আওয়ামী লীগের আগের সরকারের আমলে যে কটি জেলা সন্ত্রাসের জনপদ নামে পরিচিত ছিল, লক্ষ্মীপুর তার অন্যতম। আর এ ‘সুখ্যাতির’ মূল হোতা ছিলেন আবু তাহের ও তাঁর স্বনামধন্য ছেলেরা। পৃথিবীর অনেক নামী রাজনীতিকেরা ছেলেদের কারণে সুনামের ভাগীদার হন, আবার অনেকে তাঁদের অপকীর্তির কারণে বদনাম কুড়ান। সৎ পিতার অসৎ পুত্র, অসৎ পিতার সৎ পুত্র থাকার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। কিন্তু বাবা ও ছেলের মিলিত দুষ্কর্মের নজির কমই আছে। লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহের এবং তাঁর একাধিক ছেলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে।
অবশ্য লক্ষ্মীপুরের ‘সুখ্যাত’ এই বাবা ও ছেলের জন্য আমরা উদ্বিগ্ন নই। মানুষ যতই সমালোচনা ও প্রতিবাদ করুক না কেন, তাঁদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। কেননা, তাঁরা এটাকে অন্যায়ই মনে করেন না। সরকারেরও অনেকে মনে করেন, আবু তাহের ও তাঁর ছেলেরা ঠিকই করেছেন। না হলে সরকার তিন তিনটি হত্যা মামলার আসামির দণ্ড মওকুফের জন্য ধরনা দিত না।
আমরা উদ্বিগ্ন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমাশীলতা নিয়ে। এভাবে তিনি কতজন খুনিকে ক্ষমা করবেন? তাঁর ক্ষমার মহিমা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশের কারাগারগুলো শূন্য হয়ে যাবে। যে কেউ মানুষ খুন করে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন!
কিন্তু এর একটি বিপজ্জনক দিক আছে। রাষ্ট্রপতি যেহেতু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের রাষ্ট্রপতি। তিনি আমাদের জাতীয় ঐক্য ও মর্যাদার প্রতীক। তিনি কারও প্রতি বৈষম্য করতে পারেন না। তিন খুনের আসামি এইচ এম বিপ্লব রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে দণ্ড মওকুফ করাতে পারলে অন্যরা কেন সেই সুযোগ পাবেন না? দেশের সব নাগরিক তাঁর কাছে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। লক্ষ্মীপুরে আবু তাহেরের ছেলের প্রতি তিনি যেভাবে ক্ষমাশীল হয়ে উঠেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, এ পদে যত দিন আছেন, তত দিন ক্ষমার আবেদনপত্রে তাঁকে সই করে যেতে হবে। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় তাঁকে দিয়ে সেটিই করিয়ে নেবে। এর আগে আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায়ও সরকার রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রহিত করিয়ে নিয়েছিল।
বিএনপি সরকারের আমলে আরেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিন্টুকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তখন আওয়ামী লীগ ‘বজ্রকণ্ঠে’ সেই ক্ষমার সমালোচনা করেছিল। এখন বিএনপিও সমালোচনা করছে। এর অর্থ কি আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগের খুনিরা ও বিএনপি আমলে বিএনপির খুনিরা দণ্ড থেকে রেহাই পাবেন আর অসহায় জনগণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে! এ ব্যাপারে আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য জানতে চাই। অন্যায়ের শাস্তি নিশ্চিত করা কি মানবাধিকার নয়?
আবু তাহেরের ছেলে এইচ এম বিপ্লবের বিরুদ্ধে যেসব খুনের অভিযোগ, সেগুলো গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত হলেও বিচারকাজ শেষ হয়েছে পরবর্তী বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ সরকার সেই বিচার নিয়ে প্রশ্ন করতে পারত। বিপ্লব ন্যায়বিচার পাননি বলে আপিল করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে এখন সরকার আবু তাহেরের ছেলের দণ্ড মওকুফ করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল! সরকারের উচিত ছিল বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, তার প্রতিকার চাওয়া।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এইচ এম বিপ্লব ১০ বছর পলাতক জীবন যাপন করেছেন। দল ও দেশের জন্য নিশ্চয়ই এই ত্যাগ স্বীকার! সে ক্ষেত্রে তাঁর উচিত ছিল সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা। কিন্তু তা না করে ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে তাহেরের এই গুণধর পুত্র স্বীকার করে নিলেন বিএনপি-জামায়াত আমলে তাঁর বিরুদ্ধে অধস্তন আদালতে যে রায় হয়েছে, তা সঠিকই ছিল। আদালতের রায় মেনেই তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। এর মাধ্যমে বিপ্লব নিজে বেঁচে গেলেও সরকারকে বিপদে ফেলেছেন। সরকার এত দিন বলে আসছিল, বিএনপি আমলে আইনকানুন ও আদালত-বিচার বলতে কিছু ছিল না। এ ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে সরকারও বিপ্লবের অপরাধ স্বীকার করে নিল। মানুষ কখন ক্ষমা চায়? অপরাধ করার পর। বিপ্লব যদি অপরাধই না করবেন তাহলে সরকার কেন তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করল? এর মাধ্যমে বিপ্লবের দণ্ড রহিত বা হ্রাস পেলেও নৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে। তারা স্বীকার করে নিয়েছে, বিএনপি আমলে অন্তত এ তিনটি মামলার ন্যায়বিচার হয়েছে। আদালত ন্যায়সংগতভাবেই বিপ্লবকে শাস্তি দিয়েছেন।
পৃথিবীতে বিনা দোষেও অনেকের ফাঁসি হয়। আবার সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ ও জাতির শত্রুকে হত্যা করেও ক্ষুদিরামের মতো অনেকে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ নেতার ‘বিপ্লব’ নামের এ সন্তানটি কেন সেটি নিতে পারলেন না? বিপ্লব যদি মনে করেন, তিনি যাঁদের হত্যা করেছেন, তাঁরা দেশ ও জাতির শত্রু, মানবতার শত্রু, তাহলে কেন ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন? তা-ও একবার নয়। তিন-তিনবার।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা নুরুল ইসলামকে যদি আবু তাহের ও তাঁর ছেলেরা দেশ ও জাতির শত্রুই মনে করেন, তাহলে তাঁরা তাঁকে হত্যা করে সাচ্চা দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই ‘দেশদ্রোহী’ হত্যার কারণে যদি ফাঁসি হয়, হাসিমুখে বরণ করে নেওয়াই তো প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবীর কর্তব্য ছিল। কিন্তু বিপ্লব এখানে এসে কেন থেমে গেলেন? তাহলে কি তাঁর মধ্যে পাপবোধ কাজ করছে?
বিপ্লব একই সঙ্গে নুরুল ইসলাম, কামাল ও মহসিন হত্যা মামলার দণ্ডিত আসামি। তাঁদের মধ্যে নুরুল ইসলাম ছিলেন বিএনপির স্থানীয় নেতা ও আইনজীবী, কামাল বিএনপির কর্মী ও এ এস মহসিন শিবিরকর্মী। নুরুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ কীভাবে টুকরা টুকরা করা হয়েছিল, তা সে সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আর কামালউদ্দিনকে নিজের বাড়িতে মা-বাবার সামনে হত্যা করা হয়। এ মামলায় বিপ্লবের বাবা, ভাইয়েরাও আসামি ছিলেন। সে ক্ষেত্রে এটিকে পরিকল্পিত ‘পারিবারিক বিপ্লব’ বলেও অভিহিত করা যায়। আজ এ বিপ্লবের ‘সূর্যসন্তান’ কেন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইলেন? বিপ্লব কি তবে তাঁর ‘বিপ্লবী আদর্শ’ থেকে বিচ্যুত হলেন?
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা নিহত বিএনপির কর্মী কামালউদ্দিনের মা-বাবাকে এতটাই বিচলিত করেছে যে তাঁরা প্রতিক্রিয়া জানাতেও ভয় পাচ্ছেন। কামালউদ্দিনের মা বলেছেন, ‘বাবা, আমাদের নিরিবিলি থাকতে দাও। আর ঝামেলায় পড়তে চাই না।’ কামালের বাবা বলেছেন, ‘দুনিয়ায় পেলাম না। দেখি আল্লাহর আদালতে বিচার পাই কি না? এটা নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না।’
প্রধানমন্ত্রী একজন মা। তিনি কি নিহত কামালের মায়ের আর্তি শুনতে পাচ্ছেন না? রাষ্ট্রপতি কেবল দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নন, একজন বাবাও। তিনি কি কামালের বাবার এ ফরিয়াদ শুনতে পাচ্ছেন না?
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনি জানেন, ২১ আগস্টের ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন (যার মধ্যে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমানও আছেন)। ইতিহাসের জঘন্যতম এ হত্যার বিচারের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামি যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন, তাহলে আপনি কি তাঁকেও ক্ষমা করে দেবেন
Source