গালে প্রচন্ড জোড়ে একটা চড়!
ছেঁড়া সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা সাজিদ-নায়লার সম্পর্কটা সেদিনই চুড়ান্ত পরিণতি নিয়েছিল ।
চড় খেয়ে হতভম্ব অপমানিত সাজিদ তাৎক্ষনিক কোন শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বটে! কিন্তু চোয়ালবদ্ধ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পরেরদিনই তালাকনামার উকিল নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছিল । সেই সাথে তাদের দুই বছরের প্রেম আর চার বছরের সংসার জীবনের চুড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে ।
পড়ন্ত বিকেলের কোন একাকী অবসরে নায়লা যখন পেছনের কথা ভাবে, চোখ দুটি অজান্তেই ভরে উঠে জলে । সাজিদের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি আজও তাকে খুঁচিয়ে বেড়ায় । আত্মবিশ্বাসী প্রাণরসে ভরপুর সাজিদ প্রথম দেখাতেই তার মন কেড়েছিল । সাজিদের দিকে নায়লাই প্রথম হাত বাড়িয়েছিল । কি ছিলনা তাদের প্রেমে! ভালোবাসা ছিল, বিশ্বাস ছিল, ছিল অকারণে মুগ্ধতায় ডুবে যাওয়া ।
বিয়ের পর সাজানো গোছানো সংসার নিয়ে সময়টা কাটছিল বেশ । নায়লার প্রতি সাজিদের কেয়ারিং মাঝে মাঝেই পাগলামোর মাত্রায় পৌছে যেত । কি গার্হস্থ্য কর্ম, কি ঘুরে বেড়ানো, কি নায়লাকে অবাক করে দেয়ার ছেলেমানুষী চেষ্টা! সবকিছুতেই সাজিদের ছিল অদম্য প্রাণ শক্তি ।
হঠাৎ করেই নায়লা বুঝতে পারে, কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছে । কি যেন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সম্পর্ক থেকে । সাজিদের বদলে যাওয়া নিয়ে ভেবে ভেবে নায়লা খুঁজে পেল এক আত্মবিনাশী যোগসূত্র! সাজিদের সন্দেহবাতিকতা..
হ্যাঁ, সাজিদ দিন দিন সন্দেহপ্রবন হয়ে উঠছিল । প্রথম দিকে ব্যাপারটা নায়লার চোখ এড়িয়ে গেলেও এক পর্যায়ে সাজিদের অসামঞ্জস্য আচরণে তা ক্রমে প্রকাশিত হতে থাকে । নায়লা মাথা ঠান্ডা রেখে সন্দেরপ্রবনতার উৎস খুঁজতে চেষ্টা করে । সাজিদের সাথে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলাপ করার চেষ্টা করে । কিন্তু সাজিদ পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করে বসে ।
দিন যায়, সাজিদ এখন আর কোন কিছুই গোপন করে না । প্রকাশ্যেই নায়লাকে বিভিন্ন বিব্রতকর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে । কিন্তু নায়লার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছিল হাস্যকর যন্ত্রণাদায়ক । সে বুঝতে পারে সাজিদের এই প্রবনতা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে । নিজেকে নায়লা বেশিক্ষন স্থির রাখতে পারেনা, প্রকাশ্যেই দুজন কলহে জড়িয়ে পড়ে ।
কাছের স্বজনেরা এসে পরামর্শ দেয়, বাচ্চাকাচ্চা নিলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু সে তো চেষ্টা কম করছে না, আর সবকিছুতে তার হাতও নেই । নায়লা যেদিন শুনতে পায় সাজিদ তার এক জুনিয়র কলিগের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে, সেদিনই সব কিছু শেষ হয়ে যায় । নায়লা ভেবে নেয় সাজিদ তার গোপন বাসনা চরিতার্থ করতেই এমন সন্দেহের ভান করছে । একরাশ ঘৃণা এসে ভর করে নায়লার মনে । পারষ্পরিক ঘৃণার অমোঘ পরিণতিতে দুজনেই বেছে নেয় আলাদা জীবন ।
সাজিদের সাথে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর নায়লা একটা স্কুলে চাকুরি নেয় । একাকী জীবনে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার সুযোগও এসেছিল । কিন্তু সে আর কাউকে পুরোটা বিশ্বাস করতে পারে নি । তাই নিরুদ্রপ একাকী জীবনে স্কুলই হয়ে উঠে তার সব কিছু ।
এখন নায়লা যে স্কুলে আছে সেটা একটা চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান । আশ্রয়হীন শিশুদের কথা ভেবে প্রতিষ্টিত হলেও এটা এখন বাবা মা থেকে দুরে থাকা মধ্যবিত্ত শিশুদের রেসিডেনশিয়াল হোম । এখানকার শিক্ষার পরিবেশ আর মানদন্ডের উৎকর্ষতার জন্য অনেক চাকুরিজীবি পরিবারের শিশুরা এখানে পড়তে আসে ।
সার্বক্ষনিক শিক্ষিকা হিসাবে নায়লা শিশুদের সাথে হোমেই থাকে । বাচ্চাগুলোর সাথে তার হৃদ্যতা কাছের মানুষদের মতোই । নায়লাও তাদের নিজের সন্তানের মত আপন করে নিয়েছে । সেদিন ক্লাসে নায়লা একটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দেয়, মা নিয়ে । সেঁজুতি নামের একটা মেয়ের লেখা পড়ে সে কিছুতেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারছিল না । সেঁজুতি লিখেছে,
"শুনেছি মা মারা গেলে আকাশের তারা হয় । মা বেঁচে থাকলে কি হয় জানি না । আমার মা বেঁচে আছে, তবু আমি আকাশে তারা খুঁজি । তারা'দের ঝরে পড়া দেখতে আমার খুব ভালো লাগে ।"
সেঁজুতি মেয়েটা এমনিতে খুব বুদ্ধিমতি আর নিয়ামনুবর্তী । কিন্তু মা সম্পর্কে তার নেতিবাচক ধারণা নায়লাকে ভাবিয়ে তুলে । প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতেই তিনি ফাইল ঘেটে জানান, সেঁজুতির বাবা-মা আলাদা থাকেন । সে তার বাবার কাছেই বড় হয়েছে । সেঁজুতির বাবা এখন দুরের একটা শহরে চাকুরি করেন ।
এটা জানার পর নায়লার মনটা হাহাকার করে উঠে । পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে নায়লা সেঁজুতির সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ।
রিসিপশন থেকে খবর আসে সেঁজুতির বাবা এসেছেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে । সেঁজুতিকে একা পাঠালেই চলত, তবু নায়লা ইচ্ছে করেই তার সাথে যায় । অতিথিঘরে চুপচাপ বসে থাকা সেঁজুতির বাবাকে দেখে নায়লার মাথা ঘুরে যায় । সাজিদের সাথে এভাবে কখনো দেখা হয়ে যাবে তা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ।
দুজনেই কিছু সময়ের জন্য হতবাক হয়ে যায় । সেঁজুতি দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে । নায়লা ঘোরলাগা চোখে বাবা মেয়ের আনন্দমিলন প্রত্যক্ষ্য করে । বেশ কিছু সময় পর সেঁজুতি যখন বাবার আনা বারবিডল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন নায়লা আর সাজিদ পরষ্পরের মুখোমুখি হয় ।
সাজিদই প্রথম মৌনতা ভেঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করে । নায়লার ঘোরলাগা বিস্ময় তখনো কাটেনি, সাজিদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে শুধু হুহা জবাব দেয় । সাজিদ তাকে সেঁজুতির মায়ের কথা বলে । সেঁজুতির মায়ের সাজিদকে ফেলে চলে যাওয়ার গল্প নায়লার কাছে পরিচিত গল্পের পুনরাবৃত্তি মনে হয় । তবু সাজিদ কথা বলতে থাকে, তার বোধ উপলব্ধির কথা । অতীতে নায়লার প্রতি তার অবিচারের আত্মগ্লানি আর আত্মদহনের কথা । সাজিদ বলে, "বারবার ভালোবাসা যায় না । মানুষের জীবনে ভালোবাসা একজনকেই ঘিরে আবর্তিত হয় । কিন্তু অনেক সময়ই মানুষ তা বুঝতে ব্যর্থ হয় । ব্যর্থ মানুষদের অনুশোচনা আর গ্লানির আগুনে বাকিটা জীবন পুড়তে হয় ।"
নায়লার ঘোরলাগা তখনো কাটেনি । অবাক হয়ে সে সাজিদের দিকে তাকিয়ে রয় । কি অবলীলায় সাজিদ নায়লার মনের কথাগুলো বলে যাচ্ছে! নায়লার মাথায় কেবল একটি চিন্তাই ঘুরপাক খেয়ে যায়, মানুষের জীবনে ভালোবাসা শুধু একজনকেই ঘিরে আবর্তিত হয়!
(এটা সেই ফরমায়েসি ভালুবাসার গল্প, সম্পাদক সাহেবের বিনীত অনুরোধে ৮০০ শব্দের মধ্যে বানাতে হয়েছিল । লুতুপুতু বলিয়া লজ্জা দিবেন না )