১ম কিস্তি খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন : একজন খালেক তালুকদারের পতন কাহিনী কিংবা নিজের আত্নজীবনী
যাই হোক ২য় বা ৩য় পরীক্ষার আগের ছুটির দিনে খুলনায় গজব নাযিল হল।খুলনা সদর থানার ৫০ গজের মধ্যে দিনদুপুরে ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে নিজ গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে গাড়ির চালক সহ ব্রাশফায়ারে খুন হলেন খুলনা অঞ্চলের দীর্ঘদিনের গডফাদার আবুল কাসেম।সারা খুলনা শহরে অঘোষিত কার্ফু জারী হল।শহরে পুলিশ প্রায় দুই দিন হাওয়া।টানা চলেছে ভাংচুর,অগ্নিসংযোগ।সকালে হাঁটতে হাঁটতে পরীক্ষা দিতে গেছি অভিভাবক প্রহারায় আবার ফিরেও এসেছি হাঁটতে হাঁটতে।টানা ৩/৪ দিন খুলনা অচল হয়ে রইল।খুলনার সচেতন মহলের মতে,ক্যাপ্টেন সুজার উপর গুলিবর্ষণ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দলের নেতাদের কাসেম সাহেবের উপর জমানো ক্ষোভের সাথে নতুন আগুন যুক্ত করে।সাধারণ মানুষেরা মনে করে ,তখনকার সময় সাবেক স্পীকার রাজ্জাক আলী (যিনি খুলনা শহর একবার ঘুরে গেলে তার পরের দিন কেউ না কেউ খুন হবে এটা তখন ছিল খুলনা শহরে ওপেন সিক্রেট),মেয়র তৈয়েবুর রহমান,বর্তমান শহরের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু সহ বিএনপির সকল নেতা,ঐ সময়ের জাতীয় পার্টি ও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে খুন হওয়া আরেক ডন এস এম এ রব এবং তৎকালীন জাতীয় পার্টি নেতা ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা আরেক ডন আমিন কাজী বা কাজী আমিন, সহ সকল দলের সকল নেতাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে হত্যা করা হয় গডফাদার আবুল কাসেম সাহেবকে।
এস এম এ রব
আমিন কাজী
হাজী বাড়ীর নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের তখনকার ত্রাস পুলিশ অফিসার, দেশ কাঁপানো জনকণ্ঠের যশোর প্রধান শামসুর রহমান কেবল হত্যাসহ অনেক হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা শেখ আসাদুজ্জামান লিটু বা লিটু সাহেব।লিটু বা হাজী বাড়ীর অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় র্যাবের ক্রসফায়ারে লিটুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।
বানিয়া খামার বা হাজী বাড়ীর সাথে টেক্কা দিয়ে চলতে পেরেছিল খুলনার একটা মাত্র এলাকা,টুটপাড়া।পাকিস্থানী আমলে মহি গুণ্ডা,মণি গুণ্ডার হাতে টুটপাড়ার যে উত্থান তা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাবর আলী-সুজা-মিলু'র হাত ধরে খুলনা শহরে আলাদা অবস্থান করে নেয় টুটপাড়া।একটা সময় টুটপাড়া যা লিয়াকত নগর হিসেবে পরিচিত ছিল সেখান থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন এস, এম, মোস্তফা রশিদী সুজা এবং এনামুল হক মিলু-ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু।যাদের ভরসা সাহসী বন্ধু বাবর আলী খান।আজকের খালেক তালুকদার এবং এস, এম, মোস্তফা রশিদী সুজা একই সময়ে নিজ নিজ এলাকা থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন।
খালেক তালুকদার সংসদ নির্বাচন করা শুরু করেন রামপাল-মংলা বাগেরহাট-৩ এবং এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ আসনে।আর খুলনা সদর থেকে সংসদ নির্বাচনে ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বর্ষীয়ান নেতা মঞ্জুরুল ইমাম।খালেক তালুকদার এবং এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা সাংসদ নির্বাচিত হলেও মঞ্জুরুল ইমাম কিন্তু নির্বাচনে জিততে পারেননি কখনও।
আর মঞ্জুরুল ইমাম বা আওয়ামীলীগের কেউ খুলনা সদর থেকে না জেতার পিছনে বড় কারণ ছিল টুটপাড়া থেকে আওয়ামীলীগের ভোট না পাওয়া।
এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা
এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা কমিশনার হবার পর থেকে সমগ্র টুটপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন তিনি।হাজী বাড়ি আর বানিয়াখামার যেমন অবিছেদ্দ্য ঠিক তেমনি টূটপাড়া আর সুজা পরিবার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কমিশনার থেকে খুলনা-৪ আসনের আওয়ামী সাংসদ নির্বাচিত হন এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা ১৯৯১ সালে।পরেরবার সাংসদ হয়ে ক্ষমতাসীন দলের জাতীয় সংসদের হুইপ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য হন তিনি।এরপর শুধু খুলনা নয় সারা দক্ষিণঅঞ্চলের অন্যতম ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতায় পরিচিত হন তিনি।খুলনা অঞ্চলে পাওয়ার পলিটিক্স এর জনক বলা যায় তাকে।শুধু তিনি নন তার তিন ভাই রেজা,দারা এবং দুজাও চলে আসেন লাইমলাইটে।এ অঞ্চলে নতুন উত্তান ঘটে 'ভাইজান পরিবার' এর। রেজা শহরের ৩০ নং ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন আর দুজা আত্মপ্রকাশ করেন এক মূর্তিমান আতংক হিসেবে।দারার নামে কোন অভিযোগ তেমন নাই,দারা তার খেলাধুলার জগত মানে খুলনা ক্রীড়া সংস্থা এবং ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়েই পড়েই আছেন অনেক দিন।সন্ত্রাসীদের আশ্রয় এবং কাছের অনেক মানুষের নানা কুকর্মের কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েন এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা।খুলনা-৪ মানে রূপসা-তেরখাদা-দিঘলীয়া তে তার যেমন অনেক ভক্ত যেমন আছে ঠিক তার বিপরীতে বিপক্ষের লোকও অনেক।একদিকে খুলনা-৪ অন্যদিকে টুটপাড়া,দুই জায়গায় তার আধিপত্য ছিল ব্যাপক।ভাইজান অর্থাৎ এস এম মোস্তফা রশিদী এর কথাই সবথেকে বড় বা আইন হিসেবে বিবেচিত হত।
টুটপাড়া, আগেই বলেছি ২৮,৩০ ও ৩১ নং ওয়ার্ড নিয়ে অনেক বড় এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষেরা খুলনা সদরের রাজনীতিতে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে।খুব সাধারণ হিসাব হল,আওয়ামীলীগের কেউ সদর থেকে এম পি হলে এবং দল ক্ষমতায় গেলে তার মন্ত্রী হওয়া বেশ সহজ হবে।আর এই একটা হিসাব বরাবরই সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বারবার পরাজয়ের অন্যতম কারণ।আওয়ামীলীগের খুলনা অঞ্চলের প্রভাবশালী অনেক আওয়ামীলীগ নেতা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে বারবার হারিয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামীলীগের সদর আসনের প্রার্থীকে।আর এই হারের পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে টুটপাড়া মানে ২৮,৩০ ও ৩১ নং ওয়ার্ডের ভোটারেরা।নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগ সদরের অন্য ওয়ার্ড থেকে জাতীয় নির্বাচনে জিতলেও ২৮ নং,বিশেষ করে ৩০ ও ৩১ নং ওয়ার্ড থেকে ভরাডুবি হয়েছে বেশী। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের অনেক শীর্ষনেতা বিশেষ করে এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা ১/১১ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত প্রথম শীর্ষ ৫০ জন দুর্নীতিবাজদের তালিকায় থাকায় তার পরিবারের সকল সদস্য আত্নগোপনে চলে যায়।শুরু হয় "ভাইজান পরিবারের" ধ্বস।২০০৮ সালের নির্বাচনে দুর্নীতির তালিকায় নাম থাকায় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা।আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যেতে হয় তাকে।তার অনুসারী একটা বড় অংশ যোগ দেয় খুলনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের প্রশাসক শেখ হারুনুর রশিদের সাথে।তার মধ্যে জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন-সম্পাদক ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাদী, জেলা আওয়ামীলীগের যুব বিষয়ক সম্পাদক ও রূপসা উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আকবর শেখ, জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক ও দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হালিম গাজী,জেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক ও মোস্তফা রশিদী সুজার ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাবপত্রের রক্ষক জোবায়ের আহমেদ জবা,জেলা যুবলীগের সভাপতি কাম্রুজ্জামান জামাল প্রমুখ।তবে মোস্তফা রশিদী সুজা সবথেকে বিপদে পড়ে জেলা ছাত্রলীগের গ্রুপিং এর সময় জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক ও দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হালিম গাজী খুন হবার পর।সবার সন্দেহের তীর ছুটে যায় তার ও তার অনুসারী দিঘলিয়া আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আকরাম হেসেনের দিকে।দলের প্রধান শেখ হাসিনাও বিষয়টা ভালভাবে মেনে নেয়নি।মামলাটা আছে এখন সিআইডির হাতে,যে কোন সময় চার্জশিট দাখিল হতে পারে।আর এভাবে রাজনৈতিক অস্তিত্তের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা।
নিজেদের পিঠ বাঁচাতে সকল আওয়ামীলীগ নেতারা যার যার অনুসারীদের নিয়ে গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যেভাবে খালেক তালুকদারের পক্ষে কাজ করেছিল এবার নির্বাচনে সবাই কাজ দেখালেও মন থেকে সবাই খালেক তালুকদারকে মেয়র হিসেবে চায়-এটা ভাবলে ভুল হিসাব হবে।রাজনীতির অস্তিত্ব বাঁচাতে মরিয়া ক্ষমতাশালী আওয়ামীলীগ নেতারা খুব সহজে খালেক তালুকদারকে আবারও ক্ষমতায় যেতে দিবে এটা কি কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে?
#শেখ রাজ্জাক আলী,বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং সাবেক স্পীকার।১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে খুলনা সদরের সাংসদ।১৯৯১ সালে বিএনপি তাকে জাতীয় সংসদের স্পীকার মনোনীত করে।খুলনার মানুষ অনেক আশা নিয়ে ছিল এবার হয়ত অবহেলিত খুলনার ব্যপক উন্নয়ন হবে কিন্তু বিধি বাম।উন্নয়ন তো দূরে থাক খুলনায় এ কথা প্রবাদের মত ছড়িয়ে গেল " স্পীকার সাহেব একদিন খুলনা ঘুরে যাবে,পরের দিন কারো না কারো লাশ পড়বে"। রাজ্জাক আলী শুধু বিএনপি না খুলনার সাধারণ মানুষের মন থেকে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেল।সেই রাজ্জাক আলীকে করা হল খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে খালেক তালুকদারের প্রধান সমন্বয়ক,নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান ।যেটা খুলনার সাধারণ মানুষ মোটেও ভালভাবে মেনে নেয়নি।
আরেকটি বিষয় হল খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান ও তার সমর্থকরা রাজ্জাক আলীকে ভাল ভাবে মেনে নেয়নি।২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ছিলেন তিনি।মাত্র ১১০০ ভোটে তিনি হেরে যান বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছে।বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আলহাজ্ব মিজান সামনের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে রাজ্জাক আলীকে নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান করায় নানা কথা ঘুরপাক খেতে থাকে শহরে।সবথেকে বড় যে বিষয় সামনে আসে,তাহল রাজ্জাক আলী মেয়র নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন এবং খুলনা সদর থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হবেন ।এই বিষয়টা ভালভাবে মেনে নিতে পারেননি আলহাজ্ব মিজান ও তার সমর্থকরা।
আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান
নির্বাচনী প্রচারে থাকলেও আলহাজ্ব মিজান ও তার সমর্থকরা মন থেকে খালেক তালুকদারের বিজয় এবং তার ফলশ্রুতিতে আওয়ামীলীগে রাজ্জাক আলির অবস্থান পাকা করতে দিবে,এমন ধারণা করা ভুল হবে।
#খালেক তালুকদার গতবার মেয়র হবার পর সবথেকে বিপদে পড়ে ক্ষমতাশালী ঠিকাদাররা এবং কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।কারণ সিটি কর্পোরেশনের কোন কাজ নিয়মের বাইরে হতে দেননি খালেক তালুকদার।অফিস টাইমের বাইরেও তিনি হাজির হয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের চলমান কাজে।সাথে ইঞ্জিনিয়ার ও এলাকাবাসীদের নিয়ে প্রয়োজনে রাস্তা খুঁড়ে দেখেছেন উন্নয়ন কাজে কোন নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা।এলাকাবাসীদের সচেতন করেছেন এলাকার উন্নয়ন কাজ সিডিউল অনুযায়ী বুঝে নেওয়ার জন্য।ফলে উন্নয়ন কাজে দুর্নীতি করে অধিক মুনাফা করতে পারেননি কোন ঠিকাদার এবং ঠিকাদাররা দুর্নীতি না করায় অবৈধ আয় থেকে বঞ্চিত হয় সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।আর তাই জোটগতভাবে ঠিকাদাররা প্রচুর টাকা ব্যয় করেছেন খালেক তালুকদারের হারের জন্য।সমস্ত ক্ষতি ঠিকাদাররা পুষিয়ে নিতে চান সামনের উন্নয়নের ১২০০ কোটি টাকা থেকে। এই বিষয়ও খালেক তালুকদারের পতনের অন্যতম একটা কারণ বলে ধারনা করা যায়।
যাইহোক,খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র মনিরুজ্জামান মনি কে অভিনন্দন জানাই।তার কাছে প্রত্যাশা থাকবে খালেক তালুকদারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা তিনি ধরে রাখবেন এবং সরকারের প্রতি দাবী থাকবে নতুন মেয়রকে যেন খালেক তালুকদারের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া সরকারের সহযোগিতার হাত এখন মনিরুজ্জামানের দিকেই থাকে।