মদ জুয়া হারাম উহার শাস্তির বিধান
মদকে আরবীতে ‘খামর’ বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ হল, আচ্ছন্ন করা। ইসলামী পরিভাষায় ‘খামর’ বা মদ বলা হয়, যা পান করলে জ্ঞান ও বুদ্ধি আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে।
মূলত পদপান সামাজিক অনাচার ও অপরাধের মধ্যে অন্যতম। মদপায়ী ব্যক্তি সমাজ জীবনে অশান্তি ও নিরাপত্তা হীনতায় পশু জীবন হতেও অধঃপতনের নিচে নেমে যায় ফলে সমাজে পারস্পারিক কলহ বিবাদ, মারামারি ও হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হয়ে থাকে।
জুয়া খেলা এক প্রকার সামাজিক মারাত্মক অপরাধ। উহা ব্যক্তি চরিত্র হতে সমাজ চরিত্রকেও কলুষিত করে। পৃথিবীর কোন ধর্মই জুয়াকে সমর্থন করেনি। বর্তমান সমাজে নানা ধরনের লটারী, হাউজিং প্রভৃতি আধুনিক নামে জাতীয় ক্ষতিকর কাজই জুয়ার অন্তর্ভূক্ত। উহা কখনও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে মদ জুয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ।
মহান আল্লাহ তা'আলা মদ জুয়া সম্পর্কে বলেনঃ “তারা আপনাকে (নবী)মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি (নবী) বলেদিন উভয়ের মধ্যেই রয়েছে মহাপাপ। (সূরা: বাকারা ২১৯)
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া প্রতিমা ও লটারী এ সবই শয়তানের কাজ। তোমরা উহা হতে বিরত থাক। আশা করা যায় যে, তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে। নিশ্চয় শয়তান, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর যিকর ও নামায হতে তোমাদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। তাই তোমরা এসব জিনিস হতে বিরত থাকবে কি? (মায়েদা ৯০-৯১)
ইমাম আবু হানিফা (রাহঃ) বলেন কুরআনের মধ্যে খামর বলে যেই মদকে হারাম করা হয়েছে তা হল ‘আঙ্গুরের কাঁচা রস যখন উহার মধ্যে ফোস্কা ফেনা ধরে যায় এবং পান করলে নেশাগ্রস্থ হয়, জ্ঞান বুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটায়। অধিকাংশ ইমামগণের মতে যেই জিনিসই মাদকতা সৃষ্টি করে উহাকেই মদ বলা হয়। মদ হারাম হওয়ার মধ্যে সমস্ত ওলামা ও ইমামদের মধ্যে ঐক্যমত্য রয়েছে, চাই উহাকে যে কোন নামে পান করা হোক না কেন? সহীহ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যেই জিনিস অধিক পরিমাণে নেশা সৃষ্টি করে উহার সামান্য পরিমাণও হারাম, মূলত নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেকটি বস্তুই হারাম।
রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা মদ থেকে বেঁচে থাক, কারণ এটা সকল অশ্লীলতার উৎস। (হাকেম) এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, যে লোক মদপান থেকে বিরত হয় না, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যচারী এবং এ জন্য শাস্তি অবাধারিত। আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় এবং তাঁর নির্ধারিত সীমাতিক্রম করে, আল্লাহ তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তার জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি। (নিসা ১৪)
রাসূল (সাঃ) বলেন, মদ পানে চির অভ্যস্ত ব্যক্তি মূর্তি পুজকের সমান (আহমদ) নাসায়ীতে ইবনে ওমর (রাঃ) রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, মাতা-পিতার অবাধ্য ও মদ পানে অভ্যস্ত এ দুইজন জান্নাতে যাবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেন “চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না। ব্যভিচারী ব্যভিচারে রত অবস্থায় মুমিন থাকেনা। মদপায়ী মদপান রত অবস্থায় মুমিন থাকে না। অতপর তওবা করলে মুমিন অবস্থায় ফিরে আসে। (বুখারী ও মুসলিম)
ইমাম বুখারী (রাহঃ) বলেন, হযরত ইবনে ওমার (রাঃ) বলেছেন, মদপানকারীকে সালাম দিওনা। রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, মদপানকারীদের সাথে ওঠাবসা করো না, তারা রোগাক্রান্ত হলে দেখতে যেয়োনা। তাদের জানাযায় অংশ গ্রহণ করো না। হাশরের দিন মদখোর কালো কুৎসিত চেহারা নিয়ে উঠবে। তার জিহ্বা বুকের উপর ঝুলতে থাকবে, যা থেকে লালা ঝরতে থাকবে। যে-ই তাকে দেখবে, সে-ই তাকে মদপানকারী হিসাবে চিনবে (ইবনে জাওসী)
ওলামায়ে কেরামের একদল অভিমত ব্যক্ত করেছেন মদখোর রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাওয়া ও সালাম দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণার কারণ, মদখোদ ফাসেক ও অভিশপ্ত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। তবে তওবা করলে আল্লাহ তাকে মাফ করবেন।
মদ পানের শাস্তিঃ
সওর ইবনে যায়দ দায়লামী (রহঃ) বলেন, মদপায়ীর শাস্তির ব্যাপারে হযরত ওমর (রাঃ) সাহাবাদের পরামর্শ চাইলেন। তখন হযরত আলী (রাঃ) বললেন, আমি মনে করি তাকে আশি দোররা মারা উচিত। কেননা যখন সে মদপান করে, তখন সে মাতাল হয়ে পড়ে, আর মাতাল হলে আবোল তাবোল বকাবকি করে। আর যখন সে আবোল তাবোল বকে, তখন সে মিথ্যা অপাবদও রটায় এবং ব্যভিচারে অপবাদের শাস্তি হল আশি দোররা। সেই হতে হযরত ওমর (রাঃ) মদপায়ীকে আশি দোররা মারার নির্দেশ দিলেন। (মালেক)
হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রাঃ) বলেন, আবু বকরের খেলাফত কালে এবং ওমরের খেলাফতের প্রারম্ভে মদ্যপায়ীকে এনে উপস্থিত করা হত। তখন আমরা আমাদের হাত, জুতা এবং চাদর দ্বারা তাকে আঘাত করতাম। কিন্তু হযরত ওমরের খেলাফতের শেষ দিকে তিনি চল্লিশ চাবুক মারতেন। আর যখন তারা (মদ্যপায়ীরা) সীমাতিক্রম করতে লাগল এবং ব্যাপকভাবে পাপে লিপ্ত হতে আরম্ভ করল তখন তিনি আশি দোররা মারতে লাগলেন। (বুখারী)
যদি কোন মদপায়ীকে পাকড়াও করে আনা হয় আর জনগণ সাক্ষ্য দেয় যে, সে মদ পান করেছে, অথবা তাকে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আনা হয়েছে কিংবা তার মুখ হতে মদের গন্ধ পাওয়া যায়, তখন তার উপর শাস্তি প্রয়োগ হবে। আর যদি কোন মদপায়ী গন্ধ থাকা অবস্থায় স্বীকার করে তাকেও শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু যদি গন্ধ চলে যাওয়ার পর স্বীকার করে, তখন ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ও আবু ইউসুফের মতে শাস্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু ইমাম মুহাম্মদ বলেন, তখনও শাস্তি দেওয়া যাবে।
ঈমাম শাফেয়ী বলেন, যদি কেউ মদ বমি করে বা মুখ হতে মদের গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে মদ পান করতে কেউ দেখে নাই, তখন তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। আর ইমাম আহমদেরও একই মত। ইমাম মালেকের মতে শাস্তির পরিমাণ হলো আশি দোররা। আর ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) চল্লিশ দোররার কথাও বলেছেন। পরিশেষে বলতে চাই মদ জুয়াই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উৎস, তা একমাত্র ইসলামী বিধানেই নির্মূল করা সম্ভব। তাই আসুন ইসলামী বিধানে জীবন যাপন করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এহেন ঘৃণীত ও হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমিন