ সালে মুসলীম লীগের বিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। একই বছরে এই রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে সাপ্তাহিক দৈনিক ইত্তেফাক-এর। আবদুল হামিদ খান ভাসানী পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে মানিক মিয়া এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর স¤পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাকে রূপান্তরিত হয়। সূচনালঘœ থেকে আমৃত্যু তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ইত্তেফাকের রাজনৈতিক হালচাল ও পরবর্তী সময়ে মঞ্চে নেপথ্যে কলামে ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। ১৯৬৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের পাকিস্তান শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

দৈনিক ইত্তেফাক চড়াই-উতড়াই ফেরিয়েঃ
১৯৫৩ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ শুরু করার পর এটি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এটির কারনে বিভিন্ন সময়ে মানিক মিয়াকে কারাবরণ করতে হয়েছিল আবার সরকারের বিরাগবাজন হয়ে পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একধিকবার। ১৯৫৮ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হটিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে নিলে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয় এবং পত্রিকাটির চাপাখানা ‘নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ‘ঢাকা টাইমস’ ও ‘পূর্বাণী’ বন্ধ হয়ে যায়। গণআন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। অবশ্য ততদিনে ৬৯’এর গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আইয়ুব খুনের পতন হয়ে গেছে। ফলে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্র“য়ারী পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়।

রাজনৈতিক জীবন ঃ
বরিশাল জেলায় চাকরি করার সময় মানিক মিয়া একবার তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। পরিচয়ের সূত্র ধরেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে তিনি বরিশাল জেলা সংযোগ কর্মকর্তার চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় চলে যান। সেখানে সোহরাওয়ার্দী মানিক মিয়াকে কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেন। মানিক মিয়া কলকাতায় গিয়ে বেশ ভালভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
এই সময়টি ছিল মানিক মিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়েই তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী নেতৃবৃন্দের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান। আগে থেকেই তিনি নিজে যেহেতু ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন ফলে কর্মক্ষেত্রে তিনি বেশ সফলতার সাথে কাজ চালিয়ে যান। তিনি যেহেতু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বিশেষ ¯েœহধন্য, ফলে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব মানিক মিয়ার উপর থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। বস্তুত কলকাতায় মানিক মিয়া সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু'টি আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তানের দুই অংশ-পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান ছিল বারোশ মাইলের। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন এ নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। মুখ্য মন্ত্রীত্বের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হেরে যান। মানিক মিয়া তখন সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। ফলে তাঁর প্রতিপক্ষরা এতে মানিক মিয়ার প্রতি বিরাগ হন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারির পদটি ছেড়ে দেন। যোগ দেন ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে। ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর সাথে মানিক মিয়া মাত্র দেড় বছরের মতো যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে সৃষ্ট দাঙ্গা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিরোধে স্থাপিত দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির প্রথম সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

জেল জীবন ঃ
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে একাধিকবার কারা বরণ করেছেন। তাঁর আপোষহীন ও ক্ষুরধার লেখনীর কারনেই মূলত তাঁকে এমন নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। এরপর দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের উপর চালানো হয় চরম নিপীড়ন। একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর তিনি মুক্তি পান।
এরপর দ্বিতীয়বার ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলে সারা পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রতিবাদের ঢেউ উঠে তার প্রেক্ষিতে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সেইসময় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ছয় দফাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। আইয়ুব শাহীর চরমনীতি আরো স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তিনি ছয় দফা যারা তৈরি করেছেন তাঁদের এবং এর প্রচারকারীদের মূলোৎপাটন করার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করা শুরু করেন। সেই সময় মানিক মিয়াকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘নিউ নেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত ও তার আরো দু'টি পত্রিকা বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। অথচ পাকিস্তান সরকার যখন এই ঘটনাটি ঘটায় তখন মানিক মিয়া ছিলেন প্রেস কোর্ট অব অনার-এর প্রথম সেক্রেটারি।



মানিক মিয়া বনাম মোনেম খাঁন ঃ
১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি দিকের ঘটনা। পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আইয়ুব খান তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এদেশে তাঁর খাস চেলা ছিল মোনায়েম খাঁ। মানিক মিয়ার পত্রিকায় যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের খবর থাকে ফলে এই দু’জনই নাখোশ ছিলেন তাঁর উপর। তখন বাঙালিদের সবচেয়ে প্রিয় কাগজ ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু মানিক মিয়ার তাতে ধমাবার পাত্র নন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক নিয়ে যেমন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন ঠিক তেমনি পত্রিকা ছাড়াও বেশ ভালভাবেই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরমধ্যেই একদিন মোনেম খাঁ ঘোষণা দেন, মানিক মিয়াকে ঢাকা শহরে খড়ম পা দিয়ে হাটিয়ে তবেই ছাড়বেন। উত্তেজিত না হয়ে তিনি মোনেম খাঁকে এর জবাবে বললেন, খড়ম পায়ে হাঁটা তার বরাবরের অভ্যাস। সুতরাং জুতা ছাড়া খড়ম পায়ে হাঁটতে একটুও খারাপ লাগবে না। তিনি ভাবলেন, মূল্যবোধের লড়াইয়ে আইয়ুব খান আর মোনেম খাঁকে বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেওয়া হবে না। তাতে জীবন যায় যাবে। সেবারের এই লড়াইটা ছিল সত্যিকার অর্থেই মানিক মিয়ার জন্য বাঁচা-মরার লড়াই।

বিগ্রেডিয়ার প্রকল্প ঃ
মানিক মিয়াকে বশ করতে না পেরে আইয়ুব খান এবার ভিন্ন পথ নিলেন। মানিক মিয়ার পেছনে লাগিয়ে দিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক জাঁদরেল ব্রিগেডিয়ারকে। সেই ব্রিগেডিয়ার নানা কায়দা-কসরত করে মানিক মিয়াকে নিয়ে গেলেন ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে ব্রিগেডিয়ারের অতিথি হিসেবে মানিক মিয়াকে রাজার হালে চলল আদর-আপ্যায়ন। শেষে ব্রিগেডিয়ার মানিক মিয়াকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়ার মতলব খোলাসা করেন। ব্রিগেডিয়ার সাহেব মানিক মিয়ার কাছে প্রস্তাব করেন, তিনি যেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সাথে একটিবার দেখা করেন এবং ইত্তেফাকের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলেন। আইয়ুব খান রাজি হয়েই আছেন, শুধু মানিক মিয়া একটু দেখা করলেই হয়। এই প্রস্তাব শুনে মানিক মিয়া ইংরেজি ভাষার সর্বোচ্চ শ্ল্যাংটি ব্যবহার করে ব্রিগেডিয়ারকে ‘ফ্রিজ’ করে দেন। আইয়ুব খানের সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার ‘ব্রিগেডিয়ার প্রকল্প’ এখানেই শেষ হয়ে যায়।

প্রকাশিত গ্রন্থ ঃ
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর’। এটি ১৯৮৮ সালে ইত্তেফাক পাবলিকেশন্স থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।


কেবল একটি গ্রন্থই নয়, যেন একটি কালজয়ী ইতিহাস

মৃত্যু ঃ
১৯৬৬ সালে তৃতীয় দফা গ্রেফতারের প্রায় দশমাস কারাগারে আটক থাকার পর অসুস্থ অবস্থায় মানিক মিয়াকে ঢাকা পুলিশ হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পেলেও মানিক মিয়া আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তারওপর দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অবসর কোথায় বিশ্রামের। এরমধ্যে গণ-অভ্যুত্থান ও বন্ধ পত্রিকাগুলো প্রকাশে আত্মনিয়োগ করেন এবং সফল হন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর মানিক মিয়া কিছুটা ক্লান্ত, তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৬৯ সালে ২৬ মে এই ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কাজে রাওয়ালপিন্ডি যান। সেখানেই ১ জুন রাতে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

পারিবারিক অবস্থা ঃ
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পিরোজপুর সিভিল কোর্টে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৩৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার অন্তর্গত গোয়ালদি গ্রামের অভিজাত পরিবারের মরহুম খোন্দকার আবুল হাসান সাহেবের কন্যা মাজেদা বেগমের সাথে বিাবহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর এক ছেলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু রাজনীতিবিদ ও দৈনিক ইত্তেফাক এর প্রকাশক আর অন্য ছেলে ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন খ্যাতনামা আইনজীবি ও বাংলাদেশের নির্বাচনকালিন তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।


কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে মানিক মিয়ার ঢাকাস্থ বাড়িটি

শেষ কথা ঃ
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক মানুষ হলেও রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ তাঁর ছিল না। সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির পথ রচনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি বারবার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন। ইত্তেফাকের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছিল দফায় দফায়। তবু কিছুতেই মাথা নোয়াতে রাজি হননি মানিক মিয়া। সেদিনের সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার যে নির্ভীক ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন, ইতিহাসে তা এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। শোষণ-বঞ্চনা, ও রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে মানিক মিয়ার কলম ছিল সদা সোচ্চার। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসনামলে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে উপজীব্য করে তিনি যেসব সাহসী লেখা লিখেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তাঁর সেসব লেখনী আজকের দিনেও প্রায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

তথ্যসূত্র ঃ

১। উইকেপিডিয়া
২। বাংলাপিডিয়া
৩। বিভিন্ন ওয়েবসাইট
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×