প্রতি বছর মে মাস এলেই ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয় শ্রমিকের তথা শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের কথা। পয়লা মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।’ মে দিবস এলেই শ্রমিকশ্রেণীর রক্তঝরা সংগ্রাম আর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সভা-সেমিনার, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং রাজ পথের মিছিল-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা দুনিয়ার শহর-নগর-বন্দর। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নিউইয়র্ক-ব্রাসেলসের আধুনিক প্রলেতারিয়েতদের বর্ণাঢ্য র্যালির পাশাপাশি বাংলাদেশের আধুনিক শ্রমিক নামের ‘শ্রমদাস’রাও গতানুগতিক শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে ঢাকার রাজপথ। পশ্চিমা দুনিয়ার “শ্রমজীবী বুর্জোয়া ” (?), আর বাংলাদেশের শ্রমজীবী নিম্নবিত্তদের মধ্যে মিল যেমন রয়েছে তেমন শ্রেণীগত অবস্থানের বৈপরীত্যও কম নয়।
আজ থেকে ১২৩ বছর আগে ১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের “হে মার্কেটের” শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কর্মদিবস ও নূন্যতম মজুরির দাবিতে সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়েছিল। শিকাগোর সুতাকলের শ্রমিকরা বুকের রক্ত দিয়ে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস আদায় করে নিয়েছিল। তাদের রক্তঝরা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সারাবিশ্বে শ্রমজীবী জনগণ সেদিন শ্লোগানের জন্ম দিয়েছিল “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। কিন্তু দীর্ঘ ১২৩ বছরের ব্যবধানে আমাজান-মিসিসিপি আর পদ্মা-মেঘনার অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। আজকের সাম্রাজ্যবাদ্বী বিশ্বব্যবস্থায় আমেরিকার করাখানা শ্রমিক ‘হ্যারিম্যান’দের জন্য ‘মজদুর’ সংজ্ঞাটি সম্ভবত বেমানান। কারণ হ্যারিম্যানরা আজ মাসে মজুরি পান বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকারও বেশি। শিকাগো সিটির কোনো সুরম্য অট্টালিকায় সম্ভবত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে তার বসবাস।
এদিকে বাংলাদেশের সাধারণ শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাস্তার ধারে দিনমান সেই যে খোয়া ভাঙছে তো ভেঙেই চলেছে। সারাদিন খোয়া ভেঙে যা মজুরি পেয়েছে, তা দিয়ে এই দূর্মূল্যের বাজারে সারাদিনের চাল-ডাল-নূন জোগাড় করাই দুঃসাধ্য। বাংলাদেশের লাখ লাখ গার্মেণ্টস শ্রমিক, যারা আজো মাসে অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত মজুরির বিনিময়ে ১৪ ঘণ্টা শ্রম দেয় তাদের কাছে ঊনিশ শতকের মে দিবসের বিজয় আজ একুশ শতকে এসেও এক নিদারুণ প্রহসন বলে মনে হয়। হে মার্কেটের শ্রমিক আর বাংলাদেশের শ্রমিক একুশ শতকের এই দুই মেরুর দুই শ্রমিকের আজ “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগানও বেমানান, বলতে গেলে প্রহসন।
পশ্চিম ও পূর্বের মাঝে পর্বত প্রমাণ অসম বিকাশের যুগে বাংলাদেশে আরো অনেক প্রহসন লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে কথিত ‘শ্রেণীসংগ্রাম’- এর প্রবক্তাদের তত্ত্ব মোতাবেক একদিকে সাম্রাজ্যবাদ্বীদের উচ্ছিষ্টভোগী লুটেরাগোষ্ঠী আজ আধুনিক বুর্জোয়ার আসনে সমাসীন, অন্যদিকে ১৪ ঘণ্টা মজুরি খাটা ‘ক্রীতদাসরা’ আধুনিক প্রলেতারিয়েতের আসনে সমাসীন। অতএব তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান সমাজস্তরে এই ‘বুর্জোয়া’দের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীসংগ্রামই নাকি মুক্তির একমাত্র পথ। কিন্তু আমরা যখন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হই, তখন দেখতে পাই, বর্তমান সম্রাজ্যবাদ্বী ও সম্প্রসারণবাদ্বী যুগে চিরায়ত শ্রেণীসংগ্রামের আবেদন ফিকে হয়ে গেছে।
১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকায় শিকাগো শহরের আগস্ট স্পাইস, পারসন্স, অ্যাঞ্জেল ও ফিশারের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারিত রয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ী ওইসব শ্রমিকের আত্মত্যাগের ফল ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলো পেলেও আমাদের দেশ আজো শ্রমিক-কর্মচারী নির্যাতন চলছে নানাভাবে। আমাদের দেশে সরকারি চাকরি বাদে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করিয়ে নেয়া হয়। মজুরি কমিশন, শ্রম আইন, শ্রমনীতিসহ হাজারো আইন-কানুন, বিধিনিষেধ থাকলেও নেই তার বাস্তবায়ন। আমাদের দেশ গরীব। এখানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ লাখেরও বেশি। এটাই মালিকপক্ষের নির্যাতনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। কারণ পুরনো একজন কর্মচারীকে যে বেতন দিতে হয়, নতুন কর্মচারীকে তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করিয়ে অল্প পয়সায় ‘বুঝ’ দেয়া যায়। ১২, ১৪ আর ১৫ ঘণ্টা বলে কথা নেই, যতক্ষণ কাজ থাকবে ততক্ষণ নাকি করতে হবে। কিন্তু এ জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয় খুব কম ক্ষেত্রেই। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে জীবন দেয়া যেসব শ্রমিকের স্মরণে প্রতি বছর দুনিয়াজুড়ে পালন করা হয় ‘মে দিবস’ তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন আজো হয় নি। দীর্ঘ ১২৩ বছরে শ্রমিকের অধিকার কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই গেছে। নানা শোষণ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে এখনো তাদের দিন কাটে। শিল্পকারখানা, গার্মেণ্টস, নির্মাণকাজ, স্বর্ণশিল্পসহ অসংখ্য উৎপাদনমুখী কাজে জড়িত রয়েছে লাখো-কোটি শ্রমিক। তাদের কষ্টসাধ্য শ্রমের বিনিময়েই সচল রয়েছে বিশ্বের অর্থনীতির চাকা।
কিন্তু সারা বিশ্বেই শ্রমিকরা নানামুখী বঞ্চনা ও শোষণের শিকার। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে শ্রমিকদের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। উন্নয়শীল দেশগুলোতে তাই শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা খুব ভালো নয়। অশিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, শোষণ, চাকরির অনিশ্চয়তা এমন অসংখ্য কারণে শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরও পরিবারের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে পারেন না। আধুনিক, উন্নত জীবনযাত্রার কোনো ছোঁয়া নেই তাদের জীবনে। অর্থের অভাবে সন্তানরা বঞ্চিত হয় শিক্ষা থেকে। কেউ কেউ নিয়োজিত হয় শিশুশ্রমে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা হচ্ছেন বঞ্চনা ও শোষণের শিকার।
বাংলাদেশের শ্রমিক : একটি পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৪ কোটি ৪৪ লাখ প্রায়। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমিক ৩ কোটি ৪৫ লাখ আর মহিলা শ্রমিক ৯৯ হাজার প্রায়। কৃষি, বন ও এ সম্পর্কিত কাজে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটি ১৯ লাখ প্রায়। মৎস্য শিল্পে ১০ লাখ ৫০ হাজার। খনিজ দ্রব্যের কাজে নিয়োজিত ৮২ হাজার। উৎপাদনসামগ্রী প্রস্তুত কাজে নিয়োজিত ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির কাজে নিয়োজিত ১ লাখ শ্রমিক। নির্মাণসামগ্রীর সাথে জড়িত শ্রমিকরে সংখ্যা ১৫ লাখ ৫০ হাজার। পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায় ৬১ লাখ ২০ হাজার, হাসপাতাল ও রেস্তোঁরায় ৫৬ লাখ ১৫ হাজার, যোগোযাগ ব্যবস্থার সাথে জড়িত ৩০ লাখ ২৫ হাজার, ব্যাংক, বীমা সংক্রান্ত কাজে ২ লাখ ৩০ হাজার, রিয়েল এস্টেট, গাড়ি ও ব্যবসায় নিয়োজিত শ্রমিকরে সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার, গণপ্রশাসনে ১০ লাখ, শিক্ষা সার্ভিসে ১২ লাখ স্বাস্থ্য ও সামাজিক কর্মকান্ডে ৫০ লাখ ১৫ হাজার, এবং স্বউদ্যোগে নির্মিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৭৫ হাজার। শ্রম মন্ত্রণালয়ের ২০০২-২০০৩ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫-১৭ বছরের মোট শিশু ৪ কোটি ২৩ লাখ ৬৭ হাজার। এর মধ্যে শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৭৪ লাখ ২৩ হাজার। অর্থাৎ মোট শিশুর ১৭.৫ শতাংশ শিশুশ্রমে জড়িত। এর মধ্যে ছেলেশিশু ৫৪ লাখ ৭১ হাজার আর মেয়েশিশু ১৯ লাখ ৫২ হাজার। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে ৫৭ শতাংশ শিশু কাজ করছে শুধু খাবারের বিনিময়ে। তাদের কোন বেতন ভাতা দেয়া হচ্ছে না।
দেশের সমাজ আজ লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি ও উদ্বীয়মান অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নূন্যতম মজুরি নীতির অভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। একদিকে ১৯৬১ সালের নূন্যতম মজুরি আইন, ১৯৬৯ সালের নূন্যতম মজুরি অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ সালের স্কপ-সরকার চুক্তি ১৯৯২ সালে গঠিত জাতীয় শ্রম আইন কমিশনের প্রয়োগহীনতা, অপর দিকে নতুন মুক্তবাজারের বিশ্বঅর্থনীতি একতরফা দাপটে দেশের শ্রমিক সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বছর বছর মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে কিন্তু শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমিশন আশানোরূপ বাড়েনি। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরায় যে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ইসলামের শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার
ইসলাম শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ বক্তব্য রয়েছে। হাদীসে আছে, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি দিয়ে দাও। হাদীসে আরো আছে শ্রমজীবীর উপার্জনই শ্রেষ্ঠতর যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়। যে ব্যক্তি নিজের শ্রমের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে তারচেয়ে উত্তম আহার আর কেউ করে না। কেবল উপর্যুক্ত হাদীসদ্বয় নয়, এ রকম অসংখ্য হাদীসের বাণী রয়েছে, যেখানে শ্রমকে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা মুসলমানমাত্রই এ বিষয়ে সবিশেষ অবগত যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ধনী-গরিব, উঁচু-নীচু সবাই সমান। এই যখন অবস্থা তখন তো অধীনস্থ লোকদের খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। এমনো হতে পারে যে, খাদেম তার মুনিব অপেক্ষা উত্তম এবং এও বিচিত্র নয় যে, আল্লাহর দরবারে খাদেমের কর্মই অধিক পছন্দনীয়। অনেক নবীই শ্রম বিনিয়োগ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
নবী করীম (সাঃ) এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন: ‘দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোনো নবী প্রেরণ করেননি যিনি বকরি চরাননি। হযরত দাউদ (আঃ) কর্মকার ছিলেন, হযরত আদম (আঃ) কৃষক ছিলেন, হযরত নূহ (আঃ) ছুতার (কাঠের কর্মসম্পাদনকারী) হযরত ইদ্রিস (আঃ) দর্জি, হযরত মূসা (আঃ) বকরি চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় এমন ভূরি ভূরি নজির রয়েছে যে, একজন সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তি মজদুর হয়েও রাষ্ট্রের কর্তধার পর্যন্ত হতে পারেন এবং হয়েছেনও। হযরত বেলাল, আম্মার, খাব্বাব, শুয়াইব, যায়েদ (রাঃ) প্রমুখ আরো অনেকেই মাওয়ালী বা আদায়কৃত দাস শ্রমিক ছিলেন। আজকাল শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক এক জটিল সমস্যায় আবর্তিত হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই শ্রমিক-মালিক আজ যেন দু’টি মারমুখী প্রতিদ্বন্দ্বী। ইসলাম বলে, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক যেন কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন হয়ে না পড়ে। কারণ শ্রমিক আর মালিকের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়া জাতীয় উৎপাদনে সন্তোষজনক হার আশা করা যায় না।
মহানবী (সাঃ) মানবতার মুক্তির জন্যই কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন অসহায়, দুর্বল ও নির্যাতিতদের অতি আপনজন। সুখে-দুঃখে তিনি তাদের পাশে থাকতেন। এদের দুঃখ-বেদনায় তিনি এতটাই ব্যথিত হয়েছিলেন, জীবনসায়ােহ্নও এদের কথাই বলে বলে পৃথিবীর মানবতাকে সাবধান করে গেছেন। ইন্তেকালের আগ মুহূর্তে তিনি বলে গেছেন, নামায ও অধিনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। (আবু দাউদ-ইবনে মাযাহ) তিনি আরো বলেছেন; তোমাদের গোলাম! তোমাদের ভৃত্য! তোমরা যা খাবে তা-ই তাদের খাওয়াবে, নিজেরা যা পরবে তা-ই পরতে দেবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন: অধিনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার সৌভগ্যের উৎস আর তাদের সাথে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্যের উৎস। (আবু দাউদ)
শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা না দিয়ে বাহুল্য ব্যয় করা ধনীদের স্বভাব। এ ধরনের আচরণ ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের চাকর-ভৃত্যরা তোমাদের ভাই। তাদের আল্লাহ তা’আলা তোমাদের অধিনস্থ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন সে তার ভাইকে যেন তা-ই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়, তাকে তা-ই পরিধান করায় যা সে পরিধান করে। আর তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ যেন তার ওপর না চাপায়। একান্ত যদি চাপানো হয়, তবে তা সমাধানের ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা উচিত। (বুখারী ও মুসলিম)
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম হলো আল্লাহ তা’আলার এক পবিত্র আমানত। যে রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের শ্রম বিনিয়োগস্থলের ব্যবস্থা করতে না পারে সে রাষ্ট্র কখনো জনকল্যাণমুখী হতে পারে না। ইসলাম বলছে: কারো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার বিপর্যস্ততার ছত্রছায়ায় যে চুক্তি করা হয় সেই চুক্তির কোনো মূল্য নেই। এরূপ জুলুমের চুক্তিকে ইসলাম কখনো অনুমোদন করে না। ইসলামের মূল কথা হলো নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করো না। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরি নিয়ে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। মহানবী (সাঃ) বলেন: মালিক, শ্রমিকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে অথবা এমন মজুরি দেবে যাতে তার প্রয়োজন মিটে যায়। নবী করীম (সাঃ) পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা ছাড়া মজুর থেকে কাজ নেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। শিকাগোর শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বে শ্রমিকের ৮ ঘণ্টা দাবি প্রায় সব দেশে মেনে নেয়। ইসলাম এই মৌলিক সমস্যার অনেক যুক্তিযুক্ত সমাধান দিয়েছে ১৪২০ বছর আগেই। ইসলাম বলছে, জীবনযাত্রার মান, পরিবেশ ও আবহাওয়ার তারতম্যে সব দেশের সব মানুষের কর্মক্ষমতা সমান হয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে তখনই একজন শ্রমিকের কাছ থেকে কাজ নেয়া যেতে পারে যতক্ষণ সে তা স্বাভাবিকভাবে কুলিয়ে উঠতে পারে। এছাড়া শ্রমিককে দিয়ে মালিক কী ধরনের কাজ করিয়ে নিতে চায় তাও নির্ধারণ করে নিতে হবে। মজুর পুঁজিপতির হাতের খেলনা নয়। ইসলামের মূলনীতি হলো মজুরকে দিয়ে এমন কাজ করিয়ে নেয়া যাবে না যা তার জন্য কষ্টকর।
অন্যদিকে রাসূল (সাঃ) বলেন; ‘সব দেশ ও জমিন আল্লাহর, আর সব মানুষ আল্লাহর বান্দা। তাই যেখানেই তুমি মঙ্গলজনক মনে করো সেখানেই বাস করো।’ লাভের ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) বলেন, শ্রমিকদের তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ (লাভ) হতেও অংশ দিয়ো। এমনিভাবে দেখা যায়, ‘শ্রমিকের সব ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা আর কেউ রাখতে পারেনি।
‘মহান মে দিবস’ শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে চেতনা সঞ্চারিত করেছে দেখা যাচ্ছে ইসলাম এসব বিষয় “যথেষ্ট গুরুত্ব” দিয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই মে দিবসের চেতনা সার্থক হবে।